ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে গাজায় যে মানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, যৌক্তিকভাবেই সেদিকে এখন বিশ্ব গণমাধ্যমের দৃষ্টি রয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারে যে সশস্ত্র সংঘাত চলছে, তাতেও গণহত্যা চলছে। স্থানীয় মানুষ অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে পড়েছে। লাখ লাখ মানুষ দেশের ভেতরেই বাস্তুচ্যুত হয়েছে। কয়েক লাখ মানুষ ইতিমধ্যেই প্রাণ বাঁচাতে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ, ভারত ও থাইল্যান্ডে পালিয়ে গেছে। তবে তাদের এই দুর্দশার খবর খুব কমই আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারছে।
মিয়ানমারের সংঘাতে বাইরের শক্তি যুক্ত হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। তবে ২০২১ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতা দখল করা জান্তা সরকারকে হটাতে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও গণতন্ত্রপন্থী গ্রুপগুলোকে সমর্থন দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এই পন্থা অবলম্বন মিয়ানমারের জন্য খুব একটা ভালো কিছু বয়ে আনছে না।
ছয় বছর আগে জান্তা সরকার যে বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছাড়তে শুরু করেছিল, সেই সরকারকে উৎখাত করে ফের জান্তা সম্পূর্ণ ক্ষমতা হাতের মুঠোয় নেওয়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন মিয়ানমারের ওপর বিস্তৃত পরিসরে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
কিন্তু গত এক দশকে সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগ–দুর্দশায় রেখে নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থাকে উচ্চস্তরে নিয়ে যাওয়া মিয়ানমারের সামরিক অভিজাত গোষ্ঠীকে এখন পর্যন্ত মার্কিন নিষেধাজ্ঞাগুলো তুলনামূলকভাবে কাবু করতে পারেনি।
জান্তা সরকারের বিকল্প হিসেবে গঠিত তথাকথিত জাতীয় ঐক্যের সরকারের সঙ্গে এখন বাইডেন প্রশাসন গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
বিশ্বের বাকি দেশগুলোর মতো যুক্তরাষ্ট্রও মিয়ানমারের ছায়া সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া থেকে বিরত আছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তার বার্মা অ্যাক্টের আওতায় মিয়ানমারের ছায়া সরকারের সশস্ত্র বাহিনী পিপলস ডিফেন্স ফোর্স, জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন এবং গণতন্ত্রপন্থী গ্রুপগুলোকে ‘নন-লেথাল এইড’ বা ‘প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্র সরঞ্জাম’ দিয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ‘নন-লেথাল’ বা ‘প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্র’কে শিথিলভাবে ব্যাখ্যা করে থাকে—এমন ভূরি ভূরি ইতিহাস আছে। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, সিরিয়ার বিদ্রোহীদের যুক্তরাষ্ট্র ‘নন-লেথাল’ সহায়তা দেওয়ার পর যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের অপারেশনাল সক্ষমতা বেড়েছিল।
মিয়ানমারে জান্তাবিরোধী যে গ্রুপগুলোকে বাইডেন প্রশাসন সহায়তা দিচ্ছে, তাদের সবাই অভিন্ন স্বার্থে কাজ করছে না।
এই গ্রুপগুলো যার যার গোষ্ঠীগত রাজনৈতিক স্বার্থে লড়াই করছে। জান্তাবিরোধী ছায়া সরকার প্রধান সব জাতিভিত্তিক গ্রুপকে এক ছাতার তলে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি ছায়া সরকারের সামরিক শাখা সামরিক কমান্ডে ঐক্যও তারা ধরে রাখতে পারছে না।
জাতিভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো (যাদের কোনো কোনোটির নৃশংসতা চালানোর রেকর্ড আছে) একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক কেন্দ্রীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেয়ে নিজেদের জাতিগত সম্প্রদায়ের জন্য স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে বেশি আগ্রহী। এদের মধ্যে কোনো কোনো গ্রুপ এ ধরনের স্বায়ত্তশাসন পেতে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করছে বলেও জানা যাচ্ছে। এই গোষ্ঠীগুলো যখন তাদের নিজেদের এলাকার বাইরের অর্থাৎ অন্য জাতিগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রিত এলাকাকে নিজেদের এলাকা বলে দাবি করে, তখন পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে ওঠে।
বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে দেওয়া মার্কিন সহায়তার ক্রমবর্ধমান প্রবাহ মিয়ানমারে অধিকতর সহিংসতার জন্ম দিচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করে বলা অসম্ভব। তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই, তাদের সহায়তা দান শুরু হওয়ার পর থেকে বিদ্রোহীদের হামলা তীব্র হয়েছে। এসব হামলার গুরুতর পরিণতি বেসামরিক নাগরিকদের বরণ করতে হচ্ছে। তারা প্রায়শই ক্রসফায়ারের পড়ে মারা যাচ্ছে। এর ধাক্কা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতেও গিয়ে পড়ছে।
গত মাসেই বিদ্রোহীরা বড় ধরনের হামলা চালিয়ে সীমান্ত এলাকার কয়েকটি শহর এবং কয়েক ডজন সামরিক ঘাঁটির দখল নিয়েছে। এর জের ধরে শুধু গত সপ্তাহেই কমপক্ষে ৭২ জন সরকারি সেনা ভারতে পালিয়ে এসেছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় জান্তা বাহিনী শাস্তিমূলক কায়দায় বিদ্রোহীদের দখলকৃত এলাকায় নির্বিচার বিমান হামলা চালাচ্ছে। কোথাও কোথাও কামানের মতো প্রাণঘাতী যুদ্ধসরঞ্জাম ব্যবহার করছে।
ইতিমধ্যে মিয়ানমার থেকে চিন জাতিগোষ্ঠীর ৩২ হাজারের বেশি লোক ভারতের চিন-সংখ্যাগরিষ্ঠ মিজোরাম রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে তাদের বেশির ভাগই শরণার্থীশিবিরে কাটাচ্ছে। ভারতের মণিপুর রাজ্যেও হাজার হাজার লোক পালিয়ে আসছে। এর ফলে মণিপুরের স্থানীয় জনসংখ্যার মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে।
খেয়াল করলে দেখা যাবে, বিশ্বজুড়ে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে দেওয়া মার্কিন সহায়তা প্রায়শই গণতন্ত্রের সম্ভাবনাকে কমিয়ে দেয় এবং বিশৃঙ্খলা ও দুর্ভোগকে বাড়িয়ে তোলে। মিয়ানমারের অবনতিশীল মানবিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হচ্ছে, এখানেও সেই ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। মেক্সিকোর বর্তমান সরকারকে শাস্তি দেওয়ার জন্য যদি দূরের কোনো দেশ সরকারবিরোধী সশস্ত্র বিদ্রোহীদের অস্ত্র দেয়, তাহলে প্রতিবেশী দেশ যুক্তরাষ্ট্র যে ধরনের বিপদে পড়বে, মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলো ঠিক একই সমস্যায় পড়ছে।
মিয়ানমার সম্পর্কিত নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শ করা উচিত ছিল। কিন্তু তারা তা করেনি। বাইডেন প্রশাসন বলছে, তারা এ ক্ষেত্রে আমেরিকান স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছেন।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তার প্রতি আমেরিকার আপসহীনভাবে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দশটি দেশের সংস্থা আসিয়ানকে মারাত্মকভাবে বিভক্ত করেছে। এর ফলে সংস্থাটি সংঘাত বন্ধে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে পারছে না। অথচ যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারে গণতন্ত্রের প্রচারের জন্য আসিয়ানকে যুক্ত করতে চেষ্টা করেছে (যদিও আসিয়ানভুক্ত অধিকাংশ দেশেই কর্তৃত্ববাদী শাসন চলছে)।
● ব্রহ্ম চেলানি নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের অধ্যাপক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ