অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক রূপান্তরের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। সাধারণ গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে উঠে আজ তিনি দেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। সেই নির্বাচনও অভূতপূর্ব। ১৯৬৮ সালে জন্ম নেওয়া দিশানায়েকের শ্রীলঙ্কার গ্রামীণ জীবনের সংগ্রামের সঙ্গে আছে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।
দেশের অধিকাংশ শাসক আর অভিজাত রাজনীতিবিদের শিকড় সংখ্যাগুরু সিংহলি বৌদ্ধ রাজনীতির মধ্যে। কিন্তু দিশানায়েকে কোনো জাতি বা বর্ণ পরিচয় নিয়ে সামনে আসেননি।
১৯৯০–এর দশকে দিশানায়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। সে সময় জনতা বিমুক্তি পেরামুনা, মানে জেভিপির সঙ্গে যুক্ত হন। বামপন্থী মার্ক্সবাদী এই দল দুবার (১৯৭১ ও ১৯৮৭-৮৯) সশস্ত্র আন্দোলন করে। বঞ্চিত সিংহলি তরুণেরা এই আন্দোলনে ব্যাপকভাবে যুক্ত হয়েছিলেন। জেভিপির এই আন্দোলনের মূল ভাবধারা ছিল কট্টর মার্ক্সবাদী দর্শন। বহাল রাষ্ট্রকে তারা সম্পূর্ণ উৎখাত করতে চেয়েছিল।
দিশানায়েকের রাজনৈতিক অগ্রযাত্রা শুরু হয় ১৯৯৭ সালের দিক থেকে। জেভিপির সমাজতান্ত্রিক যুব সংগঠনের জাতীয় সংগঠক হিসেবে। ২০০০ সালে সংসদ সদস্য হন।
২০১৪ সালের মধ্যে জেভিপির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এর মধ্যে ২০০৪ সালে কম সময়ের জন্য কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছিলেন। নিজেও ছিলেন কৃষক পরিবারের সন্তান। সব মিলিয়ে তিনি শ্রীলঙ্কার অভিজাতদের থেকে ভিন্ন হয়ে গড়ে ওঠেন। হয়ে যান খেটে খাওয়া মানুষের কাছের মানুষ।
১৯৭০ আর ১৯৮০-এর দশকের জেভিপির বিদ্রোহ রাষ্ট্র দমন করে ভয়ানকভাবে। দলের নেতৃত্ব প্রায় শূন্য হয়ে যায়। সে সময়ের পরে ২০১৪ সালে দিশানায়েকের নেতৃত্ব গ্রহণ ছিল দলের জন্য এক মোড় পরিবর্তন। সোমাওয়ানসা অমরাসিংঘে দলকে সশস্ত্র রাজনীতি থেকে সংসদীয় রাজনীতিতে আনার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে দিশানায়েকে দলের ভাবমূর্তি সমকালীন ছাঁচে তৈরি করেন। তরুণদের কাছে জেভিপির গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে তোলেন অভাবনীয় রকম।
রাজনৈতিক অভিজাতদের হাত থেকে ছিনিয়ে এনে সাধারণ মানুষের রাজনীতিকে তাদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য মানুষ দিশানায়েকের ওপর আস্থা রাখা শুরু করে।
জেভিপি তার মূল উদ্দেশ্য হিসেবে হাজির করে সামন্ততন্ত্র আর সাম্রাজ্যবাদকে প্রতিহত করার জন্য শ্রেণিসংগ্রাম। দিশানায়েকে একে আরও স্পষ্ট করে বলেন, অর্থনৈতিক সংকট, দুর্নীতি, গ্রামীণ জনগণের বাঁচার সংগ্রামের কথা। ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে শ্রীলঙ্কার খারাপ হতে থাকা অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে এভাবে তিনি ক্রমে মানুষের কাছে আসতে থাকেন।
দিশানায়েকে যখন জেভিপির প্রার্থী হলেন, তখন দেশের রাজনৈতিক অভিজাতদের মধ্যে ব্যাপক ক্রোধ লক্ষ করা গিয়েছিল। দেশের দুর্দশার জন্য দিশানায়েকে যেভাবে এই অভিজাতদের আক্রমণ করে আসছেন, তাতে এমন হওয়াই স্বাভাবিক।
এই প্রথম কোনো মার্ক্সবাদী দল শ্রীলঙ্কার শাসনক্ষমতায় এলেন। দেশ পাল্টানোর আগে তারা নিজেদের প্রস্তুত করতে প্রয়াস নিয়েছে। অনেকে অবশ্য ভাবেন যে জেভিপি আসলে নিজেদের কতটা বদলেছে? এ বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। কেউ বলেন, দল হয়তো দেশ শাসন করার জন্য এখনো যথেষ্ট প্রস্তুত নয়। অনেকে তঁাদের সশস্ত্র ধারা থেকে সফলভাবে সাধারণ মানুষের কথা প্রচলিত রাজনৈতিক অঙ্গনে নিয়ে আসার ক্ষমতাকে সম্ভাবনাময় এক ইঙ্গিত বলতে চান। বলতে চান, এখন তাঁরা অনেক বাস্তবমুখী।
দিশানায়েকে ও জেভিপির সঙ্গে চীন ও ভারতের সম্পর্ক আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে সামনে আসবে। জেভিপি যাত্রা শুরু করেছে ১৯৬০-এর দশকে শ্রীলঙ্কা কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে। সেই অংশ ছিল চীনপন্থী। তারা মাওবাদী আদর্শে সশস্ত্র আন্দোলনের সমর্থক ছিল। সেই ঐতিহ্য জেভিপিকে এখন আবার চীনের বেশি কাছে নিয়ে যায় কি না, তা নিয়ে অনেক জল্পনা আছে।
জেভিপি যখন সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে, তখন তাদের অন্যতম ঘোষণা ছিল দেশে ভারতীয় হস্তক্ষেপ প্রতিহত করা। সে সময় তারা ভারতীয় ব্যবসা ও পণ্য আমদানির ওপরও হামলা করত। কিছু ভারতীয় ব্যবসায়ীকে তারা হত্যাও করেছিল। সবাই জেভিপিকে ভারতবিরোধী বলেই জানে। তবে সেই ইতিহাস দিয়ে জেভিপির বর্তমান ভারতনীতি চিহ্নিত করা উচিত হবে না।
তামিল জাতীয়তাবাদ নিয়ে জেভিপির অবস্থান জটিল বলে মনে হয়। নিজেদের তারা শ্রেণিভিত্তিক সংগঠন বলে দাবি করত। কিন্তু তামিলদের স্বাধিকার আন্দোলনে তাদের সংযুক্তি লক্ষ করা যায়নি।
১৯৮০-এর দশকের দিকে তারা তামিল বিদ্রোহকে সহানুভূতি নিয়ে দেখলেও দেশ ভাঙার বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নেয় জেভিপি। বাস্তবতা বোঝেন, এমন একজন মার্ক্সবাদী হচ্ছেন দিশানায়েকে—এমন বলেন তাঁর একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী। অনেক বিশ্লেষকের মতে, জেভিপি বাম দল হতে পারে, তবে হালে দিশানায়েকের অবস্থান মধ্য বামের দিকেই ইঙ্গিত করছে। এখন সময়ই বলে দেবে তিনি আসলে কতটা বিপ্লবী।
● অর্জুন জনার্দন ভারতীয় সাংবাদিক
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত