অভিযোগ করা হলো আমাদের স্বভাব। আমাদের কিছুই ভালো লাগে না। ভালো হলে বলি, ভালো, তবে আরেকটু ভালো হলে আরেকটু ভালো হতো! তা তো বটেই। আরও ভালো হলে যে আরও ভালো হতো, সে সত্য তো এই বাক্যের মধ্যেই নিহিত। ফেসবুকে দেখলাম, এক নার্সারি গ্রুপের বাচ্চা, পাঁচ সাবজেক্টের চারটায় পেয়েছে ১০০-তে ১০০, একটায় ৯৯। শিক্ষক মন্তব্যের ঘরে লিখেছেন, আরও ভালো করতে হবে। জানি না, বাচ্চা ৫টাতেই এক শতে ১০০ করে ৫০০ পেলে শিক্ষক কী লিখতেন, আরও ভালো করো, ১০০-তে ১১০ নয় কেন?
তো, ডিসেম্বরের মধ্যভাগে যখন পৌষ মাস এসে গেল, ঋতু হিসেবে এসে গেল শীত, তখন ঢাকাবাসীর অভিযোগ ভীষণ, আক্ষেপ তীব্র শীত পড়ে না কেন! শীতের রঙিন কাপড়চোপড়, কোট কিংবা কার্ডিগান, পশমি শাল কিংবা শাড়ি কবে বের করব, কবে পরব? শীতের দিনে শীত পড়বে না, এ কেমন কথা? সব গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের দোষ! কথাতে যে সত্যতা নেই, তা নয়। শীতকালে শীত পড়বে, বসন্তকালে বইবে দখিনা বাতাস, ডেকে উঠবে কোকিল; হেমন্তে ধানকাটা হয়ে গেলে খড়কুটো উড়বে, কিন্তু ঘাসের ডগায় জমবে শিশির, বর্ষাকালে বৃষ্টি হবে—এই তো চিরকাল ঘটে এসেছে এই বাংলায়। কিন্তু বর্তমানকাল তো আর চিরকালের মধ্যে পড়ছে না, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর যুগ এসে যাওয়ার পর পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েছে, আবহাওয়া উল্টোপাল্টা আচরণ শুরু করেছে, জলবায়ু যাচ্ছে বদলে। সাগরের পানি ফুলছে, পাহাড়ের তুষার গলছে, বাংলাদেশের এক–তৃতীয়াংশ বছর চল্লিশেক পর থাকবে পানির নিচে। কাজেই আমরা চাইবই শীতকালে শীত পড়ুক।
তো কয়দিন ধরে শীত পড়তে শুরু করেছে। অমনি আমরা অভিযোগ করতে শুরু করেছি, এত শীত কেন! শীতের সঙ্গে এই বায়ুদূষণের দেশে শুরু হয়েছে কুয়াশা, ধূলি আর ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে তা হয়ে উঠেছে ধোঁয়াশা। কোনো কিছুই আর দেখা যাচ্ছে না। উড়োজাহাজ উড়তে পারছে না সময়মতো, ফেরিঘাটে আটকে আছে ফেরি, মহাসড়কে গাড়িগুলো চলছে পিঁপড়ার গতিতে, ১০ হাত দূরে কী আছে দেখা যাচ্ছে না বলে।
কোনো একটা শক্তিশালী দেশ নেই, যাদের পররাষ্ট্রনীতি আর কূটনৈতিক প্রকল্প মানবজাতির স্বার্থে প্রণীত এবং প্রযুক্ত, সবারই সব নীতির মূলে থাকে তাদের নিজেদের স্বার্থ, নিজের দেশের স্বার্থ, নিজের পার্টির স্বার্থ, নিজের শ্রেণির স্বার্থ এবং সর্বোপরি শাসক এবং ক্ষমতাবানদের নিজেদের স্বার্থ। তৃতীয় বিশ্বের দেশকে ওরা গণতন্ত্র শেখায়, মিয়ানমার কিংবা সৌদি আরবের সঙ্গে স্বার্থের সম্পর্কের জন্য গণতন্ত্র মানবাধিকার শর্ত হয়ে দাঁড়ায় না।
এরই মধ্যে প্রথম আলোর খবর, সামনের সপ্তাহে আসছে শৈত্যপ্রবাহ। আমরা পূর্ব বাংলার মানুষ, সত্য উচ্চারণ করে থাকি সইত্য, কাজেই কেউ যখন বলে শৈত্যপ্রবাহ আসছে, আমরা শুনি সইত্যপ্রবাহ আসছে, আমাদের পিলে চমকে ওঠে! সেকি! সত্যপ্রবাহ আসছে নাকি! এখন থেকে মিথ্যার প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাবে, বইতে থাকবে সত্যের সুবাতাস!
সুবাতাস! আহ! পেটটা ছোট করে বুকটা ভরে নাকটা টেনে একটা বড় শ্বাস নেওয়ার পর হুঁশ হয়, সত্যের প্রবাহ আমাদের সইবে তো!
তখন আমরা ‘বস, আপনার আজকের গোলাপি কোটটা আপনাকে যা মানিয়েছে না’ বলার বদলে কি বলে ফেলব, ‘স্যার, এইটা কী পরছেন, এই রকম একটা ক্যাটক্যাটা রং মাইনষে পরে!’ ‘যা রান্না হয়েছে না, বহুদিন পর তৃপ্তি ভরে খেলাম’ না বলে কি আমরা বলতে থাকব, ‘আপনার চেষ্টাটা মহৎ, কিন্তু ফল সুবিধার না, ডালে লবণ বেশি, মাছ সেদ্ধ হয়নি, কাঁচা মাছের গন্ধে পেট উগড়ে আসছে, এরপর মানুষকে ডেকে খাওয়াতে হলে রান্নাটা অন্তত ভালো কাউকে দিয়ে করাবেন!’ ‘যা খুশি হয়েছি, আপনার ছেলের রেজাল্টে পাড়ার সবার মুখ উজ্জ্বল হয়েছে’ না বলে কি মুখের ওপর বলে ফেলব, ‘ভালো রেজাল্টের কোনো দাম নাই, ওই যে কাশেম সাহেবের ছেলে অনার্স–মাস্টার্স ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট, এখন দুদকের মামলায় কাশেমপুর জেলে আছে। আপনারটাও ওই রকমই একটা কিছু করবে!’
এ রকমটা হলে সে তো বড় একটা ভ্যারাচ্যারা লেগে যাবে, ওলটপালট, ধুন্ধুমার। তখন কি আমাদের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বলে ফেলবে, গতকাল অমুক আসনের নির্বাচনে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার দরকার পড়েনি, কেন্দ্র দখল করে সকাল নয়টার মধ্যে সব ব্যালট ছিঁড়ে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা হয়েছে।
পৃথিবীটা ন্যায়ভিত্তিক নয়। ১০ ভাগ লোকের হাতে ৯০ ভাগ সম্পদ। আমেরিকানরা সারা পৃথিবীকে মানবাধিকার শেখায়; কিন্তু ইরাকে হামলার জন্য তাদের অজুহাতটা থাকে আগাগোড়া মিথ্যা, ডব্লুএমডি (উইপন অব মাস ডেস্ট্রাকশন) না থাকা সত্ত্বেও এটা কেন আছে বলে তারা ইরাক আক্রমণ করে বসে, এবং সাদ্দামকে হত্যা করার জন্য কোনো আইন লাগে না, লাদেনকে হত্যা করে মিথ্যা কথা প্রচার করে ওবামা প্রশাসন। কোনো একটা শক্তিশালী দেশ নেই, যাদের পররাষ্ট্রনীতি আর কূটনৈতিক প্রকল্প মানবজাতির স্বার্থে প্রণীত এবং প্রযুক্ত, সবারই সব নীতির মূলে থাকে তাদের নিজেদের স্বার্থ, নিজের দেশের স্বার্থ, নিজের পার্টির স্বার্থ, নিজের শ্রেণির স্বার্থ এবং সর্বোপরি শাসক এবং ক্ষমতাবানদের নিজেদের স্বার্থ। তৃতীয় বিশ্বের দেশকে ওরা গণতন্ত্র শেখায়, মিয়ানমার কিংবা সৌদি আরবের সঙ্গে স্বার্থের সম্পর্কের জন্য গণতন্ত্র মানবাধিকার শর্ত হয়ে দাঁড়ায় না।
সত্যপ্রবাহ এলে আমরা তা সইতে পারব না। ঠিকানাবিহীন কোম্পানি হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে তুলে চম্পট দেয়, শতকোটি টাকার সার লোপাট করে দিয়েও সরকারের কাছ থেকে টাকা পাওয়া যায়, সাজা পাওয়া যায় না; ১০০ টাকার বালিশ কেনা হয় কয়েক হাজার টাকায়, আর তা দোতলায় তুলতে বালিশপ্রতি খরচ ধরা হয়; কাজ না করে বিল তুলে নেওয়া হয়; এসব খবরের প্রবাহ যদি দেশে কিংবা বিদেশে প্রচার শুরু হয়ে যায়, তা কি আমরা নিতে পারব, সইতে পারব, বইতে পারব, তার প্রতিক্রিয়ার কথা কি কইতে পারব?
তার বদলে এই ভালো, সত্যপ্রবাহ নয়, শৈত্যপ্রবাহ আসুক। সত্যপ্রবাহ দূরে সরে যাক। আমার যেমন বেণি তেমনি থাকুক। সত্যের পানি এসে আমাদের চুল ভিজিয়ে দিক, তা আমাদের সইবে না। আমরা আত্মপ্রবঞ্চনা করে আত্মপ্রবোধ দিয়ে যাব। এই তো বেশ ভালো আছি।
শীতকালে অবশেষে শীত এসেছে। বেশ রসের পিঠা খাচ্ছি। হলুদ রঙের সোয়েটার লাল রঙের জ্যাকেট পরছি। শীতের মধ্যেও দামি সংক্ষিপ্ত কালো পোশাক পরে কালো মার্সিডিজ থেকে নেমে গটগট করে ক্লাবের বড় দরজা পেরিয়ে ভেতরে অদৃশ্য হতে পারছি।
শৈত্যপ্রবাহকে স্বাগত; সত্যপ্রবাহ, খবরদার, আসবার চেষ্টাই কোরো না।
আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক