সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি নিয়ে কী করব

ছবি প্রতীকীপ্রথম আলো

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান এবং আরও কিছু জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করেছে। কমিশনগুলোর নেতৃত্বে আছেন দেশের অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা। সংবিধান সংস্কার সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা হবে এখানে।

বাংলাদেশের সংবিধান, যা ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গৃহীত হয়। তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৩৪ সদস্যের একটি কমিটি এ সংবিধান তৈরি করেন প্রায় নয় মাস কাজের পর। সংবিধানের চারটি মৌলিক নীতি ছিল—জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার, এবং ধর্মনিরপেক্ষতা।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে জাতীয়তাবাদ এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকার—এ দুটি মূলমন্ত্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অনুপ্রাণিত করে এবং ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকার এ মৌলিক নীতিগুলোকে সামনে নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনার শপথ নেয়। এ কারণে অনেকে বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতিগুলোকে আওয়ামী লীগের নীতি বলে প্রচার করে। কেউ কেউ বাংলাদেশের সংবিধানকে ভারতের সংবিধানের অনুকরণ বলেও মিথ্যা আখ্যান দেন।

কেউ কেউ বাংলাদেশের সংবিধানকে ভারতের সংবিধানের অনুকরণ বলেও মিথ্যা আখ্যান দেন। বস্তুত ভারতের সংবিধানে সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা গৃহীত হয় ১৯৭৬ সালে সংশোধনীর মাধ্যমে।

বস্তুত ভারতের সংবিধানে সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা গৃহীত হয় ১৯৭৬ সালে সংশোধনীর মাধ্যমে। বাংলাদেশের সংবিধান রচয়িতারা পৃথিবীর বহু উন্নত দেশের সংবিধান পর্যালোচনা করে এবং সেসব দেশের সংবিধানের বিশেষ বিশেষ ধারা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করেন।

বাংলাদেশ ১৯৭২-এর সংবিধানকে কতটা অনুসরণ করেছে? প্রথমেই আসে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা। গণতন্ত্রের প্রথম তিনটি নীতি হলো ব্যক্তি এবং বাক্‌স্বাধীনতা, সর্বজনীন ভোটাধিকার, এবং নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নিয়োগ। দুঃখের বিষয় এই তিনটিকেই নির্বাসন দিয়ে স্বাধীনতার মাত্র তিন বছর পর সংবিধান পরিবর্তন করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের জায়গায় দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়। এর ছয় মাসের মাথায় এক রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানে এ ব্যবস্থার অবসান হয়। পরের দুই দশক দেশে আর প্রকৃত গণতন্ত্র ফেরত আসেনি।

১৯৯১ সালে গণ-অভ্যুত্থানের পর গণতন্ত্র ফিরে আসে। কিন্তু তা প্রায় হোঁচট খেয়ে চলে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের পারস্পরিক বৈরিতা আর হিংস্রতার কারণে। নির্বাচনের প্রহসন আর ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যবহারে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের সাংবিধানিক মূলনীতি ভূলুণ্ঠিত হয়, বিশেষ করে গত পনেরো বছর।

জাতীয়তাবাদ এর মধ্যে বেঁচে আছে। তবে এর সংজ্ঞা ছিল বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম। দেশের জন্মলগ্নে জাতীয়তাবাদ ছিল বাঙালি চেতনা। পরে এল বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। বাঙালি বা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ যে নামেই ডাকা হোক না কেন এ পর্যন্ত জাতীয়তাবাদ কথাটি অক্ষত আছে আমাদের সংবিধানে।

তৃতীয় স্তম্ভ সমাজতন্ত্র নিয়ে আমাদের সংবিধানে বেশি দোলাচল হয়নি কোনো আমলে। এর কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেনি। বোধ করি কোনো দলই এ বিষয়ে বেশি মাথা ঘামায়নি, তাই কোনো উচ্চবাচ্য হয়নি, এবং এখনো হবে বলে মনে হয় না।

এই লেখাটির বিষয় বাংলাদেশের সংবিধানের চার মূলনীতিকে নিয়ে নয়। শুধু ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে। কারণ, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। ভাবতে হচ্ছে, আমাদের সংবিধানে সব ধর্মাবলম্বীর সম-অবস্থান ও সম-অধিকার থাকা সত্ত্বেও এ উদ্বেগ কেন হয়?

বঙ্গবন্ধু এক ভাষণে বলেছিলেন, সেক্যুলারিজম হচ্ছে—রাষ্ট্রে সব ধর্মের সম-অবস্থান। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার এক যুগ পরে এক সংশোধনীর মাধ্যমে জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে নিয়ে আসে। তখনো সেক্যুলারিজম বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতির অংশ হিসেবে থাকে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে শেখ হাসিনাও ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম রেখে কল্পিত সেক্যুলারিজমের ধোঁয়াশা বজায় রাখেন।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যে আদর্শের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল তার মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র স্থাপন ছিল অগ্রগণ্য। এর কারণও ছিল। ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ধর্মভিত্তিক দেশ চাপিয়ে আমাদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তাকে বিলীন করার চেষ্টা করে। এটা ছিল আমাদের বাঙালি পরিচয়কে মুছে একটি ধর্মের অনুসারী হিসেবে অন্যান্য জাতিসত্তার সঙ্গে মিলিয়ে এক পাকিস্তান গড়ার প্রয়াস। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এবং পরবর্তী সময়ে আমাদের সংবিধানে তাই ধর্মনিরপেক্ষতা একটি প্রধান মূলমন্ত্র ছিল।

কথা হতে পারে, আর তিনটি মূলমন্ত্র ছেড়ে ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে এত আলোচনা কি যৌক্তিক? হ্যাঁ, এর কারণ আছে। যে প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল বা প্রত্যক্ষ করেছিল তারা জীবনের নিয়মে ক্রমেই সংখ্যায় কমে আসছে। কিন্তু যে মূল্যবোধ ও আদর্শ যুদ্ধে আমাদের পথ দেখিয়েছে, সেগুলোও কি পিছিয়ে পড়বে, হারিয়ে যাবে?

আমাদের ইতিহাস, আমাদের সংস্কৃতি এবং মুক্ত নাগরিক হিসেবে সব নাগরিকের বেঁচে থাকার অধিকারের প্রতি আমাদের অবিচল বিশ্বাস আগামী প্রজন্মের জন্য একই রকম থাকা উচিত। আমাদের সংবিধান সেই নিশ্চয়তা দিয়েছে।

আমাদের শাসকেরা সময়ে সময়ে সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করেছেন জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য। আমরা আশা করেছিলাম সেই সাম্প্রদায়িক অতীত চিরতরে কবর দিয়েছি।

স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে ৫৩ বছর পরে কেন আমাদের এই ভয় করতে হচ্ছে। এর কারণ, গত ৫৩ বছরে আমাদের প্রত্যক্ষ করা রাজনৈতিক দৃশ্যপট। আমরা আমাদের সংবিধানের চারটি মূলনীতি পরিবর্তন করিনি। কিন্তু সংবিধানের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ কার্যকারিতা কমে যায় ১৯৮৯ সালে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করার মাধ্যমে। যে দেশের শতকরা ৯০ জন সমধর্মের, সে দেশের জন্য এই ঘোষণা প্রয়োজন ছিল না।

প্রশ্ন উঠতে পারে যে সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তন করা যদি দুজন সামরিক রাষ্ট্রপ্রধানের উদ্যোগে হয়ে থাকে, তবে পরবর্তী সময়ে দুটি গণতান্ত্রিক সরকার কেন তা পরিবর্তন করেনি বা করতে চেষ্টা করেনি। এই পরিবর্তনটি কারও রাজনৈতিক খেয়ালখুশিতে ঘটেনি। এটি ঘটেছিল আমাদের বাঙালি জাতীয় পরিচয়ের একটি স্পষ্ট রূপান্তরের ফলে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পুনরুত্থান ঘটার সঙ্গে তা ধীরে ধীরে আমাদের জাতীয় মননজগতে ফিরে আসছিল। সেই সঙ্গে একাত্তরে অর্জিত দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি ম্লান হতে শুরু করে।

আমাদের শাসকেরা সময়ে সময়ে সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করেছেন জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য। আমরা আশা করেছিলাম সেই সাম্প্রদায়িক অতীত চিরতরে কবর দিয়েছি। কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা লোকরঞ্জনবাদী কার্যকলাপ করেছেন। তাঁরা ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর সমর্থন আদায়ের জন্যও তা ব্যবহার করেছেন। তবু আমাদের দেশ মূলত ধর্মীয়ভাবে সহনশীল দেশ ছিল।

কিন্তু বাহ্যিক ঘটনা, অপপ্রচার এবং সাম্প্রতিক সময়ে অপ তথ্যের কারণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মাঝে ফাটল দেখা দিচ্ছে। আমরা প্রায়ই সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা এবং ধর্মান্ধতার শিকার হচ্ছি পক্ষপাতদুষ্ট রাজনীতি এবং সম্পত্তি দখলের লুণ্ঠনমূলক প্রবৃত্তি দ্বারা চালিত হয়ে। অনেক সময় মিথ্যা প্রচার এগুলো আরও বাড়িয়ে দেয়।

এ রকম অনেক ঘটনা প্রতিরোধযোগ্য হলেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। ভাবতে অবাক লাগে, যে দেশে ধর্ম ও জাতিসত্তার ঊর্ধ্বে সব সম্প্রদায়ের সমতার নীতি রয়েছে, সেখানে সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার এমন বিস্ফোরণ কেন ঘটবে?

আমাদের অন্তর্নিহিত কোনো দুর্বলতার কারণে কি আমরা প্রোপাগান্ডার প্রতি এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ছি? নাকি আমাদের সংবিধানে অন্তর্নিহিত মূল্যবোধগুলো সম্পর্কে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে আমরা যা জানাচ্ছি তাতে মৌলিক ক্ষেত্রেই কিছু ভুল আছে? কেন আমরা সব ধর্মের মানুষের মধ্যে মানবাধিকার ও ধর্মের সমতার মূল্যবোধ জাগ্রত করতে পারছি না?

আমাদের যা প্রয়োজন তা হলো, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং একে অপরের সম্পর্কে জানার বিষয়ে আরও উদ্যোগ। স্কুল, মাদ্রাসা এবং উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে আমাদের অবশ্যই এটি করা উচিত। এটাই একমাত্র উপায়, যার মাধ্যমে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সংবিধানের চতুর্থ স্তম্ভ সম্পর্কে জানাতে পারব। এই বোধ আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারলে ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক নেতা এ নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।

দীর্ঘ ষোলো বছরের কুশাসনের অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশ এক নতুন সাজে গড়বার সুযোগ পেয়েছে। দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য সংস্কারের আওয়াজ উঠেছে। নির্বাচনপ্রক্রিয়া, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আমলাতন্ত্র ইত্যাদির সঙ্গে দেশের সংবিধানকেও সংশোধন বা পরিবর্তনের দাবি শোনা যাচ্ছে। সেই প্রেক্ষাপটে একটিই আবেদন, যে মূলমন্ত্র আমাদের একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনকে উদ্বুদ্ধ করেছে, যেগুলো আমাদের ১৯৭২ সালের সংবিধানে লিপিবদ্ধ হয়েছে, সেই স্তম্ভগুলো যেন অটুট থাকে। আমাদের নেতারা এই মূলমন্ত্রগুলোকে সব ক্ষেত্রে পালন করেননি, তাই বলে একটি দেশের সংবিধানে এ মূলমন্ত্রগুলো যে প্রয়োজন, তা ভুললে হবে না।

  • জিয়াউদ্দিন চৌধুরী সাবেক সরকারি এবং বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তা