ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফুলপরী খাতুন সাহস করেছেন। তাঁর ওপরে ছাত্রলীগ নেত্রীর অকথ্য নির্যাতনের কথা মুখ ফুটে বলেছেন। বিচার চেয়েছেন। উচ্চ আদালত, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সরব হয়েছে।
ছাত্রলীগ নেত্রী তাঁকে বিবস্ত্র করে তাঁর গায়ে সেফটিপিন ফুটিয়েছেন, এই রকম ভয়ংকর সব অভিযোগ করেছেন ফুলপরী। ফুলপরী একা নন, নানা সময়ে এ রকম নিপীড়নের শিকার হয়েছেন আরও অনেকে। আর ফুলপরী যখন অত্যাচারিত হয়ে আর্তনাদ করছিলেন, তখন ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছিলেন আশপাশের অনেক ছাত্রী।
সারা বাংলাদেশে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হাজারো ফুলপরী নির্যাতনের শিকার। হাজারো সানজিদা চৌধুরী কায়েম করেছেন ত্রাসের রাজত্ব। সংবাদমাধ্যমগুলো ছাত্রলীগের নেতাদের নানা ধরনের অপকর্ম আর অপরাধমূলক কর্মের খবরে আকীর্ণ! অন্য কোনো দল বা মতের লোকদের তো সভা-মিছিল করতে দেওয়ার প্রশ্নই নেই, তাদের নিজেদের মধ্যে মারামারি–হানাহানির খবর পড়তেই তো আমাদের দিন কাবার।
আগে ছাত্রলীগ মারামারি করত অন্য সংগঠনের সঙ্গে, তারপর করতে শুরু করল নিজেরা নিজেরা, এখন তাদের লক্ষ্য হলো সাধারণ নিরীহ ছাত্রছাত্রী। একে চড় মারা, ওকে কান ধরে ওঠবস করানো থেকে শুরু করে ভয়াবহ নির্যাতনের অভিযোগ উঠছে সংগঠনটির অনেক নেতার বিরুদ্ধে।
এই হতাশার মধ্যেও আশা খুঁজতে হবে। সুড়ঙ্গের শেষে খুঁজতে হবে আলো। আরেকটা কথাও আছে, এক লোক সুড়ঙ্গের শেষে আলো দেখে আশাবাদী হয়ে উঠেছে, এই বুঝি টানেল শেষ হচ্ছে। এই সময় সে টের পেল, এটা একটা ট্রেন। আসছে। আর পালানোর পথ নেই। আমাদের সামনে আশার প্রতীক হলেন ফুলপরী। বাবা ভ্যানচালক। কিন্তু এই বাবার সন্তানেরা লেখাপড়া করছেন। ফুলপরী সাহসের সঙ্গে মাথা তুলে কথা বলছেন। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত তাঁর শিক্ষা বৃথা যায়নি। তাঁর শিক্ষা তাঁকে বিবেক দিয়েছে। সাহস দিয়েছে। মর্যাদাবোধ দিয়েছে।
এর মধ্যে ঢাকার একটা মেয়েদের কলেজ ছাত্রলীগের নেত্রীদের বিরুদ্ধে আরেক নেত্রী যেসব অভিযোগ তুলেছেন, সে প্রসঙ্গে কলম চালানোতেও আমার রুচি ও বিবেক বাধা দেয়। কয় দিন আগে সেই একই কলেজে এক ছাত্রীকে স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে নির্যাতন করেছেন রোকসানা আক্তার নামের এক ছাত্রলীগ নেত্রী। যদিও এসব ঘটনা কলেজটিতে নতুন কিছু নয়।
বইমেলায় পুলিশ সেজে স্টল থেকে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে ছাত্রলীগের পদধারীরা গ্রেপ্তার হয়েছেন। বড় ঠিকাদারি থেকে বড় বড় অঙ্কের চাঁদার ভাগ নেওয়ার কেলেঙ্কারি প্রকাশ হয়ে হইচই পড়েছে অতীতে। এখন ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে গেস্টরুম–আতঙ্ক। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ছাত্রলীগ নেতারা গেস্টরুমে ডেকে নেন এবং শারীরিক–মানসিক নির্যাতন করেন।
আমরা তো ১৯৮০-এর দশক পর্যন্তও ছাত্ররাজনীতি চলতে দেখেছি আদর্শের জন্য। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী তখন স্বপ্ন দেখতেন বৈষম্যহীন, শোষণহীন সমাজের। আন্দোলন করতেন অসাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতির জন্য। রাজপথের আন্দোলন ছিল দেশে গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। তখনো নেতাদের পোশাক ছিল খদ্দরের পাঞ্জাবি। তার আগের প্রজন্মের রাজনীতিবিদেরা নিজেদের জীবন ও ভবিষ্যৎ উৎসর্গ করেছিলেন দেশের জন্য, মানুষের জন্য।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়ে দেখুন, কী ভয়াবহ কষ্ট তিনি করেছেন দেশের মানুষের মুক্তির জন্য। রংপুর অঞ্চলের আইনপ্রণেতার কাছে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল, আইনপ্রণেতা যাতে নিজের দলের বিরুদ্ধে ভোট না দেন। তরুণ রাজনীতিবিদ শেখ মুজিব সারা দিন না খেয়ে ছিলেন। ওইখানে বঙ্গবন্ধু একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ উক্তি করেছেন। রাজনীতিবিদেরা ঘুষ নিতে পারেন, এটা তাঁর অকল্পনীয় ছিল। এটা তিনি হতে দেখেছেন। কমিউনিস্ট পার্টির এক নেতার কথা আমরা জানি, তিনি জমিদারের ছেলে ছিলেন। জমিদারি ছেড়ে এসে শোষিত শ্রেণিতে নিজের নাম লিখিয়েছিলেন, একটামাত্র কাপড় ছিল, ওটা ধুতে দিয়ে বাতাসে শুকিয়ে নিয়ে আবার পরতেন।
এটা তো তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়েও করতেন। থিয়েটার রোডে অফিসঘরে ঘুমাতেন, নিজের জামা নিজে ধুতেন। তাজউদ্দীনের জ্বর হলে তাঁর একমাত্র পরিচারক তাঁর মাথায় পানি ঢালতেন।
ছাত্রলীগের ঐতিহ্যও অত্যন্ত গৌরবের। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে ছাত্রলীগ নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৬৯-এর গণ–অভ্যুত্থানে রাজপথে জীবন বাজি রেখে সংগ্রাম করেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে দলে দলে যোগ দিয়েছে এবং অনেকেই শহীদ হয়েছেন। সেই ছাত্রলীগ এখন সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কাছে আতঙ্কের নাম। এটা কিন্তু আমি কথার তোড়ে বলছি না। আমার ভাগনে-ভাগনিরা কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় বলেছে, ‘তুমি জানো না, ছাত্রলীগ আমাদের কাছে একটা আতঙ্কের নাম।’ শুনে আমি দমে গেছি!
এ রকম কেন হলো? এটা কি পৃথিবীব্যাপী আদর্শহীনতা, আশাহীনতার ফল? এটা কি দেশে একপক্ষীয় নির্বাচন হওয়ার পরিণতি? আমার মনে আছে, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসিবিরোধী শিক্ষক আন্দোলন চলাকালে শিক্ষকদের সমাবেশে ছাত্রলীগ চড়াও হলে প্রধানমন্ত্রীর তখনকার বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল আমাকে ফোন করে কাঁদতে শুরু করেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এই কি সেই ছাত্রলীগ, যেই ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধু গড়ে তুলেছিলেন? এই কি সেই ছাত্রলীগ, যেই ছাত্রলীগ আমরা করতাম?’
আজকে বিভিন্ন পত্রিকার ছাত্রলীগ–সংক্রান্ত শিরোনামগুলোর দিকে তাকান। ছাত্রলীগ বেপরোয়া। ছাত্রলীগকে আনলিশড করা হয়েছে। আনলিশড কথাটার মানে আমি ভেঙে বলতে চাই না!
এসব কেন সরকারের এবং দলের নীতিনির্ধারকেরা হতে দিচ্ছেন! আগামী নির্বাচন পার হতে এই ত্রাসের রাজারা দলকে সহায়তা করবে? তার কি আদৌ দরকার পড়ে? আগের দুটি নির্বাচনে কি দরকার পড়েছিল?
দেশের মানুষের চিত্ত জয় করতে না পারলে কোনো উপায়েই নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়া যাবে না। দেশের অর্থনীতির অবস্থা শোচনীয়। বিশ্বজুড়ে মন্দা পরিস্থিতি চলছে, তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু ব্যাংকের টাকা বেনামি সংস্থা তুলে নিয়ে গায়েব হয়ে যাচ্ছে, এটার ব্যাখ্যা কী? ওএমএসের চালের লাইনে মধ্যবিত্তরা ভিড় করছে, কয়েক কেজি চাল কেনা যেন যুদ্ধজয়ের সমান হয়ে গেছে।
পেটে ভাত না থাকলে কোনো কিছুই ভালো লাগে না। এই রকম ক্ষুধিত অসন্তুষ্ট মানুষকে আশা কে দেখাবে? কী দেখাবেন? দেখাচ্ছেন, ছাত্রলীগ নামধারীদের নিপীড়ন, চাঁদাবাজি, ছিনতাই! ছাত্র অধিকারের নেতাদের পিঠে মারের কালো দাগ! দেশের ভালো বুঝতে হবে না, মানুষের ভালো করতে হবে না—ক্ষমতাসীনেরা কি নিজেদের ভালোও বুঝবে না?
এই হতাশার মধ্যেও আশা খুঁজতে হবে। সুড়ঙ্গের শেষে খুঁজতে হবে আলো। আরেকটা কথাও আছে, এক লোক সুড়ঙ্গের শেষে আলো দেখে আশাবাদী হয়ে উঠেছে, এই বুঝি টানেল শেষ হচ্ছে। এই সময় সে টের পেল, এটা একটা ট্রেন। আসছে। আর পালানোর পথ নেই। আমাদের সামনে আশার প্রতীক হলেন ফুলপরী। বাবা ভ্যানচালক। কিন্তু এই বাবার সন্তানেরা লেখাপড়া করছেন। ফুলপরী সাহসের সঙ্গে মাথা তুলে কথা বলছেন। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত তাঁর শিক্ষা বৃথা যায়নি। তাঁর শিক্ষা তাঁকে বিবেক দিয়েছে। সাহস দিয়েছে। মর্যাদাবোধ দিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আছে:
‘মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে,
যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে,
যখনি জাগিবে তুমি তখনি সে পলাইবে ধেয়ে;
যখনি দাঁড়াবে তুমি সম্মুখে তাহার, তখনি সে
পথকুক্কুরের মতো সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে;
দেবতা বিমুখ তারে, কেহ নাহি সহায় তাহার,
মুখে করে আস্ফালন, জানে সে হীনতা আপনার মনে মনে।’
‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতার লাইন এগুলো। অত্যাচারীর ভূমিকায় বসা সানজিদা চৌধুরী কিন্তু ফুলপরীর কাছে ‘হাতে-পায়ে ধরে’ মাফ চাইছেন। একত্র হয়ে দাঁড়াতে হবে। ‘যখনই জাগিবে তুমি তখনি সে পলাইবে ধেয়ে।’
আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক