সাংবিধানিকতা, সাংবাদিকতা ও জনচৈতন্যে সংবিধান

সাংবিধানিকতা আর সাংবাদিকতা চমৎকার অনুপ্রাস সৃষ্টি করে। অনাসৃষ্টিও করে মাঝেমধ্যে। বোধ করি, সাংবিধানিকতা শব্দটি সংবাদপত্রের পাতায় ভর করেই জনমানসের কাছে যায় সবচেয়ে বেশি। কিন্তু আমরা সাংবাদিকতার চর্চা যে মাত্রায় দেখি, সাংবিধানিকতার চর্চা সে রকম কি দেখি? চর্চা তো দূরের কথা ‘সাংবিধানিকতা’ শব্দটি সাধারণের বোধ পরিসীমায়ও খুব প্রচল নয়। কারণ, সর্বজনীন সংবিধান এখনো অল্প কিছু পেশাজীবী আর সচেতন পেশাজীবীরই হয়ে আছে, কতিপয়ের গণ্ডি পেরোতে পারেনি।

সাধারণের হয়নি নামের রাষ্ট্র পরিচালনার ‘গ্র্যান্ড ম্যানুয়াল’ সংবিধান। যাঁদের সাংবিধানিকতা জেনে, মেনে কাজ করা উচিত, তাঁরা কী করছেন? সাংবিধানিকতার ন্যূনতম চর্চাও অনেক নাগরিক–ভোগান্তির রক্ষাকবচ হতে পারত। সাংবিধানিকতার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকলে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহকেরা প্রথম আলোর সাংবাদিককে আইনের আওতায় আনার ক্ষেত্রে ‘যথাযথ প্রক্রিয়া’ অনুসরণ করতেন। আমরা আইনজীবীরা কোর্টরুম সাবমিশনে বলে থাকি, ‘ক্রিমিনাল জুরিস প্রুডেন্স অনুযায়ী ফৌজদারি মামলায় ডিউ প্রসেস, অ্যাক্ট অব ফেয়ার প্লে ও ইকুয়াল অপরচুনিটি অব বিং হার্ড নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক (রেফরেন্স: পার্লবার্গ বনাম ভার্টি,(১৯৭২) ১ ডাব্লিউ এল আর)।

রাষ্ট্রের আইন ও নির্বাহী বিভাগের সব কার্যাবলি সাংবিধানিকতার ‘অ্যাসিড টেস্টে’ পাস না করে ন্যায্যতা পেতে পারে না। খেয়ালে বা বেখেয়ালে অসাংবিধানিক আইন প্রণয়ন করলেও উচ্চ আদালত রয়েছেন তার সাংবিধানিকতা চ্যালেঞ্জ করতে। যেমন স্বাধীন সাংবাদিকতা–পরিপন্থী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করা হয় সংশ্লিষ্টদের মতামত আমলে না নিয়েই। কিন্তু সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ বলে, ‘৩৯। (১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল। (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের ঘোর বিপরীতে। যে কারণে ২০২০ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ও ৩১ ধারা কেন অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট বিভাগ। এই ধারা দুটি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩১ ও ৩৯–এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেই আদালত এই রুল জারি করেছিলেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অসংবেদনশীল ব্যবহার লেখক–সাংবাদিকদের অস্বস্তির কারণ হয়ে এখনো বহাল আছে।

কাফকায়েস্ক একটি ঘরানা, যার জনক ফ্রানৎস কাফকা। কাফকার রচনারীতি কাফকায়েস্ক একটি আলোচিত লিটারেরি ফর্ম। একটি শব্দ নানা অর্থ ধারণ করে, নানা বোধ ছড়ায়। ব্যাখ্যায় তা সহজ হয়ে বোধের পরিসীমায় ধরা দেয় বলেই বোধগম্যতা পায়। কাফকার রচনার বোধগম্যতা নিয়ে আরেক বিখ্যাত ক্রিটিক থিওডর আডর্নো বলেছিলেন, ‘কাফকার প্রতিটা বাক্য চিৎকার করে বলছে যেন, আমাকে ব্যাখ্যা করো।’ আমাদের রাজনীতিকেরা এবং সংবিধান–সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পেশাজীবীরা যখন সংবিধানের লিখিত শব্দের ব্যত্যয় ঘটান, তখন আমাদের সংবিধান নামের সেই মহালেখ্যপত্র তেমনি চিৎকার করে—‘আমাকে পড়ো; আমাকে বুঝে, মেনে কাজ করো।’ কিন্তু আমাদের মোহরমারা রাজনীতিকেরা সংবিধানের পাঠ নেন তাঁদের সুবিধা বিবেচনায়। আমরা ভুলে থাকি থমাস সোয়েলের বক্তব্য, ‘দ্য কনস্টিটিউশন ক্যান নট প্রোটেক্ট আস আনলেস উই প্রোটেক্ট দ্য কনস্টিটিউশন।’

আব্রাহাম লিংকন একবার বলেছিলেন, ‘ইফ ইউ ওয়ান্ট টু টেস্ট ম্যানস ক্যারেক্টার, গিভ হিম পাওয়ার।’ জনগণের শক্তি–সামর্থ্যে আস্থা ছিল বঙ্গবন্ধুর।  সংবিধানের ৭ (১) অনুচ্ছেদ জনগণের সেই শক্তির কথাই ঘোষণা করে, ‘ প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।’

বঙ্গবন্ধু ’৭২-এর সংবিধান রচনার দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন তখনকার চৌকস সংসদ সদস্য ও আইনবেত্তাদের। তাঁরা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সংবিধানগুলো পাঠ-অধ্যয়ন করেছেন। বিবেচনায় ছিল এসব সংবিধানের দুর্বলতা আর ভালো দিকগুলো। সংবিধান প্রণয়নের সুবর্ণজয়ন্তীতে ৪ নভেম্বরকে ‘জাতীয় সংবিধান দিবস’ হিসেবে ঘোষণা আওয়ামী লীগ সরকারের একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। কিন্তু আক্ষেপ, এই বোধোদয় ঘটতে সময় পার করতে হয়েছে ৫০ বছর। সংবিধানের সুবর্ণজয়ন্তীতে স্বীকৃতি পেয়েছে সংবিধান দিবস। গণপরিষদে সংবিধানের ওপর বক্তব্য দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘এই সংবিধান শহীদের রক্তে লিখিত, এ সংবিধান সমগ্র জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবে।’

বাংলাদেশের সংবিধান কেবল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইনই নয়; সংবিধানে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের মূল চরিত্র বর্ণিত রয়েছে। সংবিধানে বর্ণিত আছে দেশ পরিচালনার চারটি মূলনীতি। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে নেওয়া হয়। এতে বলা আছে, বাংলাদেশ হবে প্রজাতান্ত্রিক, গণতন্ত্র হবে এ দেশের প্রশাসনিক ভিত্তি, জনগণ হবে সব ক্ষমতার উৎস এবং বিচার বিভাগ হবে স্বাধীন।

বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রসিডিওরাল ও সাবস্ট্যান্টিভ আইনের উৎস মূলত ব্রিটিশ আইন। বাংলাদেশের ফৌজদারি এবং দেওয়ানি আইন সর্বজনীন ও সেক্যুলার চরিত্রের। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা মূলত দণ্ডবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি ও দেওয়ানি কার্যবিধি দিয়ে পরিচালনা করা হয়। রাষ্ট্রীয় আইনে ধর্মের কোনো প্রভাব নেই। আদালত ব্যবস্থাও সর্বজনীন, এখানে বিচারে ধর্মের ভিত্তিতে আদালতের কোনো বিভাজন নেই(পারিবারিক আইন, সম্পত্তির অধিকার সংশ্লিষ্ট আইন ব্যতীত)। বরং বাংলাদেশের সংবিধান আইনের দৃষ্টিতে সবাইকে সমানভাবে দেখে। সাংবিধানিকভাবে আইনের দৃষ্টিতে সবার সমতা নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’

সংবিধান নিয়ে আলোচনা শুধু সংসদ আর আদালতেই করা হবে, এ দস্তুর নয়। আমরা মনে করি, সংবিধান জনগণের জন্য, তাদের অধিকারের আদি রক্ষাকবচ এই সংবিধান। সে কারণে এই সংবিধান আমাদের সবার বুঝতে হবে। সংবিধান জনজীবনে এর উপস্থিতি জানান দেয় আইনের মাধ্যমে। আমাদের আক্ষেপ, এখন সংবিধানের নামে আইন অমান্য করা হচ্ছে । এখন প্রয়োজন সংবিধানের নিয়মিত চর্চা, যাতে এটি জনচৈতন্যের অংশ হয়ে ওঠে।

  • এম এম খালেকুজ্জামান আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
    ইমেইল: [email protected]