বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ তরুণ। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। এ বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীই ভবিষ্যতের বাংলাদেশ। সঠিক দিকনির্দেশনা, শিক্ষা ও সুযোগ না থাকলে দেশের অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতি ঝুঁকির মুখে পড়বে।
এই তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাঁরা নিজের কর্মসংস্থান নিজেরাই তৈরি করতে চান। এ প্রবণতা বেকারত্ব দূর করে নতুন শিল্প ও সেবা খাত সৃষ্টি করে অর্থনীতিকে গতিশীল করবে। আমাদের দেশের তরুণেরা জলবায়ু পরিবর্তন, লিঙ্গসমতা ও সুশাসন নিয়ে সচেতন। তাঁরা সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনে আগ্রহী। ভোটাধিকার প্রয়োগে তাদের অংশগ্রহণ ভবিষ্যতের নেতৃত্ব নিশ্চিত করবে। তবে তরুণদের এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে উচ্চমানের শিক্ষা, কর্মমুখী প্রশিক্ষণ ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ওপর জোর দিতে হবে।
সম্প্রতি সমসাময়িক বাংলাদেশে তরুণসমাজের অবস্থান, চিন্তা ও প্রত্যাশা নিয়ে একটি জরিপ হয়েছে। ইয়ুথ ম্যাটার্স সার্ভে নামের এই জরিপ আয়োজন করে বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার (বিওয়াইএলসি)। এতে সরাসরি ও অনলাইনে অংশ নেন যথাক্রমে ১ হাজার ৫৭৫ ও ১ হাজার ৬৬৩ জন তরুণ। জরিপটি ২০২৪ সালের অক্টোবর ও নভেম্বর মাসজুড়ে দেশের বিভিন্ন অংশে পরিচালিত হয়। জরিপে শিক্ষার মান, স্বাস্থ্যসেবা, জীবিকার উপায়, জলবায়ু পরিবর্তন, গণতন্ত্র, সুশাসনসহ নানান বিষয় নিয়ে তরুণদের মতামত নেওয়া হয়েছে। জরিপ থেকে পাওয়া তথ্য আগামীর বাংলাদেশের বিবেচ্য বিষয় নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছে।
জীবনযাত্রার ব্যয় ও মানসিক স্বাস্থ্য
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তরুণদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন ৭৫ দশমিক ১ শতাংশ সরাসরি ও ৬৪ দশমিক ৮ শতাংশ অনলাইনে অংশগ্রহণকারী। এটি দেশের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের একটি বড় উদাহরণ। তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে তরুণদের মনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কেবল একটি অর্থনৈতিক সমস্যা নয়; এটি সামাজিক ও মানসিক স্বাস্থ্যেও গভীর প্রভাব ফেলছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে তরুণদের মধ্যে হতাশা, উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা বাড়ছে। শিক্ষার্থীরা তাঁদের দৈনন্দিন খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। কর্মজীবী তরুণেরা বেতন ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে পারছেন না। এর ফলে অনেকেই মানসিক চাপ ও হতাশায় ভুগছেন। দীর্ঘ মেয়াদে এটি তরুণদের কর্মক্ষমতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ও সামগ্রিক জীবনের মানকে প্রভাবিত করবে।
নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা
জরিপ অনুযায়ী, তরুণদের মধ্যে ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ সরাসরি ও ৭০ শতাংশ অনলাইনে অংশগ্রহণকারী মনে করেন, বর্তমান বাংলাদেশে নারীরা পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বোধ করছেন না। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ৭০ শতাংশ তরুণ মনে করেন, বর্তমানে নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক একটি চিত্র। সমাজে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সামাজিক অংশগ্রহণে নারীদের সমান সুযোগ দিতে হলে এই নিরাপত্তা সমস্যার সমাধান করতে হবে।
উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা
তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহ বাড়ছে। জরিপে দেখা গেছে, ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ সরাসরি এবং ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ অনলাইনে অংশগ্রহণকারী ভবিষ্যতে উদ্যোক্তা হতে চান। অর্ধেকের বেশি তরুণ নিজের পেশা হিসেবে উদ্যোক্তা হওয়ার কথা ভাবছেন। এটি একটি ইতিবাচক পরিবর্তন। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে উদ্যোক্তা সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে উদ্যোক্তাদের জন্য সহজলভ্য ঋণ, প্রযুক্তিগত সহায়তা ও সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব রয়েছে। এই বাধাগুলো কাটিয়ে উঠতে সরকার ও বেসরকারি খাতকে একত্রে কাজ করতে হবে।
শিক্ষার মান ও ছাত্ররাজনীতি
শিক্ষার মান উন্নয়নে তরুণেরা গুরুত্ব দিয়েছেন। ৭১ শতাংশ সরাসরি ও ৮৬ দশমিক ৪ শতাংশ অনলাইনে অংশগ্রহণকারী মনে করেন, ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি শিক্ষার অবাধ পরিবেশ নষ্ট করছে। এটি একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা। সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে এটি ধীরে ধীরে সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। তবে শিক্ষাব্যবস্থা কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা দিচ্ছে কি না, এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। সরাসরি জরিপে ৭৭ দশমিক ৪ শতাংশ এ ব্যবস্থাকে কার্যকর মনে করলেও অনলাইনে অংশ নেওয়া ৭৯ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ তেমন মনে করেন না।
ভোটাধিকার ও বিদেশে স্থায়ী হওয়ার চিন্তা
জরিপে অংশ নেওয়া ১৮ বছর বা তদূর্ধ্ব তরুণদের ৯৫ দশমিক ৫ শতাংশ সরাসরি ও ৯৫ দশমিক ৭ শতাংশ অনলাইনে অংশগ্রহণকারী আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তবে ২১ দশমিক ৮ শতাংশ সরাসরি ও ৪৭ দশমিক ৮ শতাংশ অনলাইনে অংশগ্রহণকারী জানিয়েছেন, তাঁরা বিদেশে স্থায়ী হতে চান। এই তথ্য উদ্বেগজনক। তরুণদের দেশপ্রেমের সঙ্গে নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার সুযোগ দেওয়া দরকার।
বাংলাদেশের যুবসমাজ একটি সম্ভাবনাময় শক্তি। কিন্তু তাদের সমস্যাগুলো সমাধানে দৃষ্টি না দিলে এই শক্তি অপচয় হতে পারে। জরিপে পাওয়া তথ্যগুলো নীতিনির্ধারকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের উন্নয়নপরিকল্পনায় তরুণদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। তরুণদের মতামত দেশের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে তাঁদের মতামত ও প্রত্যাশা বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে সময়ের দাবি।
নাফিসা নাজীন লুৎফা প্রভাষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, n.n.lutfa@bup.edu.bd
জাহিদ হোসাইন খান গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, zahid.pen@gmail.com