নিরাপদ সড়ক আন্দোলন: পরিবর্তনের স্বপ্নটা কেন ফিকে হয়ে গেল

২০১৮ সালের ২৯ জুলাই নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনকে ঘিরে সড়ক পরিবহনব্যবস্থায় যে পরিবর্তনের স্বপ্ন দানা বেঁধেছিল, তা ফিকে হয়ে গেছে।ফাইল ছবি

শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের আজ ছয় বছর। এই সময়ের মধ্যে দেশে ও সমাজে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। সেদিনের আন্দোলনকারী স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা এখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। অনেকে কর্মজীবন শুরু করেছেন। পরিবর্তন ঘটেনি কেবল সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনায়। দুর্ঘটনার চিত্রও হয়েছে ঊর্ধ্বমুখী।

দেশে সড়ক অবকাঠামো বিস্তৃত হয়েছে, বেড়েছে নানা প্রকারের যানবাহন, যার বিরাট অংশ অনিরাপদ। বিষয়টি চরম উদ্বেগের। বস্তুত সড়ক পরিবহন খাতে সুশাসন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার কারণে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে এবং অতীতের মতো বিষয়টি উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে। দুর্ঘটনারোধে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও সমন্বয়হীনতা ও গোষ্ঠী স্বার্থের কারণে এসবের বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনায় এমন নৈরাজ্যের মধ্যে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর নামের বেপরোয়া গতির বাসের চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুজন শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় ঢাকাসহ সারা দেশের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। সে এক অভূতপূর্ব অহিংস আন্দোলন।

‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’স্লোগান দিয়ে শিক্ষার্থীরা সড়কে-যানবাহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে, দেশে প্রথমবারের মতো ইমার্জেন্সি লেন তৈরি করে সারা দুনিয়ায় প্রশংসিত হয়। তারা যানবাহনের ফিটনেস ও চালকের লাইসেন্স পরীক্ষা শুরু করলে দেশের বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির যানবাহন আটকে যায়।

শিক্ষার্থীদের সেই অহিংস স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন আমাদের দেখিয়েছিল দেশের সড়ক পরিবহন খাতের দায়হীন, মায়াহীন সংকটাপন্ন চেহারা। ব্যাপক জনসমর্থিত সেই আন্দোলন চলাকালে সরকার শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবি মেনে নিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানায়।

শিক্ষার্থীরা সরকারের প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রেখে শ্রেণিকক্ষে ফিরে যায়। কিন্তু সড়কে আর শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে শিক্ষার্থীদের এমন আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ প্রণয়ন করে অতি দ্রুত সংসদে পাস করে।

দেশবাসী প্রত্যাশা করেছিল, নতুন আইনের মাধ্যমে দেশের সড়ক পরিবহনব্যবস্থায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু অদ্যাবধি আইনটি পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়নই শুরু হয়নি। এটি সদিচ্ছার অভাবকেই দৃশ্যমান করে তোলে। শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন-পরবর্তী ছয় বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩৬ হাজার ৭২৮ জন।

এর মধ্যে ৫ থেকে ২৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন ৫ হাজার ৯২১ জন। ৫৭ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন, যার একটি বড় অংশ পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। (তথ্যসূত্র: রোড সেফটি ফাউন্ডেশন)। এসব হতাহতের জন্য সড়কের বিশৃঙ্খলার সঙ্গে মানুষের অসচেতনতাও দায়ী। তবে মানুষকে সচেতন করার দায়িত্ব প্রধানত সরকারের আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে।

প্রত্যাশা ছিল এই আন্দোলনের মাধ্যমে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, যানবাহনের মালিক এবং শ্রমিকশ্রেণি দায়িত্বশীল ও সচেতন হবেন। দেশে একটি টেকসই পরিবহন কৌশল বাস্তবায়ন হবে। নৈতিকতার সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনায় গুণগত উন্নতির মাধ্যমে সড়কে লাশের মিছিল বন্ধ হবে। সড়কে স্বপ্নভঙ্গের আর্তনাদ থামবে। কিন্তু কিছুই হলো না।

‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’-তে জামিন অযোগ্য ধারা, সাজার মেয়াদ ও জরিমানার পরিমাণ ইত্যাদি বিষয়ে সংশোধনের দাবি জানিয়ে পরিবহনমালিক-শ্রমিক নেতারা শুরু থেকেই আইনটি বাস্তবায়নে আপত্তি জানিয়ে আসছেন। তাঁদের আপত্তির কারণেই আজ ছয় বছরেও আইনটি পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন শুরু হয়নি। কিছুদিন আগে সরকার জামিন অযোগ্য ধারা জামিনযোগ্য, জেল ও জরিমানার মাত্রা কমানোসহ ১০টি দাবি মেনে নিয়েছে। জামিন অযোগ্য ধারার বিষয়ে আমাদেরও আপত্তি ছিল। কারণ, এটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, আইনে জামিনের বিধান থাকতে হবে, তবে সুষ্ঠু বিচার হতে হবে। আইনের সংশোধনকে স্বাগত জানিয়ে এখন আমরা আইনটির বাস্তবায়ন চাই। কিন্তু মালিক-শ্রমিক নেতারা বলছেন, তাঁদের আরও ২২টি দাবি আছে। আমাদের বক্তব্য, এসব দাবি নিয়ে সরকার ও মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করে বছরের পর বছর সময়ক্ষেপণের দরকার নেই।

এ বিষয়ে সরকার, পরিবহনমালিক-শ্রমিক নেতারা, সড়ক নিরাপত্তা ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে একটি জাতীয় সংলাপ হওয়া দরকার। সেই সংলাপে মালিক-শ্রমিকদের দাবিগুলো যদি যৌক্তিক প্রমাণিত হয়, তাহলে সরকার দ্রুত মেনে নিয়ে আইনটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন শুরু করুক।

আইনের প্রয়োগহীনতার কারণে সড়কে মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। এর দায় কি পরিবহনমালিক-শ্রমিক নেতারা বা সরকার নিচ্ছে? তা ছাড়া আইন বাস্তবায়ন হলে তো পরিবহন শ্রমিকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা নিশ্চিত হবে। তারা নিয়োগপত্র পাবেন। শ্রমিকদের পেশাগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হবে।

উল্লেখ্য, দীর্ঘকাল ধরে আদর্শহীন রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় সড়কে গড়ে ওঠা চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটই গণপরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় প্রধান বাধা। সড়ক দুর্ঘটনারোধে প্রধানমন্ত্রী পাঁচ দফা সুপারিশ করেছিলেন। সেসব সুপারিশ এই চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের কারণে আলোর মুখ দেখেনি। তারা নিজেদের হীন স্বার্থে গণপরিবহনে নৈরাজ্য টিকিয়ে রাখে। কারণ, শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হলে চাঁদাবাজি-দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যাবে। ‘যত বেশি অব্যবস্থাপনা-নৈরাজ্য, তত বেশি অবৈধ উপার্জন’—এটাই তাদের অপকৌশল।

মানুষের করের টাকায়, বৈদেশিক ঋণের টাকায় সড়ক নির্মাণ করা হয়। এই সড়কে চাঁদাবাজি চলে কোন যুক্তিতে? কোন নৈতিকতায়? অধিকাংশ শ্রমিকনেতা শ্রমিকদের নিয়োগপত্র, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্টকরণ ইত্যাদি বিষয়ে জোরালো দাবি করেন না। শ্রমিকেরাও নিজেদের স্বার্থ না বুঝে স্বার্থান্বেষী মহলের ফাঁদে পড়ে থাকেন।

রাজধানীতে রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি পদ্ধতির মাধ্যমে কোম্পানিভিত্তিক গণপরিবহন চালুর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। মেয়াদোত্তীর্ণ বাস প্রত্যাহার করে নতুন বাসের মাধ্যমে এই সার্ভিস চালু করার কথা ছিল। এটি করা হলে রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হতো। বর্তমানে দুই-তিনটি রুটে অল্পসংখ্যক পুরোনো বাস দিয়ে ‘নগর পরিবহন’ সার্ভিস চালু করা হয়েছে। কিন্তু অপরিকল্পিত ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে এই সার্ভিস যাত্রীসেবায় কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না। এটা এখন বন্ধ হওয়ার পথে।

রাজধানীর যানজট কমানোর জন্য একটি মেট্রোরেল নির্মাণ করা হয়েছে। দুটি সাবওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত। কিন্তু রাজধানীতে যেভাবে মানুষের চাপ বাড়ছে, তাতে মেট্রোরেল ও সাবওয়ে যানজট খুব বেশি কমাতে পারবে না। মেট্রোরেল ও সাবওয়ে যে পরিমাণ যাত্রী বহন করবে, তার চেয়ে সাড়ে তিন গুণ মানুষ যাতায়াত করবে সারফেস রুটের বাস সার্ভিসে। অর্থাৎ, বাসের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং মানোন্নয়ন ছাড়া রাজধানীর যাতায়াত ব্যবস্থায় সামগ্রিক উন্নতি আসবে না।

মেট্রোরেল ও সাবওয়ে নির্মাণের পাশাপাশি রাজধানীর সব পুরোনো বাস প্রত্যাহার করে ১০-১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৪ হাজার নতুন বাস কিনে এসি এবং সাধারণ দুই ক্যাটাগরিতে পরিচালনা করলে এবং বাসের জন্য লেন-বিন্যাস করলে প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহারকারী বহু মানুষ বাসে চলাচল করবেন। এতে প্রাইভেট গাড়ি নিরুৎসাহিত হবে। যানজট নিয়ন্ত্রণে আসবে। যানজট কমলে মোটরসাইকেলের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা সম্ভব হবে। কিন্তু এসব টেকসই উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না।

সারা দেশে স্বল্পগতির ইজিবাইক, অটোরিকশা, নছিমন, ভটভটি, মাহিন্দ্র ইত্যাদি ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন চলছে। স্বল্প দূরত্বে চলাচল এবং পণ্য পরিবহনে এসব যানবাহন ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু সড়ক-মহাসড়কের নকশাগত ত্রুটি ও সার্ভিস রোডের অভাবে এসব যানবাহন বাধ্য হয়ে মহাসড়ক ব্যবহার করে অহরহ দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে। বাস্তবতার নিরিখে এগুলো বন্ধ করা সম্ভব নয়। কারণ, এসব যানবাহনের ওপর ভিত্তি করে গ্রামীণ অর্থনীতি গড়ে উঠেছে। স্বল্প গতির এসব যানবাহন প্রযুক্তিগতভাবে নিরাপদ করা এবং চালকদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না।

এই হলো দেশের সড়ক পরিবহনব্যবস্থার চিত্র। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনকে ঘিরে সড়ক পরিবহনব্যবস্থায় যে পরিবর্তনের স্বপ্ন দানা বেঁধেছিল, তা ফিকে হয়ে গেছে।

প্রত্যাশা ছিল এই আন্দোলনের মাধ্যমে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, যানবাহনের মালিক এবং শ্রমিকশ্রেণি দায়িত্বশীল ও সচেতন হবেন। দেশে একটি টেকসই পরিবহন কৌশল বাস্তবায়ন হবে। নৈতিকতার সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনায় গুণগত উন্নতির মাধ্যমে সড়কে লাশের মিছিল বন্ধ হবে। সড়কে স্বপ্নভঙ্গের আর্তনাদ থামবে। কিন্তু কিছুই হলো না।

  • সাইদুর রহমান, রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক।
    [email protected]