কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও পরবর্তী সংঘর্ষ–সহিংস পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই ২০২৪) সন্ধ্যার পর থেকে দেশজুড়ে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মঙ্গলবার (২৩ জুলাই ২০২৪) রাত থেকে সীমিত আকারে ইন্টারনেট চালু করা হয়। এ কয়দিনের প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকার সম্পাদকীয়, লেখা ও সাক্ষাৎকার ধাপে ধাপে অনলাইনে প্রকাশ করা হচ্ছে। মঙ্গলবার (২৩ জুলাই ২০২৪) এ লেখা ছাপা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু এটি মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয় নয়। বরং বিষয়টি মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতি এবং তাঁদের নাতি-পুতিদের নিয়ে।
বীর মুক্তিযোদ্ধারা সমাজের অনগ্রসর ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নন, তাঁরা অগ্রগামী সৈনিক। তাঁদের অনগ্রসর বলা হলে আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করা হবে।
আমাদের সংবিধানপ্রণেতারা মুক্তিযোদ্ধাদের অনগ্রসর হিসেবে চিহ্নিত করেননি। বঙ্গবন্ধু যখন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা চালু করেছিলেন, তা ছিল সংবিধান প্রণয়নের আগে।
৫৩ বছর হয়ে গেলেও মুক্তিযোদ্ধার আইনগত কোনো সংজ্ঞা আজ অবধি নেই। মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা সরকার নীতিগতভাবে নির্ধারণ করেছে এবং এই নীতি সময়ে সময়ে পরিবর্তন হয়। এভাবে নীতি বদল করে আসলে গোলপোস্ট শিফট করা হয়।
মুক্তিযোদ্ধারা কোন খাতায় ও কখন নাম লিখিয়েছিলেন, তার ভিত্তিতে তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা হয়। তাই বাছবিচারহীনভাবে (আরবিট্রলি) অনেক মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছিলেন, নীতি পরিবর্তনের ফলে অনেককে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অনেক অমুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ঢুকে পড়েছেন।
মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিবাহিনী এক নয়। যেহেতু মুক্তিযোদ্ধার আইনগত কোনো সংজ্ঞা নেই, তাই অনেক সংস্কৃতিকর্মী, বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। বিশেষ করে যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করে সেই মুক্তিবাহিনী গঠন করেছিল, সেই নেতৃত্বদানকারীদের আজ অবধি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তাই তাঁদের সবাইকে যুক্ত করে আইনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞার সংস্কার প্রয়োজন।
অনগ্রসর হিসেবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, ঐতিহাসিকভাবে পিছিয়ে পড়া নারীদের কোটার বিষয়ে সংবিধান ইতিবাচক পদক্ষেপ (অ্যাফারমেটিভ অ্যাকশন) নেওয়ার অনুমতি দেয়। সেটাও চিরন্তন নয়, স্বল্পমেয়াদি। মূলত তাঁদের মূলধারায় টেনে তোলার জন্য।
মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিদের ক্ষেত্রে যে কোটার বিষয়টি ছিল তা স্বল্পমেয়াদি নয়, বংশপরম্পরায় চলার কথা। আমাদের সংবিধানের যে জনগণতান্ত্রিক (রিপাবলিকান) চরিত্র, এটি তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। রাজতন্ত্রের মতো বংশপরম্পরা জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে হয় না। এটি আমাদের রাষ্ট্রের চরিত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
যারা মামলা করেছিল, অর্থাৎ ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান প্রজন্ম’ সংগঠন, তারা অনিবন্ধিত। তারা মুক্তিযুদ্ধের সন্তান ও প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে মামলা করেছিল। মামলা করার (লোকাস স্ট্যান্ডাই) ভিত্তি ছিল, তারা মুক্তিযুদ্ধের সন্তান ও প্রজন্মের প্রতিনিধিস্বরূপ (রিপ্রেজেনটেটিভ ক্যাপাসিটি)। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতিনিধিত্বের ক্ষমতাবলে কোনো প্রতিনিধিত্বশীল (ক্লাস অ্যাকশন) মামলা করা যায় না। যিনি সংক্ষুব্ধ, তিনি সরাসরি অথবা জনস্বার্থে সমষ্টিগতভাবে সংক্ষুব্ধ হয়ে আদালতে রিট মামলা দায়ের করতে পারেন।
তাই প্রশ্ন জাগে, বর্তমান রিটকারীরা প্রতিনিধিত্বের ক্ষমতাবলে কাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন? ভবিষ্যৎ বংশধরদের, যাদের এখনো জন্ম হয়নি (আনবর্নড চিলড্রেন)। যেহেতু রিটকারীরা ব্যক্তিগতভাবে সংক্ষুব্ধ নন অথবা জনস্বার্থে মামলা করেননি, তাই রিটকারীদের মামলা আমলযোগ্য (মেইনটেনেবল) নয়। সেই বিবেচনাতেই আপিল খারিজ হওয়ার যোগ্য ছিল।
কোটার বিষয়ে রাষ্ট্রীয় আইন এখনো হয়নি। এটি কেবল সরকারের নীতির মাধ্যমে নির্ধারিত হচ্ছে। আইনের জগতে এটি প্রতিষ্ঠিত যে সরকারের নীতির বিষয়ে আদালত হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। তাই হাইকোর্টের রায়টি বাতিল হওয়ার যোগ্য। বিশেষ করে যেহেতু ২০১৮ সালে সরকারি নীতি পরিবর্তন হওয়ার কারণে কোনো কোটা নেই, তাই সেই নীতির পরিবর্তনের বিষয়ে হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ করাটা তার এখতিয়ারবহির্ভূত ছিল।
রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণের বিষয়টি নির্বাহী বিভাগের একান্ত আওতাধীন (জুরিসডিকশন)। আদালত রাষ্ট্রের পক্ষে নীতি নির্ধারণ করতে পারেন না। সরকারি নীতি কী হবে বা হবে না, তার ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। সরকারি নীতি যদি সংবিধানবিরোধী হয় অথবা
স্বেচ্ছাচারী (আরবিট্ররি) হয় অথবা অযৌক্তিক (আনরিজনেবল) হয় তাহলে আদালত সরকারের নীতি অবৈধ ঘোষণা করতে পারেন। কিন্তু আদালত সরকারের নীতিনির্ধারণ করতে পারেন না। সরকারের নীতি কী হওয়া প্রয়োজন, সেটাও বলে দিতে পারেন না।
হাইকোর্টের রায় বাতিল হওয়ায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করছি। সুপ্রিম কোর্ট কমপ্লিট জাস্টিস বা (সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার) করতে গিয়ে ১০৪ অনুচ্ছেদ মোতাবেক কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার করতে গিয়ে নারীদের জন্য বিদ্যমান ১০ শতাংশ কোটা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তাই প্রশ্ন জাগে, এটি নারীদের ওপর সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার হলো কি না।
একটা সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে নতুন সমস্যার সূচনা হলো কি না, সেটি সময় বলে দেবে। নারীদের কোটার বিষয়টি সামনে কোনো বিচারাধীন (সাবজুডিস) বিষয় ছিল না। এই বিষয়ে কোনো আইনজীবীর বক্তব্য শোনার জন্য আদালত আমন্ত্রণও জানাননি। এ বিষয় নিয়ে কোনো বিতর্কও ছিল না। তাই হঠাৎ করে ১০ শতাংশ কোটা কেড়ে নেওয়ার বিষয়টি আমাদের সবাইকে হতবাক করেছে।
আমার বিজ্ঞ সিনিয়র অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছেন, ১০৪ অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে (সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার) সর্বোচ্চ আদালত তখনই করতে পারেন, যখন সর্বোচ্চ আদালতের সামনে কোনো মামলা ‘পেন্ডিং’ আছে। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালত আপিল খারিজ করে দেওয়ার পর সামনে আর কোনো আপিল বা কোনো পক্ষ ছিল না। তাই পূর্ণাঙ্গ ন্যায়বিচার আপিল বিভাগ কাদের ওপর করলেন? তাঁদের সামনে তো কোনো মামলা পেন্ডিং নেই।
রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ কেবল সরকারের এখতিয়ার। আদালত হস্তক্ষেপ করবেন না। অথচ কোটার হার নির্ধারণ করতে গিয়ে আদালত কি রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণের জায়গায় প্রবেশ করলেন? যদিও সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন, তাঁদের এই পর্যবেক্ষণ বাধ্যতামূলক নয়।
আমাদের গণতন্ত্রের চর্চা দাবি রাখে, রাষ্ট্রের যেকোনো বিভাগ থেকে যাঁদের জন্য আইন করা হবে, তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংশ্লিষ্টতা জরুরি। সেটা বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ বা সংসদ—যেখানেই হোক না কেন। সিদ্ধান্ত যেন ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া না হয়। অর্থাৎ যে সিদ্ধান্ত দ্বারা কোনো নাগরিকের জীবন পরিচালিত অথবা নিয়ন্ত্রিত হবে, সেই সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় তঁাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ভিত্তিই হচ্ছে গণতন্ত্র।
আমার সরল বিশ্বাস, সরকার সে কাজটি করবে। নারীদের ১০ শতাংশ কোটার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময়ের উদ্যোগ নেবে।
আন্তর্জাতিক আইন ও সনদ অনুযায়ী, প্রতিটি ক্যাডারে ন্যূনতম ৩৩ শতাংশ নারীদের অবস্থান বাস্তবায়ন করা আমাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কর্তব্য। সর্বোচ্চ আদালতের বেঞ্চে পুরুষের তুলনায় নারীদের অনুপাত ১: ৭। কোনো নারী এখনো সামরিক বাহিনী প্রধান হননি। রাষ্ট্রের কোনো অ্যাটর্নি জেনারেল নারী হননি। মুদিদোকানি বা নারী বাসচালক কম দেখা যায়।
সর্বস্তরে নারীদের উপস্থিতি দেখছি না। এখনো পারিবারিক সম্পত্তিতে নারীদের সমান অধিকার নেই। তাই যতক্ষণ নারীদের অবস্থান সব ক্ষেত্রে নিশ্চিত ও দৃশ্যমান হচ্ছে না, ততক্ষণ স্বল্পমেয়াদি কোটা ব্যবস্থা চালু থাকা জরুরি।
আর মুক্তিযোদ্ধারা অনগ্রসর গোষ্ঠী নন। তাই তাঁদের জন্য আদৌ কোটা থাকতে পারে কি না—এই প্রশ্নের আইন ও সাংবিধানিকভাবে মীমাংসা হওয়া প্রয়োজন। আদালত মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ কোটা রাখার পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা পৃথিবী ছেড়ে গেছেন এবং অনেকের সন্তানদের বয়স ৪০-এর বেশি। তাই এই ৫ শতাংশ কোটা কি আদৌ বাস্তবায়ন করা সম্ভব?
শেষ কথা থাকবে, সরকার সব অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে কোটা নির্ধারণ করবেন, যেখানে নারী ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীসহ সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের অবস্থান নিশ্চিত করা হবে।
● তানিয়া আমীর সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী