গত আগস্ট মাসের ৮ তারিখে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে রাষ্ট্রসংস্কার নিয়ে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা করা হচ্ছে। এটি একটি ইতিবাচক দিক যে সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের, বিভিন্ন পেশার নাগরিকেরা রাষ্ট্র নিয়ে ভাবছেন এবং তাঁদের মতামত জানাচ্ছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে নতুন সরকার ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশে সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণের শেষ অংশে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, একটি জাতির সংস্কার শুধু সরকারের পক্ষে করা সম্ভব নয়। সবাইকে নিজ নিজ জগতে সংস্কারের আহ্বান জানান তিনি। জাতীয় কল্যাণমুখী একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে তিনি নির্বাচন কমিশনসহ, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন ও সাংবিধানিক সংস্কার—এ ছয় নতুন কমিশন গঠন করার ঘোষণা দেন।
আইন ও বিচারব্যবস্থা নিয়ে সংস্কারের অবশ্যই প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। সেটি একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত যে আইনব্যবস্থা বাংলাদেশে বিদ্যমান, তা দিয়েই অতিসত্বর কিছু অপরাধকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন, যার মধ্যে ‘মব জাস্টিস’ বা ‘মব লিনচিং’ বলে অধিক পরিচিত অপরাধটির কথা না বললেই নয়। এমন নয় যে এই অপরাধ নতুন করে সংঘটিত হচ্ছে আমাদের দেশে, কিন্তু সম্ভবত এর মাত্রা বেড়ে গেছে ইদানীং।
বিচারবহির্ভূত এই হত্যাকাণ্ড একের পর এক ঘটতে থাকায় জনমনে একই সঙ্গে আতঙ্ক ও আক্রোশ বেড়ে চলেছে। এরই মধ্যে ১৮ সেপ্টেম্বর একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই ব্যক্তিকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। একজন ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন, সেই অপরাধে; আরেকজনকে মুঠোফোন চুরির অভিযোগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ এম হলে তোফাজ্জল নামের কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ ব্যক্তিকে ছাত্ররা পিটিয়ে মেরে ফেলেন।
আইন প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে বেঁচে থাকার অধিকার প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অধিকার এবং অপরাধ প্রমাণের আগে প্রত্যেক ব্যক্তিকে ‘নির্দোষ’ হিসেবে গণ্য করতে হবে। মনের সংস্কার না হলে রাষ্ট্রের সংস্কার শুধু নামমাত্রই হবে, যা আদতে কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে না।
এ ঘটনা ভীষণ আলোড়ন তৈরি করেছে সবার মনে। কারণ, হঠাৎ তোফাজ্জলকে মেরে ফেলা হয়নি। প্রথমে একপ্রস্থ মারার পর হলের ক্যানটিনে রাতে ভাত খাওয়ানোর পর আবার তাঁকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। এ রকম নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জড়িত, তা মেনে নিতে সবার কষ্ট হচ্ছে।
বিশেষ করে এক মাস আগেই ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে, যা একটি ঐতিহাসিক মূল্য রাখে। তার পরপরই ছাত্রদের কাছ থেকে এ ধরনের অপরাধ সংঘটনকে শুধু বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে না করে, মব লিনচিং নামের এই অপরাধ নিয়ে একটু ভাবার প্রয়োজন আছে বৈকি!
মব জাস্টিস প্রকারান্তরে ‘জঙ্গল জাস্টিস’ বা ‘স্ট্রিট জাস্টিস’ বলেও পরিচিত, যা মূলত একটি দেশে নাগরিকের সামাজিক ও আইনি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বিচারব্যবস্থার ব্যর্থতার প্রতি চরম অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশকেই বোঝায়। আঠারো শতকে যুক্তরাষ্ট্রে অপরাধের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর এ ধরনের হামলার উদাহরণ রয়েছে ইতিহাসে। দুঃখের বিষয়, যে কারও বিরুদ্ধে নৃশংস ও অমানবিক আচরণ দমনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও এখনো যুক্তরাষ্ট্র, আফ্রিকা, এশিয়া ও ইউরোপের কিছু দেশে এই অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যায়।
এই অপরাধের অন্যতম বৈশিষ্ট্যগুলো হলো, ভুক্তভোগীর অপরাধের মাত্রার চেয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার বিষয়টি অপরাধীর কাছে বেশি গুরুত্ব পায় এবং শাস্তির ধরন প্রচলিত আইনের চেয়ে অনেক বেশি নিষ্ঠুর ও নির্মম হয়ে থাকে। মব জাস্টিসের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, ভিড়ের মধ্যে থেকে এবং নিজের পরিচয় গোপন রেখেও একটি অপরাধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করা যায়।
খেয়াল করে দেখবেন, তোফাজ্জল হত্যাকাণ্ডে অনেকের অংশগ্রহণ ছিল এবং তাঁদের অনেককেই এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ডি-ইন্ডিভিজ্যুয়েশন বা বেনামি থেকে নিজের চাওয়া–পাওয়া থেকে ওই মুহূর্তে দলটির চাওয়া–পাওয়াকে গুরুত্ব দেওয়ার এই ‘মব মেন্টালিটি’ কতটা ভয়ংকর হতে পারে, তা বুঝতে দুই দিন আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা দুটিই যথেষ্ট!
একটু অন্যান্য দেশের দিকে তাকাই। এস বি মরগ্যানের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে নাইজেরিয়ায় ২৭৯টি মব জাস্টিসের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, যার মাধ্যমে ৩৯১ জনের মৃত্যু ঘটেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই অপরাধের কারণ হিসেবে দারিদ্র্য, আর্থসামাজিক অনিশ্চয়তা, ভঙ্গুর আইনব্যবস্থা ও সামাজিক উদ্বেগকে দায়ী করা হয়েছে।
এ ছাড়া ভারতে প্রথম ব্যাপকভাবে এই মব লিনচিংয়ের ঘটনা আলোচনায় আসে ২০১৫ সালে, যখন মোহাম্মদ আখলাক নামের এক মুসলিম ব্যক্তিকে গরু জবাইয়ের অভিযোগে হত্যা করা হয়। পরবর্তীকালে তেহসিন পুনাওয়ালা ও অন্যান্য বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া (২০১৮) মামলার রায়ে আদালত সব প্রদেশকে গরু সুরক্ষার নামে মবক্রেসির মতো অপরাধ দমনে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেন।
সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশনা পেয়ে মণিপুর, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থান ‘অ্যান্টিলিনচিং আইন’-এর খসড়া তৈরি করলেও পরবর্তীকালে তা প্রণয়ন করা হয়নি রাজনৈতিক জটিলতার কারণে।
তবে আধুনিক সমাজতাত্ত্বিকেরা সামাজিক কাঠামোর বিভিন্ন নিয়ামককে তরুণ-কিশোর অপরাধের কারণ হিসেবে বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁরা বলতে চেয়েছেন, নিম্নমানের আর্থসামাজিক পরিবেশ (দারিদ্র্য, বেকারত্ব, সংস্কৃতিহীনতা) তরুণদের অপরাধপ্রবণ করতে সাহায্য করে। কিন্তু সব সমাজবিজ্ঞানীই এ মতবাদকে সমর্থন করেন না; বরং তাঁরা মনে করেন, অপরাধপ্রবণতার মূল কারণ খুঁজতে সেই ব্যক্তির সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করতে হবে। বয়ঃসন্ধিকালে এ প্রক্রিয়া যদি সঠিকভাবে পরিচালিত না হয়, সেখানে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠার আশঙ্কা তৈরি হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নাগরিকের আর্থসামাজিক অনিরাপত্তা বা ভঙ্গুর বিচারব্যবস্থা পূর্ববর্তী অনেক সরকারের আমলেই প্রকটভাবে দেখা গেছে, যা একটি অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে কয়েক মাসের মধ্যে আমূল পাল্টে ফেলা সম্ভব নয়। তবে প্রথমেই যা বলেছি, এই মব জাস্টিসকে প্রতিরোধ করতে সত্বর অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
একই সঙ্গে সদ্য অভ্যুত্থানে নানাভাবে অংশ নেওয়া কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীকে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করার ওপর জোর দাবি জানাই। প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি বিভাগ যদি এ ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে, তাহলে স্বাভাবিক একাডেমিক জীবনে ফিরতে কিছুটা সহজ হবে তাঁদের। আমাদের মনে রাখতে হবে, ইতিহাসে ২০২৪-এর মতো গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনা খুব কমই ঘটে। সেটিকে আত্মস্থ করে সামনে এগিয়ে যাওয়া সহজ কাজ নয়।
আইন প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে বেঁচে থাকার অধিকার প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অধিকার এবং অপরাধ প্রমাণের আগে প্রত্যেক ব্যক্তিকে ‘নির্দোষ’ হিসেবে গণ্য করতে হবে। মনের সংস্কার না হলে রাষ্ট্রের সংস্কার শুধু নামমাত্রই হবে, যা আদতে কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে না।
উম্মে ওয়ারা সহযোগী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারউইক, ইউকে