বোদ্ধা পাঠক মাত্রই বুঝে গেছেন যে শিরোনামটি সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা থেকে নেওয়া। ‘জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বাড়ায় ঢাহুক...মানুষ বেকুব চুপ/হাটবারে সকলে দেখুক, কেমুন মোচড় দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর’। অর্থাৎ কোনো এক জাদুকর কোনো এক হাটের মানুষদের মন্ত্রমুগ্ধ করে তাদের ট্যাঁক ফাঁক করে দিচ্ছে এবং সবাই তা হাঁ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। এখনকার নেটদুনিয়ায় ঠিক এই একই ঘটনা এর কোটি গুন মাত্রায় প্রতি দিন প্রতি মুহূর্তে ঘটছে, এবং ওই হাটুরেদের মতো ওই একই ভাবে আমরা তা চুপচাপ বেকুবের মতো দেখে যাচ্ছি। ওই জাদুকর কিংবা একজন নেট ইঞ্জিনিয়ার দুজনই জানেন আমরা কোথাও আমাদের মনযোগ বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারি না। এই দুর্বলতাটাকে কাজে লাগাতে পারলে যেমন জাদুর মোচড় দিয়ে হাটুরেদের টাকা হাতিয়ে নেওয়া যায়, তেমনি লক্ষ কোটি মানুষের সামনে তথ্য-উপাত্তের মুলো ঝুলিয়ে তাদের কোটি কোটি ডলারের ‘মনযোগ’ দখলে নেওয়া যায়।
অলডাস হাক্সলি তাঁর ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড রিভিজিটেড’-এ বলেছেন মানুষের অমনোযোগী হওয়ার ক্ষমতা অসীম। এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হয় বলে সে সহজেই পরাধীন হয়ে যায়। তবে নিজের মনযোগ ধরে রাখতে না পারলেও অন্যের মনযোগ পাওয়ার ব্যাপারে তার আগ্রহের কমতি নেই। তার জীবনে যত সামান্য ঘটনাই ঘটুক কিংবা না ঘটুক সেটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবাইকে না জানালে চলে না। শুধু তাই নয়, কেও সেখানে লাইক-কমেন্ট দিল কি-না সেটাও তৎক্ষণাৎ দেখার সুযোগ না পেলে মন উচাটন হয়ে ওঠে।
প্রযুক্তি তার গতিতে এগিয়ে যাবেই। বিপদটা হচ্ছে মানুষের এভাবে বেকুবের মতো চুপচাপ প্রযুক্তির দাসে পরিণত হওয়া। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, ও পারিবারিক প্রতিটি পর্যায়ে এখনই এই বিষয়ে আলোচনা শুরু করে সবাইকে সচেতন করতে না পারলে নিশ্চিত ভাবেই দুর্যোগ আসন্ন।
এই যে নিজের মনযোগ হারানো এবং অন্যের মনযোগ আকর্ষণ করার উদগ্র আগ্রহ, এটাই ‘মনযোগের অর্থনীতি’-এর ভিত্তি। মার্কিন বিশেষজ্ঞ মাইকেল গোল্ডহেবার প্রথম ‘মনোযোগের অর্থনীতি’ কথাটি ব্যবহার করেন। বিংশ শতাব্দীর শেষে এসে তথ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলে ‘তথ্য অর্থনীতি’ কথাটা চালু হয়। কিন্তু গোল্ডহেবার বললেন একটি সমাজ তার দুষ্প্রাপ্য সম্পদগুলো কীভাবে ব্যবহার করে সেটাই যেহেতু অর্থনীতির ক্ষেত্র, সেহেতু এর নাম হওয়া উচিত ‘মনযোগের অর্থনীতি’। কারণ তথ্য এখন আর কোনো দুষ্প্রাপ্য বিষয় নয়। এখন সত্যিকারের দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান পণ্য হচ্ছে মানুষের ‘মনযোগ’।
মনযোগ যে একটা দুষ্প্রাপ্য বিষয়ে পরিণত হবে তা ১৯৭১ সালেই মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ও নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ হার্বার্ট সাইমন বলে গিয়েছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল, যদি তথ্য বাড়ে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই, তথ্য পাওয়ার জন্য যা ব্যয় করতে হয় সেই ‘মনযোগ’-এ টান পড়বে। এখন ঠিক তাই হচ্ছে। তথ্যের প্রাচুর্য বেড়ে যাওয়াতে, মনযোগ হয়েছে দুষ্প্রাপ্য। ফলে নেট ইঞ্জিনিয়াররা মানুষের মনযোগ দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। কে মানুষকে কতটা স্ক্রিনে আটকে রাখতে পারেন সেই প্রতিযোগিতা। কেবল মানুষের প্রয়োজনীয় তথ্যের চাহিদা পূরণ করলে খুব বেশি মনযোগ পাওয়া যায় না। বেশি মনযোগ পেতে হলে তার অপ্রয়োজনীয় চাহিদা তৈরি করতে হবে, আর তার অপ্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের জন্য চাই অর্থহীন মজাদার তথ্য। এই অপ্রয়োজনীয় তথ্যের প্রতি আমার অকারণ আগ্রহ তৈরি করে, আমার অকারণ সময় নষ্ট করার জন্য যা দরকার, নেট ইঞ্জিনিয়াররা সেই কৌশল উদ্ভাবন করেন। তারপর আমার মনযোগটা বিজ্ঞাপন দাতাদের কাছে বিক্রি করে দেন। কিন্তু আমাদের মনযোগ দেওয়ার সময়েরও তো একটা সীমা আছে। সেই সীমা অতিক্রম করতে চাইলে আমাদের স্বাস্থ্যের ওপরও আক্রমণ চালাতে হয়। এ কারণেই নেটফ্লিক্সের চিফ এক্সিকিউটিভ রিড হেইস্টিংস ইতিমধ্যেই আমাদের ঘুমের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামার ঘোষণা দিয়েছেন।
যাই হোক, এবার কিছু তথ্য-উপাত্ত দেখা যাক। আমরা দিনে গড়ে যে ১ ঘণ্টা ইউটিউব ব্যবহার করি, তার ৩০% করি আমার প্রয়োজনে, আর বাকি ৭০% সময়টায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাকে যা দেখতে বলে আমি তাই দেখি। তবে সে তো আর জোর করে না। সে আমার পছন্দ-অপছন্দ, আমার ক্লিক প্যাটার্ন, আমার মাউস ধরার ভঙ্গি সব জানে। সে এও জানে যে আমার ইউ টিউবে খুব বেশিক্ষণ থাকার প্রয়োজন নেই, আর প্রয়োজন থাকলেও আমি খুব বেশিক্ষণ আমার মনযোগ ধরে রাখতে পারব না। ফলে আমার কাছ থেকে বেশি মনযোগ পাওয়ার আশায় সে আমার পছন্দের ভিডিওগুলো স্ক্রিনের এক পাশে সাজিয়ে আমাকে প্রলুব্ধ করতে থাকে। একটাতে মনযোগ হারিয়ে ফেলার পরপরই যেন আমাকে আরেকটা দিয়ে টেনে ধরা যায়। আমার একের পর এক ক্লিক করা কিংবা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকাটা আর আমার নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এবং সেই অবসরে আমার ‘মনযোগ’ কোথায় কত চড়া দামে বিক্রি হয়ে যায় আমার কখনো জানা হয় না।
কিন্তু কোম্পানি লাভ করলে আমার ক্ষতি কি? আমার ক্ষতি হচ্ছে এতে আমার মানসিক অবসাদ বৃদ্ধি পায়। আমার ক্ষতি হচ্ছে বাস্তব পৃথিবীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঢিলে হয়ে যায়। আমার ক্ষতি হচ্ছে ভুল তথ্যের ভুলভুলাইয়ার খপ্পরে পড়ে আমি আকাট মূর্খে পরিণত হই। এই বিষয়ে কিছু আমেরিকান তথ্য-উপাত্ত এ রকম। ১৯৯১,২০১৩, ও ২০১৭ সালে যথাক্রমে ১৭ %,২১ %, ও ২৯% মহিলা অবসাদে আক্রান্ত হন। অর্থাৎ প্রথম ১২ বছরে এই অসুখ ৪ %, বাড়লেও পরের ৪ বছরে এটা বেড়েছে ৮ %। অন্যদিকে ৫০% নাগরিক বলেছেন যে মুখোমুখি অন্যদের সঙ্গে বসে এখন আর তেমন কাজের কথা হয় না। একই ভাবে, ১৮% মানুষ এখন আর মুখোমুখি বসে কথা বলার মতো তেমন লোকই পাচ্ছেন না। এদিকে, সত্যি খবরের চাইতে ৬ গুন বেশি গতি সম্পন্ন ফেইক খবরের প্রভাবে বিখ্যাত মার্কিন খেলোয়াড় কাইরি যখন বিশ্বাস করে ফেলেন যে পৃথিবী গোলাকার নয়, চ্যাপ্টা, তখন তাঁর মূর্খতায় হাসি না পেয়ে বরং শঙ্কা জাগে।
প্রযুক্তি তার গতিতে এগিয়ে যাবেই। বিপদটা হচ্ছে মানুষের এভাবে বেকুবের মতো চুপচাপ প্রযুক্তির দাসে পরিণত হওয়া। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, ও পারিবারিক প্রতিটি পর্যায়ে এখনই এই বিষয়ে আলোচনা শুরু করে সবাইকে সচেতন করতে না পারলে নিশ্চিত ভাবেই দুর্যোগ আসন্ন।
সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক