সহিংসতার এপিঠ-ওপিঠ এবং বয়ান ভাঙার রাজনীতি

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের রূপসী এলাকায় গাজী টায়ার কারখানায় লুটপাটের সময় আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়ছবি: দিনার মাহমুদ

গত জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে দেশের পরিস্থিতির খোঁজখবর যাঁরা রেখেছেন, তাঁরা নাশকতা, সহিংসতা—এ–জাতীয় শব্দগুলো সবচেয়ে বেশি শুনতে পেয়েছেন। এটা নতুন কিছু নয়।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক আলোচনা বা ডিসকোর্সে ‘নাশকতা’, ‘ভাঙচুর’, ‘সহিংসতা’র মতো শব্দগুলো বহুল ব্যবহৃত। মতাদর্শনির্বিশেষে সব রাজনৈতিক দলই এসব শব্দের নিপুণ প্রয়োগের ওপর নির্ভর করে থেকেছে দিনের পর দিন।

তবে এ শব্দগুলোকে অর্থপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক করে তুলতে যে বয়ান (ন্যারেটিভ) তৈরি ও প্রচার করা হয়, তা সময় ও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভিন্ন হতে পারে। এমন একটি ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করা যায় সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশের ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’, যা পরবর্তী সময়ে রূপ নেয় সরকার পতনের এক দফা দাবিতে। বরাবরের মতোই এর পেছনে সহিংসতার ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য।

তবে এই আন্দোলনে সহিংসতার দুটি দিক রয়েছে—আন্দোলনকালে ও আন্দোলনপরবর্তী সহিংসতা। এই লেখার উদ্দেশ্য হলো এ দুই ভিন্ন সময়ের সহিংসতা কীভাবে ন্যায্যতা পেল এবং তার পেছনে ‘বয়ান’ বা ‘ন্যারেটিভ’–এর কী ভূমিকা, তা বোঝার চেষ্টা করা।

কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে শুরু করা এ আন্দোলন গোড়া থেকেই ছাত্রনির্ভর ও অহিংস হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী সরকার একে নানা রকম তকমা দিয়ে কঠোরভাবে দমনের চেষ্টা করেছে। আন্দোলনকারীদের বিরোধীদলীয়, স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি ইত্যাদি তকমা দিয়েছে।

প্রসঙ্গত, প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামী লীগ ফ্রেমের বাইরে পড়ার সুযোগ রয়েছে’ শিরোনামের একটি কলামের অংশবিশেষ উল্লেখ করা প্রয়োজন—
‘শেখ হাসিনা একনায়ক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে যে চারটি ন্যারেটিভের আশ্রয় নিয়েছিলেন, তা হলো বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, উন্নয়ন, স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি।’

‘স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি’ বয়ানের আলোকেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের কোটা সংস্কারের ন্যায্য দাবিকেও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং এরই সূত্র ধরে তাঁর মন্তব্যে উচ্চারিত হয় ‘রাজাকার’ শব্দটি। ফলে বিদ্রূপ হিসেবে নিজেদের ‘রাজাকার’ বলে স্লোগান দিতে শোনা যায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের। তার পর থেকে শুরু হয় সেই স্লোগানের ব্যবচ্ছেদ, তথা বয়ান প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ।

আওয়ামী সরকার দাবি করে, আন্দোলনকারীরা আসলেই মহান মুক্তিযুদ্ধবিরোধী; তা না হলে ‘রাজাকারের’ মতো ঘৃণ্য শব্দ প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করতেন না। অতএব তাঁদের যে উপায়েই হোক দমন করা বাঞ্ছনীয়।

সাবেক সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এ প্রসঙ্গে বলেন, শিক্ষার্থীরা ‘রাজাকার’ বলে স্লোগান দেওয়ার যে স্পর্ধা দেখিয়েছেন, তার সমুচিত জবাব দিতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট। পরবর্তী সময়ে এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে ভূমিকা রেখেছে, সেটিও এ বয়ানকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করারই প্রচেষ্টা।

এখন প্রশ্ন আসতেই পারে, স্বৈরাচারী সরকার যেমন মর্জি তেমন করতে পারে, তাদের জন্য ঘুরেফিরে স্বাধীনতাবিরোধিতার প্রসঙ্গ উত্থান করার প্রয়োজনীয়তা কী ছিল? বারবার এই শব্দগুলো কেন শুনতে হয়েছে নাগরিকদের? উত্তরে বলা যায়, বয়ান বা ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করা হয় এভাবেই; কিছু শব্দ, কিছু বাক্য, কিছু ধারণার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েই তৈরি ও প্রচার করা হয় এসব বয়ান।

আন্দোলনকারীরা ছাত্র নন, বরং তাঁরা স্বাধীনতাবিরোধী; তাঁরা দুষ্কৃতকারী, জামায়াত, বিএনপি—বারবার এসব বলার মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের আক্রমণ, হত্যা, অপহরণ, গ্রেপ্তারকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ‘দুষ্কৃতকারী’, ‘জামায়াত’, ‘বিএনপি’—এ শব্দগুলোও আওয়ামী বয়ানেরই অংশ।
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ‘বয়ান’ তৈরির চর্চা বেশ পুরোনো। ক্ষমতাসীন দলের মতের বিরুদ্ধে কেউ থাকলেই তার প্রতি সহিংসতা ন্যায্য। সাধারণ মানুষের মনোজগতেও এটি গেঁথে দিতে সফল হয়েছে এ দেশের রাজনৈতিক ডিসকোর্স।

অনেক মানুষ মেনে নিয়েছে যে সহিংসতা ছাড়া রাজনীতি হয় না। তাই দেশে চলতে থাকা এই নৈরাজ্যকে অনেকেই দেখেছে ‘রাজনৈতিক’ বিষয় হিসেবে। তবে ‘সহিংসতা’র আধিপত্যশীল বয়ান থেকে জনগণের মোহভঙ্গ হয় তখনই, যখন আন্দোলনকে ছাপিয়ে বুলেট পৌঁছে যায় আন্দোলনে অংশ না নেওয়া মানুষের ঘরের বারান্দায় কিংবা ছাদে। তারই ফলস্বরূপ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মানুষ রুখে দাঁড়ায় নির্বিচার হত্যার বিরুদ্ধে এবং পতন হয় স্বৈরশাসকের।

কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বদলে যেতে থাকে সহিংসতাকে ঘিরে জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি। শুরু হয় গণভবন লুটপাট, সংসদ ভবনে আনন্দ-উল্লাসের নামে ভাঙচুর, আওয়ামী লীগের মন্ত্রী থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের কর্মীদের ওপর হামলা। চলে থানায় জ্বালাও-পোড়াও, পুলিশের ওপর আক্রমণ ও ভাস্কর্য ভাঙচুর। এগুলোকে অহিংস বলার কোনো অবকাশ নেই। এই প্রান্তের সহিংসতার কারণ ও বয়ান তৈরি হয়েছে মুহূর্তেই, তা–ও সামগ্রিকভাবে। এ বয়ান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, কোনো রকম প্রচারণা ছাড়াই।

এ বয়ানের মূলে ছিল মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ভোটাধিকার হারানো, মতপ্রকাশে বাধা, দলীয়করণের চাপে পিষ্ট হওয়া, ক্ষমতার চরম অপব্যবহার ইত্যাদি। কোণঠাসা হয়ে ছিল সব শ্রেণির মানুষ, নাভিশ্বাস উঠেছিল জনজীবনে। তাই এখন যেন তা সুদে-আসলে ফিরে পাওয়ার উপযুক্ত সময়।

কড়াইলের নিম্ন আয়ের বসতির (তথাকথিত বস্তি) বাসিন্দা রোকেয়ার (ছদ্মনাম) ভাষায়, ‘আফা, আমরার এলাকার নেতারে তো মাইনষে এমন মাইর দিছে, হে হের বউ–বাচ্চা লইয়া বাড়িঘর থুইয়া ভাগছে। এহন তো মাইর খাইবোই, এত দিন নেতাগিরি কইরা মাইনষের ট্যাহা মাইরা খাইছে আর দুতালা বিল্ডিং দিছে। এসি-মেসি লাগাইয়া কী বিশাল অবস্থা! এহন মাইনষে সুযুগ ফাইছে, এহন তো তারে মারবোই।’

শুনে মনে হলো যেন সবার সব অভিযোগ ও আক্রোশের প্রতিনিধিত্ব করছে এই কথাগুলো। এখান থেকে ধারণা পাওয়া যায়, কেন আন্দোলনপরবর্তী সহিংসতা সামগ্রিকভাবে ন্যায্যতা পেল, কেন মানুষ এটাকে আর অন্যায্য হিসেবে বিবেচনা করল না এবং কেন মানুষ নিজের কাঁধে তুলে নিল অন্যায়ের বিচার করার দায়িত্ব।

শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর পাওয়ার পর রাতারাতি পাল্টে গেল সহিংসতার প্রতি মানুষের মনোভাব। পুরোনো বয়ান ভেঙে নতুন বয়ান তৈরি হলো। এক রাতের ব্যবধানে যাঁরা এত দিন অন্যায় করেছেন, তাঁদের আক্রমণ করা, প্রতিশোধ নেওয়ার ঘটনা ঘটল। এটাই যেন তাঁদের প্রাপ্য।

তবে এটা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই যে কিছু সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী এই বয়ানের সুযোগ নিয়ে নিজেদের পার্থিব লালসা মেটাতে করেছে লুটপাট, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা। তাদের সহিংসতা নিঃসন্দেহেই এই বয়ানবহির্ভূত। কারণ, যাদের অপরাধপ্রবণতা রয়েছে, তারা সুযোগ পেলেই অপরাধে লিপ্ত হতে পারে, তার জন্য কোনো বিশেষ ন্যারেটিভ প্রয়োজন নেই।

আন্দোলনপরবর্তী সহিংসতা যে জমে থাকা আক্রোশ আর তা থেকে মুক্তির আনন্দের সংমিশ্রণের বহিঃপ্রকাশ, তার প্রমাণ মেলে যখন আমরা দেখতে পাই গণভবন থেকে লুট করা জিনিসপত্র ফেরত দেওয়ার অনুরোধে মানুষ সাড়া দেয় এবং তাদের এই আবেগতাড়িত আচরণের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে। তবে কারণ বা বয়ান যা–ই হোক না কেন, সহিংসতা সর্বদাই পরিত্যাজ্য।

বয়ান তৈরি, প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কোন বয়ান কেন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, এর উদ্দেশ্য কী এবং ফলাফল কী হতে পারে, সেসব ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন গণমাধ্যমকর্মী, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী এবং সমাজের সব দায়িত্বশীল মানুষের।

  • রাবিনা সুলতানা গবেষণা সহযোগী
    ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়