বিশ্বায়নের কয়েক দশক পরে এসে দুনিয়া এখন বহুলাংশে অভিন্ন হয়ে পড়েছে। এরপরও আমরা এমন এক দুনিয়ায় বাস করছি, যেখানে ধনী ও গরিবের মধ্যে চরম বৈপরীত্য দেখা দিয়েছে। অনেকটা হেঁয়ালিপূর্ণ হলেও ‘বৈশ্বিক উত্তর’ ও ‘বৈশ্বিক দক্ষিণ’ অভিধার মধ্য দিয়ে সত্যিকারের ব্যবধানের বিষয়টি ফুটে উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণে অবস্থিত প্রতিবেশীদের মধ্যে আছে মধ্য আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের সংকটাপন্ন বিভিন্ন দেশ। ইউরোপের দক্ষিণ প্রান্তে আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া ও পশ্চিম এশিয়া; আরও আছে সাহেল অঞ্চলের ডামাডোল ও অব্যাহতভাবে গরিবি দশায় নিমজ্জিত সাব-সাহারান আফ্রিকার কোটি কোটি মানুষ।
এটা ঠিক যে উন্নয়নের সমস্যাগুলোর কোনো সহজ সমাধান নেই। কিন্তু আমরা যদি অর্থকড়ির বিষয়টা নিয়ে ঠিকমতো আলাপ না করি, তাহলে নিজেদের সঙ্গেই প্রতারণা করা হবে। বিশ্বের গরিব দেশগুলোর এখন বিপুল পরিমাণ পুঁজি দরকার। টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রতিবছর বাড়তি প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার কোটি ডলারের বিনিয়োগ প্রয়োজন দুনিয়াজুড়ে, যার বেশির ভাগটাই আবার আফ্রিকার জন্য।
উন্নয়নের পুরস্কার এটা নয় যে আমরা একটা অধিকতর স্থিতিশীল ও ন্যায্য দুনিয়া পাব, বরং এর সঙ্গে দুনিয়া হতে হবে আরও সমৃদ্ধিশালী ও আরও নিরাপদ। একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে গণস্বাস্থ্য অব্যবস্থাপনার ঝুঁকি যে কত মারাত্মক হতে পারে, তার সর্বশেষ সতর্কবার্তা তো মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব।
যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকার পরও ব্যক্তি বা বেসরকারি পুঁজি দিয়ে বিদ্যমান ঘাটতি মেটানো যাবে না। বরং উন্নয়ননীতিকে এমনভাবে বিন্যস্ত করতে হবে, যেখানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সহায়তা ও সহজ শর্তের ঋণের বা শর্তহীন অর্থায়নের মিশ্রণ ঘটবে। দুঃখজনকভাবে এ ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি।
অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো–অপারেশন ও ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান অনুসারে, বিশ্ব অর্থনীতির আয়তন এখন ১০ লাখ ৫০ হাজার কোটি ডলারের বেশি। এর মধ্যে ধনী দেশগুলো মাত্র ২২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের সাহায্য দিয়ে থাকে, যা ১০০টির বেশি দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সবচেয়ে বড় দাতা দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র, যে ৬ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের সহায়তা দেয়। তবে তা দেশটির মোট জাতীয় আয়ের (জিএনআই) মাত্র দশমিক ২৪ শতাংশ। বিশ্বমোড়লকে তো এটা মানায় না!
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমাদের দেওয়া সাহায্য আফ্রিকার অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য পর্যাপ্ত হয়নি। তাই যদি হতো, তাহলে ইউরোপীয়দের সবচেয়ে প্রিয় প্রত্যাশা যে আফ্রিকা থেকে কোনো অভিবাসন ঘটবে না, সেটাও পূরণ হতো। ইউক্রেনের সঙ্গে চরম বৈপরীত্য এই যে এখানে একটি সমৃদ্ধশীল ও আত্মবিশ্বাসী আফ্রিকার অভিন্ন ভবিষ্যতের কোনো ইতিবাচক ছবি নেই।
আনুপাতিক বিবেচনায় এই একটি জায়গায় ইউরোপীয়রা তাদের দায়িত্ব সংকুচিত করেনি বলা চলে। ফ্রান্স তার জিএনআইর দশমিক ৫০ শতাংশ আর জার্মানি দশমিক ৭৯ শতাংশ বিদেশি সাহায্য হিসেবে প্রদান করে।
এটা অস্বীকার করার জো নেই যে এই অর্থ ভালোভাবে কাজে লেগেছে। এই অর্থ না পেলে কোটি কোটি মানুষ বিরাট ঝুঁকির মধ্যে পতিত হতো। তবে প্রয়োজনের এক বিশাল অংশ এখনো মেটেনি। আর তাই বড় বড় সাফল্যের কাহিনি খুঁজে পাওয়াও কঠিন। কোভিড মহামারি থেকে আফ্রিকার সেরে ওঠার বিষয়টা আসলে হতাশাজনক অগ্রগতি।
সাহায্য ও শর্তহীন ঋণ মিলে যা জুটেছিল, তার চেয়ে বেশি চলে গেছে বেসরকারি ঋণ পরিশোধে। ঋণসংকট কয়েক গুণ স্ফীত হওয়ায় সম্প্রতি সময়ে কেনিয়া ও ঘানার মতো সফল অর্থনীতির দেশগুলো নিমজ্জিত হয়েছে মন্দাদশায়। ৯০ কোটির বেশি মানুষ বসবাসকারী দেশগুলোর ঋণের সুদ পরিশোধে যা ব্যয় করতে হয়, তা শিক্ষা বা স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়ের চেয়েও বেশি।
দীর্ঘদিন ধরে সরকার, ঋণদাতা ও অ–সরকারি সংস্থাগুলো (এনজিও) এটা নিয়ে বিতর্ক করে যাচ্ছে যে কীভাবে ঋণ মুক্তি ঘটানো ও অর্থায়ন ঘাটতি মেটানো যায়। এর মধ্যে সহায়তার ভিন্ন এক মাত্রা খোদ ইউরোপে বৃহত্তর পরিসরে ছড়িয়ে পড়েছে। এক অদ্ভুত হিসাবপদ্ধতির কারণে ইথিওপিয়া ও মালির মতো সাহায্যগ্রহীতার তালিকায় ওইসিডি ইউক্রেনকেও যুক্ত করেছে।
রাশিয়ার অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে আড়াই বছরে ইউক্রেন যে পরিমাণ সহায়তা ও ঋণ ছাড় পেয়েছে, তা বিগত কয়েক দশক মিলেও আফ্রিকার কোনো দেশ পায়নি। অন্য সব সহায়তার তুলনায় এই অর্থপ্রবাহ তো ইতিহাস তৈরি করেছে। এই সাহায্য পেয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকার পাশাপাশি ইউক্রেন যুদ্ধাক্রান্ত অর্থনীতিতেও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারছে।
‘বৈশ্বিক দক্ষিণে’ তাই ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে যে ইথিওপিয়া ও সুদানে অধিকতর রক্তাক্ত সংঘাতগুলো পশ্চিমা ভাষ্যে তেমন স্থান পায় না। ইউক্রেনের জন্য ইউরোপ ও আমেরিকার সমর্থন তো সর্বতো সহায়তার এক নিদর্শন, যা ‘বৈশ্বিক দক্ষিণের’ ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। অথচ অভিন্ন গন্তব্য ও উদ্দেশ্যের যে গুরুত্বের কথা বলা হয়, তাতে এ রকম হওয়ার কথা নয়।
অবশ্য ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণকে খোদ ইউরোপের ওপর সরাসরি হামলা হওয়ার হুমকি হিসেবে দেখা হয়েছে বলেই এভাবে সাহায্যের ঢল নেমেছে। অথচ মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় রাশিয়া ও চীনের সক্রিয় উপস্থিতি রয়েছে। সেখানে আমেরিকা ও ইউরোপ অবকাঠামো খাতের জন্য নতুন নতুন ঋণ কর্মসূচি নিয়ে হাজির হয়েছে। কিন্তু এগুলো সব কল্পিত অঙ্কের ওপর দাঁড়ানো, যেখানে করদাতাদের ওপর বাড়তি কিছু বোঝা চাপিয়ে তহবিল বানিয়ে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব নামের এক মিশ্র অর্থায়ন বলা হচ্ছে।
আবার শুধু আগ্রাসনকারীরই ভিন্ন নয়, বরং আক্রান্ত পক্ষও ভিন্ন। একসময় ব্যর্থতা ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ইউক্রেন ২০১৪ সালে প্রথম ধাক্কা খায় রাশিয়ার হস্তক্ষেপের মাধ্যমে। আর পুরোদস্তুর আগ্রাসনের শিকার হওয়ার পর থেকে দুর্নীতি সত্ত্বেও পশ্চিমা সাহায্যকে মোটামুটি ভালোভাবেই ব্যবহার করেছে দেশটি।
জনগোষ্ঠীর একটা ব্যাপারও আছে। ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের সহায়তার জন্য ইউরোপীয় দেশগুলো কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে এবং তা সঠিকভাবেই। এর বিপরীতে, দক্ষিণ থেকে আগত বহু অভিবাসী আটক হয়েছে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে। অথচ কিছু আর্থিক সহায়তা ও আনুষঙ্গিক সেবা পেলে, তাঁরাও একটু মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারত।
আসলে ইউক্রেনের প্রতি সহানুভূতির মাত্রাটা বেশ গভীর। কিয়েভ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ চায়, যা আবার মধ্য ও পূর্বাঞ্চলীয় ইউরোপকে পশ্চিম ইউরোপের সমৃদ্ধি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে। অথচ ইউক্রেনের এই চাওয়া প্রত্যাখ্যান করার বদলে ব্রাসেলস একে স্বাগত জানাচ্ছে।
সর্বোপরি, ইউরোপীয়রা এটা বলতে কোনো লজ্জা বোধ করছে না যে ইউক্রেনীয়রা তো ‘দেখতে আমাদের মতোই।’ ইউরোপের নীতিনির্ধারকেরা অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানের আড়ালে যে শ্রমশক্তির অভিবাসনের কথা বলছেন, সেখানে তো ইউরোপের সীমারেখা চিহ্নিত হচ্ছে গায়ের চামড়ার রং সাদা হওয়ার মধ্য দিয়ে।
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমাদের দেওয়া সাহায্য আফ্রিকার অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য পর্যাপ্ত হয়নি। তাই যদি হতো, তাহলে ইউরোপীয়দের সবচেয়ে প্রিয় প্রত্যাশা যে আফ্রিকা থেকে কোনো অভিবাসন ঘটবে না, সেটাও পূরণ হতো। ইউক্রেনের সঙ্গে চরম বৈপরীত্য এই যে এখানে একটি সমৃদ্ধশীল ও আত্মবিশ্বাসী আফ্রিকার অভিন্ন ভবিষ্যতের কোনো ইতিবাচক ছবি নেই।
অ্যাডাম টুজ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস থেকে বাংলায় রূপান্তর আসজাদুল কিবরিয়া