কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও পরবর্তী সংঘর্ষ–সহিংস পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই ২০২৪) সন্ধ্যার পর থেকে দেশজুড়ে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মঙ্গলবার (২৩ জুলাই ২০২৪) রাত থেকে সীমিত আকারে ইন্টারনেট চালু করা হয়। এ কয়দিনের প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকার সম্পাদকীয়, লেখা ও সাক্ষাৎকার ধাপে ধাপে অনলাইনে প্রকাশ করা হচ্ছে। এর জন্য পরবর্তী কিছু লেখাও অনলাইনে প্রকাশ করতে বিলম্ব হচ্ছে। বুধবার (২৪ জুলাই ২০২৪) ছাপা পত্রিকায় এ লেখা প্রকাশিত হয়।
সারা দেশে গত কয়েক দিন যাবৎ ইন্টারনেট বন্ধ রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিকল হয়ে পড়ায় তথ্যপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকার একতরফা ভাষ্য প্রচার করতে পারছে। সরকারের কথা শুনে মনে হচ্ছে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সব দাবি পূরণ হয়ে গেছে, ছাত্রদের হৃদয় প্রশান্ত হয়েছে, এখন যে ক্ষোভ বা নাশকতা চলছে, তা কেবলই বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠীর তৎপরতা।
এটি অনেকাংশে সঠিক নয়। উচ্চ আদালতের যুক্তিসংগত রায়ের মাধ্যমে ছাত্রসমাজের কোটা সংস্কার দাবিটি পূরণ হয়েছে বলা যায়। কিন্তু এর মধ্যে এ দাবি পূরণের পথ তাদের সহযোদ্ধা ও সহপাঠীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে, বহু ছাত্রসহ দেড় শতাধিক মানুষ জীবন হারিয়েছেন, আরও অনেক বেশি মানুষ গুলিবিদ্ধ ও আহত হয়েছেন, হাসপাতালে গিয়ে আহত মানুষ পুনরায় আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছাত্রসহ তাদের সমর্থকদের ওপর এ নির্বিচার আক্রমণ করেছে সরকারি দলের সংগঠন ও সরকারের বাহিনীগুলো এবং এসব আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে সরকারি দলের নেতাদের নির্দেশ বা উসকানিতে—এমন সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে।
এসব ঘটনা নিয়ে সরকারকে আদৌ বিচলিত মনে হচ্ছে না। সরকার বরং এসব নির্মম ঘটনাকে আড়াল করে সরকারি স্থাপনাগুলোতে নাশকতার বিষয়টি ফলাওভাবে প্রচার করে পুরো দায় বিরোধী দলের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে।
এটি পরিপূর্ণ সমাধানের পথ হতে পারে না। মানুষকে ভয় দেখিয়ে, নিপীড়ন করে সাময়িকভাবে দমন করা যায়, কিন্তু তার বুকের ক্ষত মোচন করা যায় না। মানুষের বুকে রয়েছে রংপুরের আবু সাঈদের বুকে পুলিশের গুলি চালিয়ে হত্যার মতো বহু দৃশ্য, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের লাঠিপেটা, রক্তাক্ত ও লাঞ্ছিত করার বহু টুকরা স্মৃতি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগকে নামানোর প্রকাশ্য নির্দেশ।
সরকারকে এসব ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে, নিজের দায় স্বীকার করতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা ফিরে এলে তাদের সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
সরকারকে, বিশেষ করে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের ওপর নিপীড়ন ও ভয়ভীতি প্রদর্শন বন্ধ করতে হবে। এত রক্তপাত ও অত্যাচারের পর এই আন্দোলনের অন্যতম নেতা মো. নাহিদ ইসলামকে রাতের আঁধারে তুলে নিয়ে নির্যাতনের যে সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তা খুবই উদ্বেগজনক। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাধারণ কর্মীরা কীভাবে সরকারের প্রতি আস্থা ফিরে পাবে?
কোটা সংস্কারের দু-একজন নেতা আন্দোলন সমাপ্তি হয়েছে বলে ঘোষণা করছে। নাহিদের ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর এটি তারা চাপের মুখে বা নির্যাতনের ভয়ে বাধ্য হয়ে করছে বলে ছাত্রদের মনে হতে পারে। এ নির্যাতন অন্যদের ওপরও করা হচ্ছে না বা ভবিষ্যতে প্রয়োগ করা হবে না—এ বিশ্বাস তাদের মনে কীভাবে আসবে, কীভাবে তাদের উদ্বেগ দূর হবে?
২.
সরকারের মধ্যে আন্দোলনকারীদের প্রতি বিদ্বেষ ভাব দূর করতে হবে। সরকারের মন্ত্রী, বাহিনীপ্রধান ও অনুগত আলোচকেরা উদ্বিগ্ন ও মর্মাহত হয়েছেন বাহিনীগুলোর সদস্যদের হতাহতে। পুলিশ হাসপাতালে আহত পুলিশদের দেখতে পুলিশপ্রধান যাচ্ছেন, আহত ছাত্রদের দেখতে সরকারের কেউ কেন যেতে পারলেন না?
বরং সেখানে সরকারের পেটোয়া বাহিনী আক্রমণ করার চেষ্টা করলে তাদের বিরত বা গ্রেপ্তারে কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। পুলিশের জীবন, নিরাপত্তা, চিকিৎসা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ছাত্রদেরটি নয় কেন সরকারের কাছে?
সরকারের লোকজনকে উদ্বিগ্ন হতে দেখা গেছে সরকারি স্থাপনাগুলোর ওপর আক্রমণের ঘটনায়ও। এসব স্থাপনার মালিক বাংলাদেশের মানুষ, এসব স্থাপনায় আক্রমণের বিচার অবশ্যই সরকারকে করতে হবে। কিন্তু এমন উত্তেজনাকর অবস্থায়ও এসব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষায় (বিশেষ করে ডেটা সেন্টার, যেখানে আগেও বিভিন্ন সময় আক্রমণের ঘটনা ঘটেছিল বলা হয়) পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা কেন নেওয়া হয়নি, সরকারকে তা ব্যাখ্যা করতে হবে।
সরকারি স্থাপনায় নাশকতার জন্য তদন্তের আগেই ঢালাওভাবে বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের দায়ী করে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কিন্তু আমরা বিএনপিকে প্রথম রাজনৈতিক কর্মসূচি (প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ) পালন করতে দেখেছি এসব অধিকাংশ নাশকতার ঘটনার পরে।
তা ছাড়া প্রচারমাধ্যম এবং টেলিযোগাযোগের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের পরও বিএনপির কেউ নাশকতার নির্দেশ দিয়েছে, এমন একটি প্রমাণ সরকার উপস্থাপন করতে পারেনি। এখন পুলিশের গ্রেপ্তারের পর কারও মুখ দিয়ে এ ধরনের স্বীকারোক্তি প্রচার করলে তার বিশ্বাসযোগ্যতা কীভাবে থাকবে?
গত বছর ২৮ অক্টোবর লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড হামলার পর যে বিএনপি পালিয়ে মাঠ ছেড়েছে, কী জাদুবলে তারা হঠাৎ সারা দেশে নাশকতার শক্তি অর্জন করেছে, তা নিয়ে মানুষের প্রশ্ন থাকবে। সরকারকে এসব বুঝতে হবে।
সরকারকে এসব নাশকতা গণমানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ কি না, তা-ও বিবেচনা করতে হবে। অতীতে যেকোনো গণ-আন্দোলনকে (নিরাপদ সড়ক, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট প্রত্যাহার, ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলন) সরকার বিএনপি-জামায়াতের উসকানি বলে তাচ্ছিল্য করেছে। কিন্তু এবারের আন্দোলনের পরিধি ও বিস্তৃতি অনেক ব্যাপক।
সন্তানসম শত শত ছাত্র এবং হাজারো মানুষের রক্তে রঞ্জিত এ আন্দোলন আপামর জনগণের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ কি না, এতে দ্রব্যমূল্য, দুর্নীতি, নিপীড়নে অতিষ্ঠ মানুষের ক্ষোভও যুক্ত হয়েছে কি না, সরকারকে তা নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। অযথা রাজনৈতিক হয়রানি বন্ধ করতে হবে।
সরকার ইন্টারনেট সেবা বন্ধের জন্যও বিরোধী দলের নাশকতাকে দায়ী করছে। আসলে নাশকতায় ডেটা সেন্টারের মাত্র ৩০ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে, এসব শোনা গেছে। বাস্তবতা হচ্ছে, এ জন্য অসীম ও নজিরবিহীন ভোগান্তির শিকার হচ্ছে দেশের কোটি কোটি মানুষ, বিপর্যস্ত হচ্ছে জনজীবন ও অর্থনীতি। এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার ব্যর্থতা সরকারের। সরকারকে অবিলম্বে ইন্টারনেট ব্যবস্থা পুরোপুরি সচল করতে হবে।
৩.
এবারের আন্দোলনে বিক্ষুব্ধ মানুষ আর অভিভাবকেরা রাস্তায় নেমেছেন, কিছু রাজনৈতিক দল সরকারের পদত্যাগ দাবি করেছে। এ দাবি মোকাবিলা করতে হলে সরকারকে আত্মসমালোচনা, সহমর্মিতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে এগোতে হবে।
এ জন্য প্রাথমিক ধাপ হচ্ছে হত্যাকাণ্ড ও আক্রমণের ঘটনাগুলোর বিচার, বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য গণরুমকেন্দ্রিক নির্যাতনের অবসান, বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি অযথা হয়রানি ও অপপ্রচার বন্ধ করা, অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করা। অবাধ তথ্যপ্রবাহ বন্ধ করা সরকারকে অবাধ নির্যাতন ও অপপ্রচারের সুযোগ করে দেয়। এটা মানুষ বোঝে না, এমন ভাবা ঠিক নয়।
মানুষের স্মৃতিতে বুলেটের ক্ষত, মানুষের বুকে অবিচার, বঞ্চনা, স্বজন আর সহপাঠী হারানোর ক্ষত। একতরফা প্রচারণা আর নিপীড়ন চালিয়ে এ ক্ষত মোচন করা যাবে না। মানুষের মনে আস্থা, বিশ্বাস আর স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। কীভাবে তা করা যাবে, তা নিয়ে আমরা কেউ কেউ বলছি। সরকারকে আরও বিস্তৃত ও গভীরভাবে করণীয় ঠিক করতে হবে।
আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক