বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) জরিপমতে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ধার করে চলছে ৭৪ শতাংশ নিম্ন আয়ের পরিবার। ছয় মাসের ব্যবধানে ৯৬ শতাংশ পরিবার মাংস, ৮৮ শতাংশ পরিবার মাছ কম খাচ্ছেন। ১ হাজার ৬০০ পরিবারের ওপর করা জরিপটি বলছে, শুধু মাছ-মাংস নয়, ৭৭ শতাংশ পরিবার ডিম এবং ৮১ শতাংশ পরিবার ভোজ্যতেল খাওয়া কমিয়েছে, প্রায় ৪৬ শতাংশ পরিবার ডাল, ৫৭ শতাংশ পরিবার আটা এবং ৩৭ শতাংশ পরিবার ভাত খাচ্ছে কম। প্রাণিজ আমিষের ঘাটতিতে অনেক পরিবার খাবারের গুণগত মানেও ছাড় দিচ্ছে। সারা দিন উপোস করেছেন, এমন দরিদ্র মানুষের হার ১৮ শতাংশ, ছয় মাস আগে যা ছিল প্রায় ১০ শতাংশ।
এত উন্নয়নের মধ্যে খাদ্য ও পুষ্টির এই উদ্বেগজনক চিত্র কেন—এর ব্যাখ্যা সরকারকে পলিসিগতভাবে খুঁজতে হবে। খরচের চাপে খাদ্যাভ্যাস বদলের মানে হচ্ছে অর্থের অভাবে মানুষ কম ক্যালরি ও কম পুষ্টির নিম্নমান খাবারে ঝুঁকছে। খাদ্য ও পুষ্টির এই ভয়াবহতা দেশে নতুন দারিদ্র্য তৈরি করবে, পুষ্টিহীন, রোগপ্রতিরোধহীন কিংবা খর্বাকৃতি শিশুর সংখ্যাও বাড়াবে। তাদের শারীরিক গঠন ও মেধার বিকাশে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।
আধুনিক সময়ে, ভাত, গমের একমুখী সূচকে দারিদ্র্য মাপা হয় না। খাদ্যপুষ্টি, অসুখ-বিসুখ থেকে শুরু করে শিক্ষা, আবাসন সবকিছুকেই এখন বিবেচনায় নেওয়া হয়। ফলে বাধ্যতামূলক খরচের খাত এখন বিস্তৃত। খাদ্য ব্যয়, স্বাস্থ্য ব্যয়, জ্বালানি ব্যয়, জলবায়ুজনিত ব্যয়ে, শিক্ষা ও আবাসন ব্যয়ে মানুষ গরিব হচ্ছে। দারিদ্র্য এখন বহুমুখী।
ফলে জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপি, খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও-সহ জাতিসংঘের সব সংস্থা, সব সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাই দারিদ্র্যের সূচক ‘মাল্টি ডাইমেনশনাল পভার্টি’র কয়েক ডজন উপসূচকের গড় করে প্রকাশ করে। করোনার পরে দেশের দারিদ্র্য ও অতিদারিদ্র্য যখন ৩২-৩৫ শতাংশের কোটায় (করোনার আগে দারিদ্র্য ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমেছিল), বর্তমানে যেকোনো হিসেবেই দারিদ্র্য প্রতি তিনজনে একজন। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে সরকারের নীতিতে এসব পরিসংখ্যানের কোনো বাস্তব প্রতিফলন নেই।
সরকার আইএমএফ-কে খুশি করতে আর জ্বালানিতে ভর্তুকি দেবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ বাংলাদেশে জ্বালানি ভর্তুকিতে বিশ্বের ৪০তম দেশ, এমনকি যুক্তরাজ্য, জার্মানি, নেদারল্যান্ডসও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরে জ্বালানি ভর্তুকি দিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যে দেশে ৩২-৩৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে, যেখানে ক্রয়ক্ষমতার বৈষম্য এবং সম্পদ পিরামিডের ধনী-গরিবের ব্যাপক ব্যবধান, সেখানে কীভাবে দরকারি ভর্তুকি উঠিয়ে দিয়ে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তোলে?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের সূচকে (এমপিআই) জুন ২০২১ প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশের ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার। এ সংখ্যা ৬ কোটি ৫১ লাখ। বেসরকারি সংস্থার জরিপে করোনার পরে নতুন তৈরি হওয়া দরিদ্রের সংখ্যাকে ন্যূনতম দেড় কোটি থেকে সোয়া দুই কোটি বলা হয়েছে। অর্থাৎ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের সূচকে নতুন দারিদ্র্য ৪০ শতাংশের বেশি হবে। আশ্চর্যের বিষয় যে খারাপ পরিসংখ্যান বেরিয়ে পড়ার ভয়ে দৈনিক ১৮০০ ক্যালরির কম খাদ্য গ্রহণকারী জনসংখ্যা নির্ণয়ের জন্য উচ্চমান জরিপ করছে না সরকার। প্রায় ৮ কোটি দরিদ্র জনগোষ্ঠী নিয়ে পলিসি রিভিউ না করার এই নীতি পশ্চাৎপদ।
দেশের গরিব মানুষের মোট ক্যালরির প্রায় ৬৪ শতাংশ ভাত থেকে আসে। এক বছরে চালের দাম বেড়েছে ৪১ শতাংশ, গমের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৭১ শতাংশ। সানেম জরিপমতে, এ সময় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের মজুরি কিংবা দিনমজুরের আয় বাড়েনি, বরং গড় খরচ ১৩ শতাংশ বেড়েছে। যে দিনমজুরেরা ভাতের জোগান দিতে পারছেন না, তাঁরা আমিষ, পুষ্টিকর খাবার এবং ওষুধের জোগান করবেন কোত্থেকে!
বাজারে মোটা চালের কেজি ৪৮-৫০ টাকা, চিকন চাল ৭৫-৮৫ টাকা হলে নিম্ন আয়ের মানুষ কীভাবে জীবনযাপন করবে? সিপিডি দেখিয়েছে, গড় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ২৫ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি এর চেয়ে বেশি। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে জ্বালানি মূল্যস্ফীতি প্রায় ৪৫ শতাংশের বেশি। মূল্যস্ফীতিতে প্রান্তিক ও দরিদ্র মানুষের প্রকৃত আয় যেখানে কমেছে, সেখানে তিনি মাসের পর মাস প্রাণিজ প্রোটিন খেতে পারবেন না—এটাই কঠিন বাস্তবতা।
অতি উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে সরকার যে ১ দশমিক ৯৯ ডলারের পারচেজ পাওয়ার প্যারিটি বা ক্রয়ক্ষমতা ধরে দরিদ্র জনসংখ্যার হিসাব করে, সেটা দুঃখজনক। ভারত দারিদ্র্যরেখা বা পিপিপি ক্রয়ক্ষমতার স্কেল হালনাগাদ করেছে, বাংলাদেশ করছে না। বাজারে জিনিসপত্রের যা দাম, তাতে মূলত ৩ দশমিক ৫০ ডলার বা ৪ ডালার হিসাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বেজ পরিমাপ করা উচিত জনপ্রতিনিধিত্বহীন জবাবদিহিহীন সরকারের আমলা-মন্ত্রীরা এই সংখ্যার পলিসিগত প্রতিফলন আদৌ বোঝেন?
আগে ভাতের অভাব ছিল, পুষ্টির অভাব কম ছিল। ঘরে ঘরে হাঁস-মুরগি ছিল, খালবিলে মাছ ছিল। মাঠঘাটে লতাপাতার সবজি ছিল। এখন এসবের কোনোটাই নেই। ক্ষুদ্রঋণের কিস্তি দিতে ডিম-দুধ বিক্রিতে পুষ্টি গেছে, অধিক জনসংখ্যার বাণিজ্যিক চাষ ও আবাসন চাপে, পরিবেশদূষণে খাদ্যের ফ্রি উৎস—সব গেছে। এমতাবস্থায় সম্পদ পিরামিডের নিচের স্তরের সুবিশাল জনসাধারণের জন্য দরকারি ভর্তুকি আবশ্যক।
ডলার-সংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ সব দৃশ্যমান সমস্যার পরেও বর্তমানে খাদ্যের প্রাপ্যতার সংকট নেই। সংকট হচ্ছে একদল ব্যবসায়ীর ‘বাজারের ওপরে আধিপত্য স্থাপনের’ চেষ্টা। যেখানে শ্রমজীবী নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত উচ্চমূল্যের জরুরি খাবার কিনতে অসমর্থ।
বাটার বান বিস্কুট থেকে শুরু করে পোলট্রি, মাছ এবং মাংসের বাজারের সরবরাহব্যবস্থা মাত্র কয়েকটি গ্রুপের হাতে বন্দী। পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে ‘পোলট্রি খাতে ৫২ দিনে ৯৩৬ কোটি টাকা লুট’ হয়েছে। প্রায় ২০ শতাংশ মূল্যস্ফীতির সময়েও বৃহৎ ব্যবসায়ীরা আমানতে ৬ শতাংশ মুনাফার সিলিং সরাতে চায় না। অর্থাৎ রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান সামান্য কিছু ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে ঋণাত্মক সুদে অতি সস্তায় টাকা তুলে, পুঁজির একতরফা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিজেরা সব ধরনের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, ছোট সাধারণ ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের বের করে দিয়ে।
বহু সাধারণ খামারি, ফ্যাক্টরি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী একদিকে ঋণ না পেয়ে, অন্যদিকে বৃহৎ ব্যবসায়ী তোষণ পলিসিতে পথে বসেছেন। এতে বাজারের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। ব্যবসায়ীরা শস্য মজুত করে রাখেন। বাংলাদেশে মোটা ও চিকন চালের দাম দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেই সর্বোচ্চ, এখানে মূল কারণ শস্য উৎপাদন কম নয়, বরং সিন্ডিকেট।
রেশনের পরিস্থিতি বরং এখন খারাপ হয়েছে, বর্তমানে টিসিবির পণ্য অপ্রতুল।
২০২১-২২ অর্থবছরে টিসিবির ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য বাজেটে টিসিবির এই ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ১ হাজার ২৬২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এখানেও পলিসি সমস্যা প্রকট। এই বর্ধিত ঘাটতি টিসিবির সামান্য পণ্য থাকা ট্রাকের জন্য গরিব মানুষের ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার সঙ্গে সম্পর্কিত।
পাশাপাশি জরুরি খাদ্য ও ওষুধপণ্যের বাস্কেটে ভ্যাট না রাখার যে প্রস্তাব নব্বই-পরবর্তী ভ্যাট নীতিমালায় ছিল, সেটাও কৌশলে মানা হচ্ছে না। ভ্যাট নেই কিন্তু আমদানি ও পাইকারি শুল্ক আছে। আমরা দেখেছি কৌশলগত পণ্য জ্বালানিতে শুল্ক প্রায় ৩২ শতাংশ।
এই বাইরেও পলিসিগত সমস্যা আছে, সরকার জ্বালানিতে শুল্ক নিয়ে, জ্বালানি আমদানিতে দুর্নীতি ও চুরি না থামিয়ে, অপচুক্তি না থামিয়ে, বিদ্যুৎ খাতের ক্যাপাসিটি চার্জের বেদরকারি ভর্তুকি নিয়ন্ত্রণ না করে গত বছর ৪৫ থেকে ৬২ শতাংশ জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি করেছে। এ বছর টানা তিন মাস বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সবকিছুর দাম হু হু করে বাড়ছে এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের নতুন সংকট তৈরি হয়েছে।
সরকার আইএমএফ-কে খুশি করতে আর জ্বালানিতে ভর্তুকি দেবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ বাংলাদেশে জ্বালানি ভর্তুকিতে বিশ্বের ৪০তম দেশ, এমনকি যুক্তরাজ্য, জার্মানি, নেদারল্যান্ডসও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরে জ্বালানি ভর্তুকি দিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যে দেশে ৩২-৩৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে, যেখানে ক্রয়ক্ষমতার বৈষম্য এবং সম্পদ পিরামিডের ধনী-গরিবের ব্যাপক ব্যবধান, সেখানে কীভাবে দরকারি ভর্তুকি উঠিয়ে দিয়ে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তোলে?
বর্তমান আওয়ামী লীগের সার-কৃষি-ডিজেল ভর্তুকি নীতি তার ১৯৯৬-২০০১ সরকারের নীতি থেকেও ভিন্ন এবং স্ববিরোধী। আজকে সরকার আইএমএফের পরামর্শে জ্বালানি ভর্তুকি কমাচ্ছে, ব্যয় সংকোচন করতে না পেরে; কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে না পেরে পরবর্তী সময়ে কৃষি ভর্তুকি কমাবে, ভ্যাট বাড়ানোর পথে হাঁটবে, মাথাপিছু শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যয় কমাবে। উচ্চ দ্রব্যমূল্যের কারণে জনগণ যে কম খাবার খেতে বাধ্য হচ্ছে তার জন্য একই সঙ্গে সরকারের নীতি ও আইএমএফ-বান্ধব দরকারি ভর্তুকিবিরোধী পলিসিই মূলত দায়ী।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক।
ই-মেইল: [email protected]