বিএনপি ধারাবাহিকভাবে ৯টি বিভাগীয় সমাবেশ করেছে। বিএনপির দিক থেকে দেখলে এসব সমাবেশ সফল হয়েছে। পরোক্ষ অনেক বাধা উপেক্ষা করে তাদের নেতা-কর্মীরা সেখানে হাজির হয়েছিলেন। আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ‘শোডাউন’ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই বিএনপি মনে করছে, রাজনৈতিকভাবে তারা যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগকেও তাই পাল্টা শোডাউনের উদ্যোগ নিতে হয়েছে। যশোর ও চট্টগ্রামে তারা দেখিয়ে দিয়েছে, লোকসমাগম করতে তারাও কতটা পারদর্শী।
তবে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সমাবেশ, সেখানে লোকসমাগম ও এর সফলতাকে একভাবে দেখার সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগ শুধু ক্ষমতাসীন দল নয়, ১৩ বছরের বেশি সময় ধরে তারা বাংলাদেশে নিজেদের একচ্ছত্র রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে গেছে। এই চেষ্টায় তারা সফলও হয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর তারা নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। আওয়ামী লীগকে জনসভার স্থান বা এর অনুমতি নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি, নিরাপত্তার কথা ভাবতে হয়নি, ২৬ শর্ত পালনের বাধ্যবাধকতা নিয়েও দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়নি। এমন একটি দলের সফল জনসমাবেশকে তাই বিএনপির সমাবেশের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না।
বিএনপি এখন কী করবে? তারা বলছে, জনসভার বিকল্প জায়গা না দিলে পল্টন এলাকায় থাকবে তারা। ‘পল্টন এলাকায় থাকার’ অর্থ কী? শুধুই অবস্থান নেওয়া? নাকি সরকারের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই সেখানে জনসভা আয়োজনের চেষ্টা করা? সরকার তো তাদের সেখানে জমায়েত হতে বা জনসভা করতে দেবে বলে মনে হয় না। বিএনপি কি তা জোর করে করতে চাইবে?
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রবল প্রতাপ ও একতরফা শাসনে কোণঠাসা বিএনপি গত ১৩ বছরে সেই অর্থে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিই পালন করতে পারেনি। সরকারের দমন-পীড়ন ও মামলায় বিপর্যস্ত বিএনপি মাথা তুলে দাঁড়ানোর সুযোগ পায়নি। আওয়ামী লীগের কৌশলের কাছে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি বারবার ধরা খেয়েছে। সেই বিএনপির জনসমাবেশে লোকসমাগম তাই দলটিকে আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে। তবে আগের এক লেখায় যা লিখেছিলাম, তা নতুন পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। লিখেছিলাম, আওয়ামী লীগ তার দীর্ঘদিনের কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসার কারণেই বিএনপি সমাবেশগুলো করতে পারছে। এ-ও লিখেছিলাম, তার মানে আওয়ামী লীগ ‘ভালো’ হয়ে গেছে এমন নয়, দেশি-বিদেশি নানা চাপে পড়েই বিএনপিকে ছাড় দিচ্ছে। (আওয়ামী লীগ ‘ভালো’ হয়ে গেল, নাকি চাপে পড়েছে? প্রথম আলো, ৩ নভেম্বর ২০২২)
বিএনপির ৯টি সফল সমাবেশের পর এই ধারাবাহিক কর্মসূচির শেষটি হওয়ার কথা ১০ ডিসেম্বর ঢাকায়। অনেকেরই আশঙ্কা ছিল, এই সমাবেশ নিয়ে উত্তেজনা তৈরি হবে। বাস্তবেও তা-ই হচ্ছে। বিএনপি যেখানে (নয়াপল্টনে দলের কার্যালয়ের সামনে) সমাবেশ করতে চায়, সেখানে সেখানে সরকার বা পুলিশ অনুমতি দেয়নি। তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ অনুষ্ঠানের অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু সেখানে কর্মসূচি পালন করতে চায় না বিএনপি। দলটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু ১০ ডিসেম্বর দুপুরে যে সমাবেশ হওয়ার কথা, তা কোথায় হবে, সেটা ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়ও ঠিক হয়নি। প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে, বিএনপির সমাবেশ ‘সফল’ হতে দেবে না সরকার।
বোঝা যাচ্ছে, আগের ৯টি সমাবেশের ক্ষেত্রে বিএনপিকে যে ‘ছাড়’ দিয়েছে সরকার, এই সমাবেশের ক্ষেত্রে তা দিতে চায় না। কিন্তু কেন? এই সমাবেশ আওয়ামী লীগের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল হয়ে উঠল কেন? আরও প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপির সমাবেশ ‘সফল’ হতে না দেওয়ার অর্থ কী? জনসভা করতে না দেওয়া? সরকার যদি চায়, তাহলে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে অনেক কিছুই করতে পারবে। আমরা দেখছি, ১০ ডিসেম্বর সামনে রেখে বিএনপি নেতাদের পুরোনো মামলাগুলো পুনরুজ্জীবিত হতে শুরু করেছে। কারও কারও বিরুদ্ধে হঠাৎ গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি হচ্ছে।
পুলিশের বিশেষ অভিযান চলছে এবং এরই মধ্যে কয়েক হাজার লোক গ্রেপ্তার হয়েছে। বিএনপির দাবি, জনসভার আগে এই বিশেষ অভিযানের নামে নেতা-কর্মীদের আটক করা হচ্ছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের পাশাপাশি সরকারের আছে নিজ দল আওয়ামী লীগ ও তাদের অসংখ্য অঙ্গসংগঠন। সরকারবিরোধী যেকোনো আন্দোলন দমন করতে তারা কতটা কার্যকর ও পারদর্শী, সেই প্রমাণ তারা ১৩ বছর ধরে রেখে চলেছে। সরকার চাইলে বিএনপিকে সমাবেশ করতে না-ও দিতে পারে।
যদি শেষ পর্যন্ত তা-ই হয়, তবে এর অর্থ দাঁড়াবে, বিএনপির সভা-সমাবেশের ব্যাপারে সরকার তার আগের অবস্থানে ফিরে যাচ্ছে। বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের জনসমাবেশকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের এই অবস্থানের দুটি ব্যাখ্যা হতে পারে; এক. ৯টি বিভাগীয় সমাবেশ করে বিএনপি যে আত্মবিশ্বাস বা অতি-আত্মবিশ্বাস (১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়, অথবা ১০ ডিসেম্বর থেকে সরকার পতনের আন্দোলন শুরু) অর্জন করেছে, তা ভেঙে দেওয়া। দুই. সরকার সত্যিই বিএনপির সমাবেশ ও দলটির শক্তিকে ভয় পাচ্ছে অথবা কোনো অঘটনের আশঙ্কা করছে।
বিএনপি এখন কী করবে? তারা বলছে, জনসভার বিকল্প জায়গা না দিলে পল্টন এলাকায় থাকবে তারা। ‘পল্টন এলাকায় থাকার’ অর্থ কী? শুধুই অবস্থান নেওয়া? নাকি সরকারের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই সেখানে জনসভা আয়োজনের চেষ্টা করা? সরকার তো তাদের সেখানে জমায়েত হতে বা জনসভা করতে দেবে বলে মনে হয় না। বিএনপি কি তা জোর করে করতে চাইবে?
এর স্বাভাবিক পরিণতি যা হতে পারে, তা ভেবে ১০ ডিসেম্বর নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক। ইমেইল: [email protected]