২০১৪ থেকে ২০১৮: দলীয় সরকারের অধীনে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ নির্বাচন 

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অংশ হচ্ছে নির্বাচন। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ক্ষমতাকে বৈধতা দেয়। গ্রহণযোগ্য না হলে সেই ক্ষমতার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তাই নির্বাচন শুধু আইনি বা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার বিষয় নয়, এর সঙ্গে ক্ষমতার বৈধতা, গণতন্ত্র, রাজনৈতিক বন্দোবস্ত—এ সবকিছুই জড়িত।

স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে সাতবার সামরিক শাসনসহ দলীয় সরকার ও চারবার নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে।

এসব নির্বাচনের প্রেক্ষাপট, নির্বাচনের ফলাফল এবং রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে এর প্রভাব নিয়ে পাঁচ পর্বের লেখার আজ শেষ পর্ব

২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে। এর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে এবং সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান করা হয়। তখন থেকে নির্বাচন নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়।

২০১৪: দশম সংসদ নির্বাচন

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়া হয়। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বিএনপির পক্ষ থেকে টানা অবরোধের মাধ্যমে নির্বাচন প্রতিরোধের কর্মসূচি দেওয়া হয়। মহাজোটের অংশীদার জাতীয় পার্টিও প্রাথমিকভাবে নির্বাচনে না যাওয়ার কথা জানিয়েছিল। পরে দেশি-বিদেশি নানামুখী চাপে দলটি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়।

এ বিষয়ে বিএনপি: সময়-অসময় বইয়ে মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘৫ জানুয়ারির নির্বাচন আয়োজন করতে আওয়ামী লীগ সরকারকে ভারত সর্বোচ্চ কূটনৈতিক সমর্থন দেয়। নির্বাচনের আগে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং ঢাকা সফর করেন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে দূতিয়ালি করেন।’

বিএনপির বর্জন সত্ত্বেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ‘একতরফা’ এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর জোটভুক্ত দলগুলোসহ মাত্র ১২টি দল অংশ নেয়। এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জোট ও তাদের শরিক দলের প্রার্থীরা ভোটের আগেই ৩০০ আসনের মধ্যে অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। অপরদিকে ১৪৭ আসনে নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতায় প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৩৯০।

এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একাই ২৩৪টি আসন পায়। জাতীয় পার্টি ৩৪টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ৬টি, জাসদ (ইনু) ৫টি, তরীকত ফেডারেশন ২টি, জাতীয় পার্টি (জেপি) ২টি, বিএনএফ ১টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১৬টি আসনে জয়লাভ করেন। এ নির্বাচনে (১৪৭টি আসনে) ভোট প্রদানের হার দেখানো হয় ৪০.০৪ ভাগ।

দশম সংসদ নির্বাচনের ভোটের দিন সহিংসতার ঘটনায় নিহত হন ১৯ জন। নির্বাচনপূর্ব সহিংসতার দিক থেকে এ নির্বাচন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের আগের দিন পর্যন্ত নিহত হন ১২৩ জন।

নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তৃতীয় দফা সরকার গঠিত হয়। এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে সংসদে ‘বিরোধী দল’ বানানো হয়। একই সঙ্গে দলটি থেকে মন্ত্রীও করা হয় এবং এরশাদকে বানানো হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত। জাতীয় পার্টি আসলে সরকারের অংশ নাকি বিরোধী দল, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবুল ফজল হক বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা ও রাজনীতি বইয়ে বলেছেন, ‘...জাতীয় পার্টির এই দ্বৈত ভূমিকা সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতিনীতি-বিরুদ্ধ বলে সমালোচিত হয় এবং সংসদ কার্যত বিরোধী দলশূন্য হয়ে পড়ে।’

আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল এর আগে বিএনপি সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মতো ‘একতরফা’। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর বিএনপি সরকার কয়েক দিনের মধ্যে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ভূরাজনৈতিক সমীকরণ নিজেদের পক্ষে থাকায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়।

এর ফলে রাজনীতিতে সরকারি ও বিরোধী দলের যে শক্তির ভারসাম্য ছিল, তা নষ্ট হয়ে যায়। ক্ষমতাসীনদের মধ্যে কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা দেখা দেয়। কোনো কোনো গবেষকের মতে, এ রকম শাসনব্যবস্থা হলো ‘হাইব্রিড রেজিম’।

২০১৮: একাদশ সংসদ নির্বাচন

২০১৪ সালের মতো ২০১৮ সালেও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে সন্দেহ-সংশয় ছিল। নির্বাচনের আগে বিএনপির সঙ্গে আরও কিছু দল যুক্ত হয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে একটি রাজনৈতিক জোট গঠন করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ আরও কিছু দল ও জোটের সঙ্গে সংলাপ করেন এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেন। এ রকম প্রেক্ষাপটে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৩৯টি দল এতে অংশ নেয়। মোট প্রার্থী ছিলেন ১ হাজার ৮৬৫ জন।

এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একাই ২৫৮টি আসন পায় বলে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করে। জাতীয় পার্টি ২২টি এবং মহাজোটভুক্ত অন্য দলগুলো ৮টি আসনে জয়ী হয়। অপরদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত বিএনপি ৬টি, গণফোরাম ২টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৩টি আসনে জয়ী হন।

এ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি দেখানো হয় ৮০.২০ শতাংশ। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় মোট ভোটের ৭৪.৪৪ শতাংশ। অপরদিকে বিএনপি পেয়েছে মাত্র ১২.০৭ শতাংশ ভোট।

নির্বাচনের কয়েক দিন পর নির্বাচন কমিশন তাদের ওয়েবসাইটে কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ এবং ১,৪১৮টি কেন্দ্রে ৯৬ শতাংশের ওপর ভোট পড়েছে। এ নির্বাচন নিয়ে টিআইবির (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) এক গবেষণায় বলা হয়, ৫০টি আসনের মধ্যে ৪৭টিতে কোনো না কোনো অনিয়ম হয়েছে।

এ নির্বাচনের ফলাফল, বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোট প্রদানের হার এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে ভোটের ব্যবধান নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন তৈরি হয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের পরিস্থিতি ও ফলাফল যে স্বাভাবিক ছিল না, সাবেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার নির্বাচননামা বইয়ে তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, জনগণের কাছে এ নির্বাচন ‘রাতের নির্বাচন’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম ও পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো বিভিন্ন প্রশ্ন তুলেছে। এ নির্বাচন নিয়ে ভোটিং ইন অ্যা হাইব্রিড রেজিম: এক্সপ্লেইনিং দ্য ২০১৮ বাংলাদেশি ইলেকশন বইয়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসমূহ, বেসামরিক প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন দল এ নির্বাচনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে এবং তারা একে অপরের সহযোগী ছিল। বিরোধী দলের কর্মী ও প্রার্থীদের গ্রেপ্তার, পুলিশের উপস্থিতিতে বিরোধীদের ওপর সরকারি দলের কর্মীদের হামলা এবং প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষেত্রে দ্বৈত নীতি—এ রকম কৌশলগুলো ব্যবহৃত হয়েছে।

বিএনপিসহ বেশির ভাগ বিরোধী দল অংশ নেওয়ায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘অংশগ্রহণমূলক’ বলা যেতে পারে। কিন্তু এতে বিরোধীদের প্রাপ্ত আসনসংখ্যা ও ভোটের হার ছিল আগের নির্বাচনগুলোর তুলনায় অনেক কম। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনেরা প্রায় ‘একচেটিয়াভাবে’ এ নির্বাচনে জয়লাভ করে। ফলাফল বিবেচনা করলে এটাও একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ও একতরফা নির্বাচন।

২০১৮ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বার সরকার গঠন করে। এ নির্বাচনের পর সংসদের ভেতরে-বাইরে সর্বক্ষেত্রে সরকারি দলের প্রায় একক ‘আধিপত্য’ কায়েম হয়েছে। এর ফলে রাজনীতিতে বিরোধী দল ও মতের স্থান কমে গেছে এবং গণতান্ত্রিক পরিসর আরও সংকুচিত হয়েছে বলে মনে করে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো।

২০২৪: দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন কেমন হবে

বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনগুলো নিয়ে সব সময় কমবেশি বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিশ্চিত ও বিপুল বিজয় সত্ত্বেও নির্বাচন নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠেছে। এরপর জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৯ সালে এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোকে অনেকেই সামরিক শাসনকে গণতন্ত্রের লেবাস পরানোর চেষ্টা হিসেবে দেখে থাকেন।

নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতনের পর এক বিশেষ বাস্তবতায় বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালে নির্বাচন হয়। বিএনপি সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিতর্কিত ও ভোটারবিহীন নির্বাচন হয়েছিল। এরপর রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়টি সংবিধানে যুক্ত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরপর তিনটি নির্বাচন (১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮) দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটি ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি হয়। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেও তা ছিল দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। এ রকম এক বাস্তবতায় ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে মাঠের ও ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি। কিন্তু বিএনপিসহ বেশ কিছু বিরোধী দল এ নির্বাচনে অনুপস্থিত। এ অবস্থায় ক্ষমতাসীনেরা ‘ডামি’ বা ‘নিজ দলীয় স্বতন্ত্র’ প্রার্থীদের মাধ্যমে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখানোর চেষ্টা করছে।

এ রকম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এ নির্বাচনের মাধ্যমে কোন দল ক্ষমতায় আসছে, তা খুব সহজেই অনুমেয়। এর ফলে এটাও কার্যত ‘একতরফা’ নির্বাচনে পরিণত হয়েছে। এ রকম একটি নির্বাচনের পর রাষ্ট্র ও রাজনীতি কোন দিকে মোড় নেবে, তা জানতে হলে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

তথ্যসূত্র:

১. মহিউদ্দিন আহমদ, বিএনপি: সময়-অসময়, প্রথমা

২. আবুল ফজল হক, বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা ও রাজনীতি, অনন্যা

৩. মাহবুব তালুকদার, নির্বাচননামা, প্রথমা

৪. আলী রীয়াজ, ভোটিং ইন অ্যা হাইব্রিড রেজিম: এক্সপ্লেইনিং দ্য ২০১৮ বাংলাদেশি ইলেকশন, প্যালগ্রেভ ম্যাকমিলান

৫. নেসার আমিন সম্পাদিত বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা ও ফলাফল, ঐতিহ্য