রাখাইন রাজ্যে একটি শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে আরাকান আর্মি জোট গঠন করেছে এবং ভৌগোলিক ও অন্যান্য সুবিধাকে কাজে লাগিয়েছে।
মিয়ানমারে সক্রিয় সব জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনের মধ্যে আরাকান আর্মি মাত্র দুই দশকের মধ্যেই সবচেয়ে বড় ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। দক্ষিণ চিন রাজ্য, রাখাইন রাজ্যসহ আরাকানের একটি বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এলাকায় সংগঠনটি ইতিমধ্যে সামরিক জান্তার কাছ থেকে ১৩টি টাউনশিপ মুক্ত করেছে।
২০০৯ সালে কাচিনে ২৬ সদস্যের উদ্যোগে কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মির সহায়তায় আরাকান আর্মি গঠিত হয়। ২০১৫ সালে সংগঠনটি উত্তর রাখাইন রাজ্যে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই শুরু করে। পরবর্তী পাঁচ বছরে যুদ্ধ মাঝেমধ্যে স্থগিত ছিল।
২০২০ সালের নভেম্বরে আরাকান আর্মি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে একটি অনানুষ্ঠানিক অস্ত্রবিরতি চুক্তি করে। তবে ২০২২ সালের শুরুর দিকেই লড়াই আবার শুরু হয়। ওই বছরের নভেম্বরে আরেকটি নড়বড়ে অস্ত্রবিরতি কার্যকর হলেও ২০২৩ সালের ১৩ নভেম্বর আরাকান আর্মি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে পূর্ণমাত্রার আক্রমণ শুরু করে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
আরাকান আর্মির এ সাফল্যের পেছনের কারণ কী? দ্য ডিপ্লোম্যাটে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এর সর্বাধিনায়ক টোয়ান ম্রাট নাইং উল্লেখ করেন যে মুক্তির লক্ষ্যে আগের প্রজন্মের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার পাশাপাশি এর নেতৃত্ব, সাংগঠনিক দক্ষতা এবং জোটগুলো একটি শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে সহায়ক হয়েছে। এ আন্দোলন পরিচালনা করে আরাকান আর্মি এবং এর রাজনৈতিক শাখা ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান।
এ অঞ্চলে আমার ভ্রমণ, পর্যবেক্ষণ এবং আরাকান আর্মি ও লিগ অব আরাকানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে এ সংগঠনের সাফল্যের পেছনে পাঁচটি প্রধান কারণকে চিহ্নিত করা যায়।
নেতৃত্বই সাফল্যের মূল চাবিকাঠি
৩০ জুন দ্য ডিপ্লোম্যাটকে ম্রাউক ইউ ও আশপাশের কিয়াউকতাউ এলাকার রাজনৈতিক কমিশনার এবং ইউনাইটেড লিগ অব আরাকানের প্রবীণ সদস্য উ হ্লা সাও সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে তাঁরা আরাকান আর্মির সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হিসেবে নেতৃত্বকে চিহ্নিত করেন। সেই সঙ্গে আছে সব সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা। পূর্ববর্তী সংগঠনগুলোর মতো জাতি বা ধর্মের ভিত্তিতে কোনো বৈষম্য এখানে নেই।
কাচিনে প্রশিক্ষণ শুরুর আগেই একটি রোডম্যাপ চূড়ান্ত করা হয়। ২০০৯ সাল থেকে দুই বছরের মধ্যে চারটি ব্যাচে প্রায় ৪০০ যোদ্ধাকে কাচিন থেকে প্রস্তুত করা হয়। এরপর প্রশিক্ষিত সদস্যদের মাটির বাস্তবতা বুঝে ইয়াঙ্গুন, সিত্তে ও মান্দালয়ে নেটওয়ার্ক গড়ার জন্য নিয়োজিত করা হয়। পাশাপাশি রাখাইনে ছাত্রনেতা ও ভিক্ষুদের চিহ্নিত করে একটি নেটওয়ার্ক গড়ার কাজ শুরু হয়। ২০১৪ সাল থেকে আরাকান আর্মির কর্মীরা বিভিন্ন স্থানে গোপনে বসতি স্থাপন করে।
আরাকান আর্মির আঞ্চলিক পরিচালক এক কর্নেল বলেন, ‘আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল আরাকানের উত্তরাঞ্চল। এর মধ্যে পলেটওয়া ও দক্ষিণ চিন রাজ্যে মিয়ানমার, ভারত ও বাংলাদেশের ত্রিমোহনী এলাকা ছিল। কারণ, এ অঞ্চল ভারত ও বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য পথ নিয়ন্ত্রণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’ আরাকান স্টাডিজ সেন্টারের ২০২৪ সালের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী আরাকান আর্মির ‘অস্ত্র ও গোলাবারুদ স্থল ও জলপথে সরবরাহ করা হয়’।
২০১৫ সালে ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান গঠন করে অঞ্চলে প্রশাসনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা হয়। যুদ্ধ তীব্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কার্যক্রম পরিচালনায় আরও সমন্বয় ও দক্ষতার লক্ষ্যে নয়টি সামরিক আঞ্চলিক কমান্ড গঠন করা হয়, যা পরিচালনা করে গোপন অবস্থানে থাকা যুদ্ধ কার্যালয়।
প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জোট
আরাকান আর্মি বিভিন্ন প্রতিরোধ সংগঠনের সঙ্গে জোট গঠনের মাধ্যমে তাদের শক্তি ও প্রভাব বাড়িয়েছে। বর্তমানে তাদের সেনারা কায়িন, শান, কাচিন রাজ্য এবং সাগাইং ও মাগওয়ে অঞ্চলে মোতায়েন রয়েছেন। ২০১৫ সালে আরাকান আর্মি টাং জাতীয় মুক্তিবাহিনী, মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি ও কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মির সঙ্গে নর্দান অ্যালায়েন্স গঠন করে। ২০১৯ সালে তারা থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স তৈরি করে। জোটগুলো আরাকান আর্মিকে সম্পদ ও সমর্থন সংগ্রহ এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর কাছ থেকে যুদ্ধকৌশল শিখতে সাহায্য করেছে। এই বিভিন্ন প্রতিরোধ গোষ্ঠী এক হয়ে সরকারি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশনও চালিয়ে থাকে।
অভ্যুত্থানের পর গঠিত নির্বাসিত সরকার ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের সঙ্গে আরাকান আর্মি আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত না হলেও তারা পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেসকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করেছে। চিন রাজ্যের চিন ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সঙ্গে তাদের জোট গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি ভারতীয় সীমান্ত থেকে সরবরাহ লাইন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ উত্তর রাখাইনের আরও এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আরাকান আর্মির স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্য বাস্তবায়িত হলে শুধু মিয়ানমার নয়, পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনীতিতে এর বড় প্রভাব ফেলবে।
আরাকান আর্মির শক্তি তরুণ ও নিবেদিতপ্রাণ যোদ্ধারা
আরাকান আর্মির সাফল্যের বড় কারণ তাদের তরুণ ও নিবেদিতপ্রাণ যোদ্ধাদের বিশাল দল। এ কথা বুথিডাংয়ের পুলিশপ্রধান অং কিউ কিউর। কিউ গত ১৮ মে আরাকান আর্মির হাতে বন্দী হয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘তাদের যোদ্ধাদের মধ্যে উদ্দীপনা অত্যন্ত প্রবল। আর এটাই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর মধ্যে অনুপস্থিত।’
অং আরও বলেন যে আরাকান আর্মির জনপ্রিয়তার মূল ভিত্তি জনগণের সমর্থন। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কিছু গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে বেসামরিক লোকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে। এতে আরাকান আর্মি আরও শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছেছে।
বর্তমানে আরাকান আর্মি আরাকানের ৮০ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের অগ্রগতি অব্যাহত থাকলে পুরো অঞ্চল দখল করা সম্ভব। তাদের অধিকাংশ যোদ্ধার বয়স ২০-৩০ বছরের মধ্যে। অন্যান্য গোষ্ঠীর মতো জোরপূর্বক নিয়োগের পথে না গিয়ে তারা সেসব অঞ্চল থেকে যোদ্ধা সংগ্রহ করে, যেসব জায়গায় ৭৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে।
তাদের নিয়োগপ্রক্রিয়া কঠোর। সেখানে শারীরিক স্বাস্থ্য, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অতীত আচরণ যাচাই করা হয়। ৩৫ বছরের বেশি বয়সীদের সাধারণত রাজনৈতিক শাখায় যুক্ত হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
আরাকান আর্মির প্রতিদ্বন্দ্বী নেই
মিয়ানমারের অন্যান্য অঞ্চলে প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত দেখা গেলেও আরাকানে সংখ্যাগরিষ্ঠ রাখাইন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে আরাকান আর্মির কোনো উল্লেখযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। দক্ষিণ চিন রাজ্যে সক্রিয় ছোট গোষ্ঠী সিডিএফ পলেটওয়া মূলত চিন সম্প্রদায়ের সমর্থন নিয়ে কাজ করে। আরাকান আর্মির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক।
বুথিডাং ও মংডুর মতো অঞ্চলে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে আরাকান আর্মির কিছুটা উত্তেজনা রয়েছে। তবে এসব গোষ্ঠীর প্রভাব কমে গেছে। কারণ, অনেক সদস্য অঞ্চলটি মুক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে। আগে আরাকানে কিছু প্রতিদ্বন্দ্বী সশস্ত্র গোষ্ঠী থাকলেও আরাকান ন্যাশনাল কাউন্সিল এখন প্রায় বিলুপ্ত।
আরাকান লিবারেশন পার্টি ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এর একটি অংশ সামরিক জান্তার সঙ্গে সহযোগিতা করছে, যা তাদের অবস্থান আরও দুর্বল করেছে। আরাকান আর্মি ও তাদের রাজনৈতিক শাখা ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান জনগণের গভীর ক্ষোভ ও প্রত্যাশাকে কাজে লাগিয়ে ব্যাপক সমর্থন অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
ভূপ্রকৃতির সুবিধা
আরাকান আর্মির অভিযানগুলোর সফলতার অন্যতম কারণ রাখাইনের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য। আলফা ২ সামরিক অঞ্চলের কমান্ডার কর্নেল টোয়ান ইয়াই বলেন, ‘আমরা এখানেই (রাখাইন) জন্মেছি, বেড়ে উঠেছি। স্থানীয় ভৌগোলিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের গভীর জ্ঞান রয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীতে কোনো রাখাইন কর্মকর্তা নেই। তাদের সব কর্মকর্তাই বাইরের।’
রাখাইনের ভূপ্রকৃতি মিয়ানমারের অন্যান্য সীমান্ত অঞ্চলের তুলনায় আলাদা। এখানে সর্বত্র নদী ও খালের বিস্তার। এখানে রাস্তাঘাট খারাপ। নদীগুলোই পরিবহন ও যোগাযোগের মূল মাধ্যম। যুদ্ধের আগে থেকেই আরাকান আর্মি যোদ্ধা ও সামগ্রী দ্রুত পরিবহনের জন্য স্পিডবোটসহ স্থানীয় নৌকা ব্যবহার করে নদীপথে কার্যকর একটি ব্যবস্থা তৈরি করে। সেনাবাহিনী রাস্তার ওপর নির্ভরশীল। ফলে প্রায়ই সমস্যায় পড়ে আর হামলার শিকার হয়।
আরাকান আর্মির আরও একটি সুবিধা হলো তাদের দক্ষ যোগাযোগব্যবস্থা। স্যাটেলাইট ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট ফোন ও ওয়াকি-টকির মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান করে তারা। কোথাও যোগাযোগের সমস্যা হলে সদস্যরা পাহাড়ের চূড়ায় স্থায়ীভাবে অবস্থান করে বার্তা রিলে করেন।
এসব দক্ষতার কারণে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ উত্তর রাখাইনের আরও এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আরাকান আর্মির স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্য বাস্তবায়িত হলে শুধু মিয়ানমার নয়, পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনীতিতে এর বড় প্রভাব ফেলবে।
রাজীব ভট্টাচার্য আসামের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
দ্য ডিপ্লোম্যাট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ জাভেদ হুসেন