ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর কয়েক দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন মস্কোর ওপর বড় ধরনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। গত ১৬ নভেম্বর ফিন্যান্সিয়াল টাইমস–এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়ার অর্থনীতি পরপর দুই প্রান্তিকের মতো সংকুচিত হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়ার অর্থনীতিতে বিপুল যে ক্ষতি হচ্ছে, তা এড়াতে ক্রেমলিনের অগ্রাধিকারভিত্তিক কৌশল কী?
রাশিয়া কয়েক দশক ধরে নিষেধাজ্ঞায় পড়া দেশগুলো ক্ষতি এড়াতে পারে, সেই সহযোগিতা করে আসছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে উত্তর কোরিয়ায় তেল রপ্তানি করেছে। সার্বিয়ায় রাশিয়ার লোকদের নিয়োগ দিয়েছে। উত্তর কোরিয়াকে রাশিয়ার কোম্পানি অস্ত্রের জোগানও দিয়েছে।
ক্রেমলিন এখন এসব দেশকে তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসার আহ্বান করছে। গত আগস্ট মাসে উত্তর কোরিয়া রাশিয়ার সঙ্গে ‘সম্পর্ক শক্তিশালী’ করার অঙ্গীকার করে। একঘরে রাশিয়াকে গত কয়েক মাসে উত্তর কোরিয়া বিপুল পরিমাণ রকেট ও গোলাবারুদ দিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইউক্রেনের লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক পুনর্গঠনে উত্তর কোরিয়ার শ্রমিকেরা সহযোগিতা করবেন, এ রকম একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এ ছাড়া রাশিয়া এখন নিষেধাজ্ঞার ক্ষতি এড়াতে ক্রিপ্টোকারেন্সির দিকে ঝুঁকেছে। এ কাজে মস্কো উত্তর কোরিয়াকে অনুকরণ করছে।
পাকিস্তানের সঙ্গে গ্যাস সরবরাহ চুক্তি, মিসরের সঙ্গে স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য ও ব্রাজিলে জ্বালানি রপ্তানি বৃদ্ধি—এসব পদক্ষেপ থেকে এটা স্পষ্ট যে রাশিয়া তার অর্থনীতিকে বহুমুখীকরণ করছে। রাশিয়ার অর্থনীতিকে চেপে ধরার জন্য নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে পশ্চিমারা। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, এতে করে মস্কোর আচরণ সংশোধন হবে। কিন্তু রাশিয়া কালোবাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস বিক্রিসহ নানাভাবে নিষেধাজ্ঞার অভিঘাত এড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
ইরান ও ভেনেজুয়েলার সঙ্গে যোগাযোগ
১৯৭৯ সাল থেকেই ইরানের ওপর পশ্চিমারা বড় নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসছে। গত কয়েক বছরে ইরানকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছে রাশিয়া। গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে ইরান থেকে বিপুল পরিমাণ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র গেছে রাশিয়ায়। সম্প্রতি রাশিয়ার জ্বালানি তেলের ওপর ‘প্রাইস ক্যাপ’ বেঁধে দিয়েছে পশ্চিমারা। এ প্রেক্ষাপটে ইরানের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাচ্ছে রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ।
২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার পর ইরানের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ফলে ইরানের তেল রপ্তানি ৯০ শতাংশ কমে যায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে তেল রপ্তানির ক্ষেত্রে বেশ কিছু কৌশল নেয় ইরান। নিষেধাজ্ঞা আরোপ হওয়া কোম্পানি বা জাহাজের নাম বদল করে কিংবা অন্য কোনো দেশের কোম্পানির কাছে তেল বিক্রি করে ইরান। রাশিয়াও সেই কৌশলগুলো গ্রহণ করেছে।
গত এপ্রিল মাসে শেল কোম্পানি লাটভিয়া থেকে তেল কেনায় সমালোচনার মুখে পড়ে। কেননা, সেই তেলের ৪৯ শতাংশই ছিল রাশিয়া থেকে আসা। ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর জার্মানি, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসের কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে যুক্তরাজ্য লাখ লাখ ডলারের তেল কিনেছে। এর বেশির ভাগই রাশিয়ার তেল। এ ছাড়া রাশিয়ার তেল বিশ্ববাজারে প্রবেশের ‘পেছনের দরজা’ হিসেবে ইরানকে ব্যবহার করছে মস্কো।
ভেনেজুয়েলার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হলেও দেশটির তেল আন্তর্জাতিক বাজারে আসার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করে রাশিয়ার কোম্পানিগুলো। ২০২০ সালে এ ধরনের কাজের জন্য রাশিয়ার বড় তেল কোম্পানি রোসনেফট-এর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ক্রেমলিন রোসনেফটের বদলে নতুন একটি খুলে ব্যবসা পরিচালনা করতে থাকে।
রাশিয়ার সহযোগিতায় ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি দ্বিগুণ হয়। বিশ্ববাজারে নতুন ব্যবসায়ী ও ক্রেতা খুঁজে পায়। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ মেক্সিকোর সঙ্গে যুক্ত বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। এসব প্রতিষ্ঠান ভেনেজুয়েলার তেল চীন, ইন্দোনেশিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে সরবরাহ করত।
জার্মানির কমার্স ব্যাংক, ডাচ ব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্রের সিটি গ্রুপ প্রায়ই নিজেদের অজান্তে ইরানের চোরা বাজারের তেল বেচাকেনায় সহযোগিতা করে। রাশিয়াও তাদের তেল বিক্রির ক্ষেত্রে এসব ব্যাংকের শরণাপন্ন হতে পারে।
রাশিয়ার অলিগার্কিদের পশ্চিমা অর্থনীতির ক্রীড়নকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে। এ সম্পর্ককে তাদের অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারে তারা ব্যবহার করতে পারে।
বিকল্প আর যে সব পথ
একঘরে রাশিয়ার এখন পশ্চিমাদের বাইরের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর সহযোগিতা প্রয়োজন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে ইরান, ভেনেজুয়েলা ও রাশিয়ার কাছ থেকে তেলসহ অন্যান্য সম্পদ কিনেছে। রাশিয়ার সঙ্গেও এখন একই নীতি গ্রহণ করেছে। চীনের ছোট তেল শোধনাগারগুলোতে রাশিয়ার তেল পরিশোধন করা হচ্ছে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া বেশ কঠিন।
রাশিয়ার এ একঘরে দশাকে চীন তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বেশ ভালোভাবেই কাজে লাগাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা খর্ব করতে এ সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে তারা। আন্তর্জাতিক লেনদেনব্যবস্থা সুইফট থেকে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে বের করে দেওয়ার পর চীন ও রাশিয়া নিজস্ব বিকল্প লেনদেনব্যবস্থা শক্তিশালী করে।
এর মধ্যে আছে রাশিয়ার সিস্টেম ফর ট্রান্সফার ফর ফিন্যান্সিয়াল মেসেজ (এসপিএফএস) ও ন্যাশনাল পেমেন্ট কার্ড সিস্টেম (মির) এবং চীনের ক্রস-বর্ডার ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম (সিআইপিএস) ও ইউনিয়ন রয়েছে।
গত জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য রুপিতে করার জন্য একটি রূপরেখা তৈরি করে। রাশিয়ার সঙ্গে স্থানীয় মুদ্রায় এ ধরনের লেনদেন করার জন্য ভারতের ইউসিও ব্যাংকের সঙ্গে রাশিয়ার গাজপ্রমব্যাংকের চুক্তি স্বাক্ষর হয়। রাশিয়ার আরও ছয়টি ব্যাংকের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা চলছে।
পাকিস্তানের সঙ্গে গ্যাস সরবরাহ চুক্তি, মিসরের সঙ্গে স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য ও ব্রাজিলে জ্বালানি রপ্তানি বৃদ্ধি—এসব পদক্ষেপ থেকে এটা স্পষ্ট যে রাশিয়া তার অর্থনীতিকে বহুমুখীকরণ করছে। রাশিয়ার অর্থনীতিকে চেপে ধরার জন্য নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে পশ্চিমারা। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, এতে করে মস্কোর আচরণ সংশোধন হবে। কিন্তু রাশিয়া কালোবাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস বিক্রিসহ নানাভাবে নিষেধাজ্ঞার অভিঘাত এড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
জন পি রুহেল অস্ট্রেলিয়ান-আমেরিকান সাংবাদিক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত