মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও রিজার্ভ রক্ষায় প্রতিবেশীরা সফল, আমরা কেন ব্যর্থ

রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে দিতে সরকার ও ব্যবসায়ীরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে দুর্বল করে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক গ্লোবাল ফিন্যান্স ম্যাগাজিনের ‘সেন্ট্রাল ব্যাংকার রিপোর্ট কার্ড’ বা গভর্নরদের পারফরম্যান্স মূল্যায়নে ২০২৩ সালে গভর্নর হিসেবে আব্দুর রউফ তালুকদার ‘ডি’ গ্রেড পেয়েছেন। কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অকার্যকর ও চূড়ান্ত পর্যায়ে ব্যর্থ হিসেবে বিবেচিত হলে সেটির গভর্নর র‍্যাঙ্কিংয়ে এফ গ্রেডের অধীন থাকেন। আর কোনো গভর্নরের ডি গ্রেড পাওয়াটা সেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অযোগ্যতা ও অক্ষমতাকেই প্রকাশ করে।

ব্যাংক খাতের সংকট কাটাতে বছরজুড়েই প্রভাবশালীদের চাপে একের পর এক সিদ্ধান্ত বদল করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঠিক সময়ে পাচার থামাতে, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল ঋণ বন্ধ ও ফেরত আনতে পারেনি, দুই অঙ্কের মূল্যস্ফীতির সময়ে পারেনি এক অঙ্কের বেঁধে দেওয়া সুদের হার থেকে সরে আসতে। করোনার পর বাণিজ্যিক ব্যাংকের স্থায়ী/মেয়াদি/নগদ জমার স্থিতি, রপ্তানিকারকদের অর্জিত ডলার নগদায়নের ইআরকিউ কোটা আগের অবস্থানে নিতে পারেনি, রেপো-রিভার্স রেপো সুদের হার আগের অবস্থানে ফেরাতেও সময় নিয়েছে। রিজার্ভ থেকে দেওয়া উন্নয়নসহায়তা ঋণ ফেরাতে ব্যর্থ হয়েছে।

আরও পড়ুন

আইএমএফ শর্তের পর কিছু আংশিক উদ্যোগ নিয়েছে, যার সব কটি বাস্তবায়িত হয়নি। ক্রমাগত বড় বড় ব্যাংকিং ঋণ কেলেঙ্কারি চলতে থাকলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেয়নি, বরং পর্যবেক্ষক সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এসবের অন্যতম উদ্দেশ্য ব্যাংক মালিক পরিচালক, ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালীদের সম্পদ হস্তান্তর, সস্তায় ঋণ সরবরাহ। ধারণা করা হয়, এসব অর্থের উল্লেখযোগ্য পাচার হয়েছে।

অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংকের প্রধান তিন শাখার বৈদেশিক ঋণ কার্যক্রম ২৬ জুলাই ২০২৩ মঙ্গলবার বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। চাপের মুখে এক দিন পর বুধবার সন্ধ্যায় ঋণ কার্যক্রম খুলে দিতে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে রাষ্ট্র খাতের ব্যাংকটি নিয়ে সিদ্ধান্তটি ২৪ ঘণ্টাও ধরে রাখতে পারল না এই নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ব্যাংকটির ৭৭ হাজার কোটি টাকা ঋণের অর্ধেকই এই তিন শাখায়, প্রভাবশালী গ্রাহকেরাও এখানে। এ সিদ্ধান্তে বেশি সময় স্থির থাকতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। (প্রভাবশালীদের ক্ষমতা বুঝল কেন্দ্রীয় ব্যাংক, প্রথম আলো, ৩০ জুলাই ২০২২)

এর আগে রিজার্ভ থেকে উন্নয়ন প্রকল্পে ডলার ঋণের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শ শোনেনি সরকার (যেমন অকার্যকর পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর)। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ পরামর্শ ছিল, ডলারে আয় করবে না, এমন প্রকল্পে রিজার্ভ ঋণ না দেওয়া! স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস না মানার একই অবস্থা মুদ্রানীতিতে।

স্বাধীন মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে মূলধন খেয়ে ফেলা, মালিকানা হস্তান্তর, বাড়ন্ত খেলাপি ঋণ ও ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িত কোনো ব্যাংকের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে পারেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। ডলার রেট নির্ধারণেও স্বাধীন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা যায়নি। প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরাই নীতি নির্ধারণে নিয়ন্ত্রণমূলক ভূমিকা রাখে।

আরও পড়ুন

এদিকে দেশে ফেরত আসছে না রপ্তানি আয়ের একটা অংশ। দুই বছর ধরে বিদেশে আটকে আছে প্রায় শতকোটি ডলার। বিশেষজ্ঞরা অনেকেই বলেছেন, এই অর্থ আসলে পাচার হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে এই ডলার দেশে ফেরত আনতে, উদ্যোগটা কার্যকর হয়নি। অর্থনীতিবিদেরা সে ব্যাপারে আগেই সন্দিহান ছিলেন।

আমদানিতে চাহিদামতো ডলার দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো, ফলে ঋণপত্র খোলা কমেছে। রপ্তানি আয়ের অর্থ দেশে ফিরে এলে রিজার্ভের ওপর চাপ কিছু কমবে, এমন আশা থাকলেও প্রভাবশালী রপ্তানিকারকেরা নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশকে থোড়াই কেয়ার করেছে। রপ্তানি আয় ১২০ দিনের মধ্যে দেশে না এলে তা অর্থ পাচার হিসেবে গণ্য হয়।

এমতাবস্থায় কিছু ব্যাংকে ঋণপত্র সেটেল করতে সামান্য বাড়তি দামে ডলার কিনতে গেলে উল্টো কেন্দ্রীয় ব্যাংক আচরণগত অর্থনীতিকে পাত্তা না দিয়ে তাদের নোটিশ ও শাস্তি দিয়েছে। বিপরীতে ডলারের রেট হুন্ডির সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক রাখা, ডিজিটাল ব্যাংকিং মাধ্যমে হুন্ডির প্রসারে, অনলাইন জুয়া ও ক্রিপ্টো ব্যবসার আড়ালে ডলার পাচার থামানোর কোনো সময়োপযোগী ও যৌক্তিক উদ্যোগ ছিল না নিয়ন্ত্রক সংস্থার।

আমাদের প্রতিবেশীরা পারছে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাচ্ছে, আমরা পারছি না। জবাবদিহিহীন রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ভারত, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান কিংবা নেপালের স্তরের আদর্শ নীতির চর্চা কিংবা সুশাসন— কোনোটাই বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে কার্যকর করা সম্ভব নয়। প্রভাবশালীদের কাছে অসহায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক, এখানে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন মাথাচাড়া দিয়েছে, নেই মেধাতন্ত্রের কদর এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছাও।

কেলেঙ্কারি বন্ধে কিংবা শাস্তিদানে অক্ষম কেন্দ্রীয় ব্যাংক, কিছু ক্ষেত্রে ভেতরের লোকেরাই দুর্নীতিতে জড়িত। আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেখভালের দায়িত্বে থেকে পি কে হালদারের অর্থ পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগ আসার পরও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী ও বর্তমান নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে গ্রেপ্তার না করায় দুদকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন হাইকোর্ট। (‘….হাইকোর্টের ক্ষোভ’, ইত্তেফাক, ১৫ মার্চ ২০২১)

২৪ আগস্ট ২০২৩ প্রথম আলোর একটা নিউজ ছিল এমন, ‘অর্থমন্ত্রী অনিয়মিত, দেখা দেন না গভর্নর, অর্থসচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান।’ সেখানে বলা হয়েছিল, ‘গভর্নর হওয়ার পর ব্যাংকগুলোর অনিয়ম রোধে কিছু পদক্ষেপ নিলেও কিছু ব্যাংকের ক্ষেত্রে আবার তিনি বেশ নমনীয়। যেমন শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর অনিয়ম রোধে তিনি নিষ্ক্রিয়। আবার ভালো অবস্থায় থাকা ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরা (এমডি) বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে গভর্নরের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করলেও তিনি সাড়া দেননি। আবার অনেক সিদ্ধান্ত নিয়ে তারপর আবার সরে আসারও একাধিক উদাহরণ রয়েছে।

আরও পড়ুন

উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্স ম্যাগাজিনের র‍্যাঙ্কিংয়ে এশিয়ায় গভর্নরদের মধ্যে সেরাদের সেরা বা ‘এ প্লাস’ গ্রেড পাওয়া দুই গভর্নর হলেন প্রতিবেশী দেশ ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (আরবিআই) গভর্নর শক্তিকান্ত দাশ ও ভিয়েতনামের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নগুয়েন থি হং। দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নন্দলাল বীরাসিংহে ‘এ মাইনাস’ গ্রেড পেয়েছেন। আর নেপালের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর মহাপ্রসাদ অধিকারী পেয়েছেন ‘বি মাইনাস’ গ্রেড।

শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপগুলো দেউলিয়া অর্থনীতিকে স্বস্তিতে ফেরাতে পেরেছে, প্রশংসিতও হয়েছে। এ সময়ে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও গভর্নর খুব ভালো করছেন। ভালো করছে এমনকি নেপালের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষয়ের বিপরীতে আমরা আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উত্থানের চমকপ্রদ উদাহরণ টানতে পারি।

আরও পড়ুন

একটি চাঞ্চল্যকর সংবাদ হচ্ছে, সারা বিশ্বকে চমকে দিয়ে ২০২৩ জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বিশ্বের সেরা মুদ্রা হয়েছে আফগানিস্তানের ‘আফগানি’। মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ, নগদ অর্থের প্রবাহ ও রেমিট্যান্সের কারণে চলতি প্রান্তিকে আফগানির মান ৯ শতাংশ বেড়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর আফগানির মান ১৪ শতাংশ বাড়ল। সেই হিসাবে এ বছর কলম্বিয়া ও শ্রীলঙ্কার পরই বিশ্বের তৃতীয় সেরা মুদ্রা হচ্ছে আফগানি। (তালিবান কন্ট্রোলস দ্য ওয়ার্ল্ডস বেস্ট পারফরর্মিং কারেন্সি দিস কোয়ার্টার, ব্লুমবার্গ, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২৩)

২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর মার্কিনরা আফগানিস্তানের ৯.৫ বিলিয়ন ডলার আটকে রেখে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সুইফট লেনদেন বন্ধ করে। ৩০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি, জিডিপির ৩০ শতাংশ সংকোচনে অর্থনীতি ছিল শোচনীয় অবস্থায়। মূলত কাজটা করেছে আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

তালেবানরা কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা, আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও বাজেট বরাদ্দে ভারসাম্য রাখা এ আদর্শ মুদ্রানীতির চর্চাকে সম্মান করেছে এবং মেধাতন্ত্রকে প্রাধান্য দিয়েছে। নীতি নির্ধারণে সাবেক সরকারের যোগ্য সদস্যদের তাড়িয়ে না দিয়ে বরং কাজে লাগিয়েছে।

আফগানিস্তান প্রচলিত অপরাপর মুদ্রাকে বন্ধ করে শুধু আফগানিকে বাধ্যবাধক করেছে। নিজেরা যুক্ত থাকলেও স্বার্থকে পাশে সরিয়ে স্থানীয় লেনদেনে ডলার ও পাকিস্তানি রুপির ব্যবহার নিষিদ্ধ করা বড় কাজ ছিল। হুন্ডি কমিয়েছে, ডলার পাচারের ওপরও বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। রপ্তানি আয় ব্যাংকিং চ্যানেলে আনতে পেরেছে।

তালেবান সরকার অনলাইন বাণিজ্যও অবৈধ ঘোষণা করেছে। এসব আইন না মানলে কারাদণ্ডের হুমকি দিয়েছে তালেবান সরকার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হচ্ছে, তালেবান জাতিসংঘের মাধ্যমে আসা অনুদানকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ না করে বরং সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করেছে।

আরও পড়ুন

আমাদের প্রতিবেশীরা পারছে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাচ্ছে, আমরা পারছি না। জবাবদিহিহীন রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ভারত, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান কিংবা নেপালের স্তরের আদর্শ নীতির চর্চা কিংবা সুশাসন— কোনোটাই বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে কার্যকর করা সম্ভব নয়।

প্রভাবশালীদের কাছে অসহায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক, এখানে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন মাথাচাড়া দিয়েছে, নেই মেধাতন্ত্রের কদর এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছাও। এখানে বাজার কাজ করে না এবং রেগুলেটরি নীতি সিদ্ধান্তও কার্যত অচল। সুদের হার, নীতি সিদ্ধান্ত ও মুদ্রানীতি— এসব ঠিক করা হচ্ছে গোষ্ঠিস্বার্থে। এসবেরই ‘স্বীকৃতি’ পাওয়া গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণরের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের ‘ডি’ গ্রেডিং পাওয়ার মধ্য দিয়ে।

  • ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ; বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর; অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা; বাংলাদেশের পানি, পরিবেশ ও বর্জ্য। ই-মেইল: [email protected]