ভাবতে অবাক লাগে, একবিংশ শতাব্দীতেও নারকীয় সব ঘটনা ঘটে চলেছে। প্রতিদিন নির্বিচার শিশু-নারীসহ শত শত বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করা হচ্ছে, অথচ বিশ্ববাসী একপ্রকার নীরব।
গাজায় এ পর্যন্ত ২১ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। প্রথমে ভাবা হয়েছিল ইসরায়েল গাজায় প্রতিশোধমূলক পাল্টা হামলা চালাচ্ছে। কিন্তু দেড় মাস পর এবং ২১ হাজার মানুষ হত্যার পরও যখন তারা থামছে না, তখন বুঝতে হয় যে ইসরায়েল ও নেতানিয়াহু গংয়ের রয়েছে আরও গভীর কোনো অ্যাজেন্ডা। তাই আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ার আগেই তিনি তড়িঘড়ি করে জানিয়ে দিয়েছেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হবে।
বোঝা যাচ্ছে, এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে তারা গাজায় ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে নিজ দেশের সম্প্রসারণ ঘটাবে। পশ্চিম তীরে তারা বসতি স্থাপনকারীদের অস্ত্র দিয়ে ও সামরিক সমর্থন জুগিয়ে অনেক দিন ধরেই এ সম্প্রসারণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে প্রথম পর্যায়ে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা মুখ্য হলেও অচিরেই যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠে। ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের মারাত্মক হামলাকে সন্ত্রাসী হিসেবে নিন্দা জানিয়েও তো বলতে হবে, প্রথম উসকানিদাতা কারা।
আজ যে ফিলিস্তিনিদের ব্যাপক সমর্থন পাচ্ছে হামাস বা হিজবুল্লাহর মতো স্বাধীনতাকামী সংগঠন, তার পেছনে ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা মিত্রদের ভূমিকাই তো প্রধান। এ অঞ্চলের বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কি ন্যায্য ছিল না?
২.
৭ অক্টোবরের ঘটনার পরপরই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রনায়কেরা প্রত্যেকে স্বয়ং ইসরায়েলে উড়ে গিয়ে নেতানিয়াহুকে সমর্থন জানিয়েছেন এবং মদদ দিয়ে এসেছেন। যুক্তরাষ্ট্র বিলিয়ন ডলারের মারণাস্ত্র দিয়েছে, একই পরিমাণ নগদ অর্থসহায়তাও দিয়েছে, যা সেই থেকে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের নির্বিচার হত্যায় ব্যবহার করা হচ্ছে। নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ নিশ্চিত করতে লোহিত সাগরেও তারা যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে। ই
সরায়েলি আগ্রাসন থেকে হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থীশিবির—কোনো কিছুই রেহাই পায়নি। হাসপাতালের অভ্যন্তরে গোপন সুড়ঙ্গের যে অভিযোগ তুলে এসব আক্রমণ চালানো হচ্ছে, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ তারা এখনো হাজির করেনি। এই নির্বিচার ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞে খোদ জাতিসংঘের ত্রাণকর্মী নিহত হয়েছেন দেড় শতাধিক, গণমাধ্যমকর্মী নিহত হয়েছেন শতাধিক, জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গাজায় প্রতি ১০ মিনিটে একটি শিশু নিহত হচ্ছে। তারা গাজাকে শিশুদের সমাধি ঘোষণা করেছে।
৫০ হাজার প্রসূতি মা প্রায় বিনা চিকিৎসায় নবজাতকের জন্ম দিয়েছেন, যাদের বেশির ভাগই মারা যাচ্ছে। গণমাধ্যমের ভাষায়, গাজা বাস্তবের নরক, এক মৃত্যুপুরী। আর মৃত্যুপুরী নির্মিত হচ্ছে এই একবিংশ শতাব্দীতে!
আশ্চর্যের বিষয় হলো প্রতিটি দেশ ও তার মানুষেরা যেন এই হতভাগ্য মানুষগুলোর কথা ভুলে গেছে। যেন সত্যিই কিছু মানুষ শিশু থেকে বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে মৃত্যুঝুঁকির মধ্যে বাস করছে না। যেন সবাই নিশ্চিত যে যুদ্ধ থেমে যাবে অচিরেই, যেন আমরা শুনতে পাইনি যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির বিরুদ্ধে যে যুক্তি দিয়েছে তা।
তারা বলেছে, যুদ্ধবিরতি হলে হামাস পুনর্গঠিত হবে, যেন সেখানে ইসরায়েলের হাজার হাজার সৈন্য গোলাবারুদ নিয়ে বন্দুক তাক করে উপস্থিত নেই, যেন জাতিসংঘ বা আরও পক্ষকে সেখানে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োগ করা যাবে না।
আমরা কিন্তু খেয়াল করছি না, কীভাবে নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র বারবার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ঠেকিয়ে দিচ্ছে। ইসরায়েল অবশ্যই মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিচারী ভূমিকার কথাও হিসাবে আনতে হবে না?
৩.
যুক্তরাষ্ট্র সুকৌশলে নিজেদের অন্দরের বাইরের শক্তিধর দেশ ও নেতাদের চাপের মধ্যে রাখছে, যাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে (এমনকি অভ্যন্তরীণও) তাদের অন্যায় কাজের প্রবল বিরোধিতা না হয়।
বহু শতাব্দী ধরে পশ্চিম ইউরোপের শক্তিধর দেশগুলো একসময় বিশ্বব্যাপী বিজয় অভিযান চালিয়েছে। এভাবে তারা যুদ্ধ, চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আরও তিনটি মহাদেশ নিজেদের করে নিয়েছে। আমেরিকার নাম হয়েছে নিউ ওয়ার্ল্ড—নয়া পৃথিবী। বাকি দুই মহাদেশ এশিয়া ও আফ্রিকায় চালানো হয়েছে ঔপনিবেশিক শোষণ।
গত শতকের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে এসব দেশ স্বাধীন হলেও নয়া উপনিবেশবাদী শোষণ ও আধিপত্য কিন্তু বহাল থাকল। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও বৈশ্বিক কাঠামোতে অগ্রবর্তিতার কারণে তাদের এ ভূমিকা সম্পূর্ণ এড়ানো কঠিন। তাই অসহায়ভাবে ক্ষোভের সঙ্গে দেখতে হয় যুদ্ধ থামাতে বা শিশুমৃত্যু বন্ধেও জাতিসংঘের অসহায়তা। কেন জাতিসংঘ অসহায়? কারণ, যুক্তরাষ্ট্র অন্ধভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল পশ্চিমাদেরই সৃষ্টি। এতে কারও আপত্তি ছিল না। কিন্তু এক পক্ষের প্রতি ন্যায্য আর অন্য পক্ষের প্রতি অন্যায্য হবে—এমন কোনো সুযোগ বা অধিকার তো কারও নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এটিই ঘটেছে।
ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি চরম অবিচার হয়েছে, যা ৭০ বছর ধরে চলেছে। যখন ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে মোটামুটি মধ্যপন্থী প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও ছিল ফিলিস্তিনিদের মূল সংগঠন, তখন নানা উদ্যোগের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কাছাকাছি পৌঁছানো গিয়েছিল, এমনকি দুই রাষ্ট্রের ফর্মুলাও তখন আশার আলো দেখাচ্ছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়ন না করে ইসরায়েলের দিক থেকে ধারাবাহিক আগ্রাসনের মাধ্যমে অন্যায়, অবিচার ও নিষ্ঠুর আক্রমণের শিকার একটি জাতির মনের ক্ষোভ বাড়ানো হচ্ছিল।
ইয়াসির আরাফাতের রহস্যজনক মৃত্যু ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের নৈমিত্তিক ঘটনার পর একপর্যায়ে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে চরমপন্থী একাধিক দলের অভ্যুদয় ঘটে। বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণে জানা যাচ্ছে, হামাসের উত্থানের পেছনে নেতানিয়াহু আর দক্ষিণপন্থী ইহুদি সংগঠনের ভূমিকা রয়েছে, যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রের ছিল ওসামা বিন লাদেনের উত্থানের পেছনে। সম্পূর্ণ নির্মূল করার জন্য এটি যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষিত পদ্ধতি।
৪.
পুতিন বা সি চিন পিংকে এত সহজে কাবু করা যাবে না—যুক্তরাষ্ট্র তা জানে; কিন্তু তা বলে দুর্বল করার সামান্য সুযোগও তারা ছাড়তে রাজি নয়। এ কারণেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি করা হবে, জেলেনস্কিকে যুদ্ধের মদদ দেওয়া চলবে এবং ইউক্রেনবাসীর ভোগান্তি চলতে থাকবে।
এ ধরনের অন্যায়ের ফলে নির্বোধ যুদ্ধের সংখ্যা বাড়ছে, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনসহ অনেক বৈশ্বিক ইস্যু। এমন প্রেক্ষাপটে নতুন কিছু ভাবার সময় এসেছে। সময় আসলে অনেক আগেই এসেছে।
পুঁজিবাদী বিশ্ব আশির দশক থেকেই নতুন বিশ্বব্যবস্থার জন্য কাজ করছে। সোভিয়েতের সংকট ও ভেঙে পড়ার সময়েই নতুন প্রযুক্তির সম্ভাবনার বিকাশ, বাণিজ্য ও অর্থনীতির উদারীকরণের ফলে এতকালের বিশ্বব্যবস্থায় পরিবর্তনের দাবি জরুরি হয়ে পড়েছিল। সংস্কারের নানা প্রস্তাব উঠল, এমনকি পুরোনো অনেক সংস্থা ভেঙে গেল, ব্যবস্থায় এল পরিবর্তন। এখন বিচার করলে মনে হয়, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের বিনাশ স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের জন্য মারাত্মক শূন্যতা সৃষ্টি করেছে।
অথচ পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হচ্ছে; এ পৃথিবীতে বিবেক ও মনুষ্যত্বের আকাল দেখা দিচ্ছে। নানা ক্ষেত্রে তা ফুটে উঠছে। তার সবচেয়ে তীব্র রূপ দেখা যায় বিশ্বরাজনীতির মঞ্চে। তারই চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটছে গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর নির্মম অভিযানে।
রবীন্দ্রনাথ অনেক কাল আগে তাঁর এক অবিস্মরণীয় কবিতায় আমাদের জানিয়েছিলেন, এ ‘সংসার দয়াহীন’, অন্তরের বিদ্বেষ-বিষ লালিত হয় এখানে। তাঁর অন্তরের বাণীর মাধ্যমে আমরাও দেখেছি, ‘প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে/ বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’।
কিন্তু আমরাও কি রবীন্দ্রনাথের বালকের মতোই কেবল পাষাণ ‘পাথরে নিষ্ফল মাথা কুটে!’ মরব? সে কাজ মানবতার প্রতি অন্যায় হবে। তবে কেবল নাগরিকেরা কথা বললে কাজ হবে না, রাষ্ট্রকে দাঁড়াতে হবে। অনেক রাষ্ট্র মিলে জোট বাঁধতে হবে।
● আবুল মোমেন কবি ও প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, আমাদের সময়