২০১৯ সালে নির্বাচনী প্রচারণাকালে কর্ণাটকে দেওয়া একটি বক্তব্যের জেরে গুজরাটের একজন এমএলএর করা মানহানির মামলায় আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় লোকসভায় সদস্য পদ হারিয়েছেন রাহুল গান্ধী। তিনটি প্রেক্ষাপট থেকে রাজনৈতিক এ ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ। আইন, রাজনীতি এবং ভারতীয় গণতন্ত্রের বৃহত্তর প্রেক্ষাপট থেকে এ ঘটনা কী অর্থ দাঁড় করাচ্ছে।
আইনি প্রেক্ষাপট
রাহুল গান্ধীর সমর্থকেরা বলছেন, এ ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আইনের বিকৃতি সাধন করা হয়েছে। আর সেই আইনটি হলো একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে প্রতারণা, দুর্নীতি অথবা সহিংস অপরাধের মতো গুরুতর অপরাধের কারণে অপসারণ করা সংক্রান্ত। রাহুল গান্ধীর মামলাটি, গণপ্রতিনিধিত্ব আইনের ৮(৩) ধারায় কোনো জনপ্রতিনিধির সদস্য পদ হারানোর যে কারণ উল্লেখ রয়েছে, তার খুব কমই পূরণ করে। এটা নিশ্চিতভাবেই সন্দেহের জন্ম দেয়, কেননা আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী একটা অক্ষরও ভঙ্গ হয়নি।
এমনকি মামলাটিই একটি প্রশ্নবিদ্ধ মামলা। আইনবিশারদ গৌতম ভাটিয়া যেমনটা তাঁর টুইটে উল্লেখ করেছেন, ‘এ ধরনের মামলা ততক্ষণ পর্যন্ত খাটবে না, যতক্ষণ বাদীকে উদ্দেশ্য করে সরাসরি কিছু বলা না হবে।’ যে বক্তব্যের জন্য রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, সেখানে তিনি মামলার বাদী গুজরাটের বিজেপিদলীয় এমএলএ ও সাবেক মন্ত্রী পূর্ণেশ মোদিকে নিয়ে সরাসরি কিছু বলেননি।
উল্লেখ্য, এ মামলার রায়, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যে অবমাননার বক্তব্য দেন এবং পুরো সম্প্রদায়ের উদ্দেশে হিংসাত্মক বক্তব্য দেন, সেসব ক্ষেত্রে নতুন দরজা খুলে দিল।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
এ রায় ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে রাহুল গান্ধীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ বন্ধ করে দিল। কেবল তার শূন্য আসন পূর্ণ হওয়ার আগে উচ্চ আদালত যদি সিদ্ধান্তটি বাতিল করে অথবা আগের সাজা যদি কমিয়ে দেয়, তাহলে তিনি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। যদিও এ মামলায় তিনি কারাগারে না গেলে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেওয়া থেকে রাহুল গান্ধীকে বিরত রাখা যাবে না। আবার রাহুল গান্ধীকে যদি কারাগারে পাঠানো হয়, তাহলে বিরোধীদের শিবিরে তিনি আরও শক্তিশালী ভাবমূর্তি হয়ে উঠবেন।
রাহুল গান্ধীকে অব্যাহতভাবে চাপের মধ্যে রেখে বিজেপি মূলত বিরোধী শিবিরের প্রধান নেতৃত্ব থেকে তাঁকে সরাতে চাইছে। রাহুল গান্ধীকে একজন উপহাসের পাত্র হিসেবে চিত্রিত করতে চায় বিজেপি। তাঁকে একজন অদক্ষ নেতা হিসেবেও মূর্ত করতে চায় বিজেপি। ভারতের শাসক দল বলে আসছে, তারা ভারতের রাজনীতিতে সুবিধাভোগী ও পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে যেকোনো সমালোচনা গোটা ভারতের বিরুদ্ধে সমালোচনা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। চার দশক আগে একই রাজনৈতিক অস্ত্র ইন্দিরা গান্ধী তাঁর বিরোধীদের গুঁড়িয়ে দিতে ব্যবহার করেছিলেন। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো রাজনৈতিক এই অস্ত্র এমন একটি দল এখন ব্যবহার করছে, যারা অতীতে এই অস্ত্রের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। ভিন্নমতের প্রতি এই অসহিষ্ণুতার কারণ কী? ভারতে গত কয়েক দশকে ক্ষমতার রাজনীতিতে অতি ব্যক্তিনির্ভরতা বাড়তে দেখছি। সেটা রাজ্য পর্যায়ে যেমন, একইভাবে কেন্দ্র পর্যায়েও।
সম্প্রতি রাহুল গান্ধী বিদেশে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটাকে বিজেপি দেশদ্রোহী বক্তব্য বলে সমালোচনায় নেমেছে। অন্যদিকে যাঁরা বিকল্প খুঁজছেন, তাঁদের মধ্যে যেন রাহুল গান্ধীর গ্রহণযোগ্যতা না বাড়ে, বিজেপি সেই প্রচেষ্টাও করে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে, ভারত জোড়ো আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলেছেন রাহুল। এ কর্মসূচির মাধ্যমে রাহুল দেখিয়েছেন যে বিজেপি সরকারের প্রকৃত বিরোধী দল লোকসভায় নয়, ভারতজুড়ে রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জনগণের থেকে অনেক দূরে মঞ্চ থেকে বক্তব্য দেন কিংবা জনগণের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে শোভাযাত্রা করেন। নরেন্দ্র মোদির চেয়ে পুরোপুরি ভিন্ন উপায়ে জনগণের সঙ্গে হেঁটে তাঁদের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তোলার দক্ষতা দেখিয়েছেন রাহুল গান্ধী। এ কর্মসূচি গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করেছে।
১০ বছর আগে রাহুল গান্ধী নিজেই যে আইন প্রয়োগের জন্য জোরাজুরি করেছিলেন, সেই আইনেই বিজেপি সরকার আজ তাঁকে নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে প্রধান বিরোধী নেতার মর্যাদায় বসালেন। এ ঘটনা বিজেপির পক্ষে যাবে নাকি তাদের জন্য আত্মঘাতী হবে, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। কিন্তু এ পর্বে এসে বিরোধী দলগুলোর নেতারা নিশ্চিত করেই বড় একটা ঝাঁকুনি খেলেন। একসঙ্গে সামনে এগোতে ও আগামী নির্বাচনে একসঙ্গে লড়তে এ ঘটনা তাঁদের নিশ্চিতভাবেই শক্তি দেবে।
গণতন্ত্রের ওপর হামলা
নির্বাচনের কৌশল ও সমীকরণ কী হবে, তার চেয়েও এ ঘটনার বৃহৎ পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে। যে বক্তব্য দেওয়ার জন্য রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে মানহানির অভিযোগে ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে, সেখানে তিনি পুরো সম্প্রদায়কে অবজ্ঞা করে বক্তব্য দেননি, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সহযোগী হিসেবে পরিচিত এমন কিছু ব্যবসায়ীকে নিন্দা করেছেন, যাঁদের নামের শেষে একই পদবি রয়েছে।
সাম্প্রতিক আদানি–কাণ্ড থেকে এটা স্পষ্ট যে স্বজনতোষণবাদ ও পক্ষপাতিত্ববাদের মতো অভিযোগ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য দুর্বল এক জায়গা। এ অভিযাগগুলো পার্লামেন্টের ভেতরে ও বাইরে যাঁরা উত্থাপন করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তেমনটা নয়, কিন্তু এ সমালোচনা করার জন্য তাঁদের আক্রমণ করা হচ্ছে।
ভারতে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের সমালোচনার ক্ষেত্রে অসহিষ্ণুতা বাড়ছেই। ভিন্নমতকে লক্ষ্যবস্তু করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও আইনের অপব্যবহারের ঘটনা বেড়ে চলেছে। মাত্র কয়েক দিন আগে দিল্লিতে কয়েকজন নাগরিক আগামী নির্বাচনে বিজেপি ও প্রধানমন্ত্রীকে পরাজিত করার আহ্বান জানিয়ে পোস্টার সাঁটানোয় তাঁদের বিরুদ্ধে কয়েক ডজন অভিযোগ করা হয়।
এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে যেকোনো সমালোচনা গোটা ভারতের বিরুদ্ধে সমালোচনা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। চার দশক আগে একই রাজনৈতিক অস্ত্র ইন্দিরা গান্ধী তাঁর বিরোধীদের গুঁড়িয়ে দিতে ব্যবহার করেছিলেন। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো রাজনৈতিক এই অস্ত্র এমন একটি দল এখন ব্যবহার করছে, যারা অতীতে এই অস্ত্রের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। ভিন্নমতের প্রতি এই অসহিষ্ণুতার কারণ কী? ভারতে গত কয়েক দশকে ক্ষমতার রাজনীতিতে অতি ব্যক্তিনির্ভরতা বাড়তে দেখছি। সেটা রাজ্য পর্যায়ে যেমন, একইভাবে কেন্দ্র পর্যায়েও।
জায়েলস ভার্নিয়ার্স ভারতের অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক এবং ত্রিবেদী সেন্টার ফর পলিটিক্যাল ডেটার পরিচালক
দ্য ওয়্যার থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত