কোনো অন্যায় কাজও যখন মাত্রাছাড়া পর্যায়ে ঘটতে থাকে, তখন সম্ভবত একজন সাধারণ মানুষ তার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার অপর্যাপ্ততা বুঝে অসহায় বোধ করেন। গাজায় চার মাস ধরে যে মাত্রার হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, তা সচেতন মানুষমাত্রই টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে পাচ্ছেন প্রতিদিন প্রতি বেলায়।
ইসরায়েল বুঝিয়ে দিয়েছে যে তার উদ্দেশ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত সে এই অবিরাম গণহত্যা ও নির্বিচার ধ্বংসের কাজ চালিয়ে যাবে। এই বর্বরতার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ইসরায়েলকে এবং সেই সঙ্গে যুদ্ধ প্রলম্বিত করার সামর্থ্য বাড়ানোর লক্ষ্যে ইউক্রেনের জন্য ৯৫ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্রকল্প অনুমোদন করেছে। এর বাইরে ইসরায়েলে দ্রুত পাঠানো হচ্ছে ৩৫টি অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানের যন্ত্রাংশ। সবই ব্যবহৃত হবে গাজাকে ধ্বংসপ্রাপ্ত মৃত্যুপুরী বানিয়ে দখলে নেওয়ার জন্য। পাশাপাশি ইসরায়েল পশ্চিম তীরকে তাদের জন্য বিপদ–মুক্ত করার কাজও অব্যাহত রাখবে।
এটা খুবই অবাক করা ব্যাপার যে বাংলাদেশ ও ভারতে গাজা ইস্যু নিয়ে বড় কোনো প্রতিবাদ সমাবেশ হয়নি, না রাজনৈতিক দল থেকে, না নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে। তাতে অবশ্য ধরে নেওয়া যাবে না যে দুই দেশের মানুষের সংবেদনশীলতা অবশিষ্ট নেই। এমন সিদ্ধান্ত সংগত হবে বলে মনে হয় না। তাই মনে হচ্ছে নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে চলমান হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা দেখে মানুষ যেন ভাবছে ক্ষুদ্র এক ব্যক্তির পক্ষে এই সম্মিলিত অপশক্তির বিরুদ্ধে কী-ইবা করার আছে।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা সবার নৈতিক দায়িত্ব এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রতিবাদের সম্মিলন ও ধারাবাহিকতা সবার ওপরেই নৈতিক চাপ তৈরি করবে। তাই নিজের অন্তরের কথা প্রকাশ করা জরুরি। হতাশা কিংবা অপরাধবোধে আক্রান্ত হলে তা নিজের জন্যও ক্ষতিকর; তা ছাড়া নিজের বিবেক ও চেতনার অসারতা ব্যক্তিত্বের ভিত্তি গুঁড়িয়ে দেয় এবং একই সঙ্গে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চাপ তৈরিও ব্যাহত হয়। বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীর প্রতিবাদ এই মুহূর্তে তাই জরুরি।
লেখক অরুন্ধতী রায় এক বক্তৃতায় বলেছিলেন যে টেলিভিশনের সংবাদ যেন গাজার নিত্যদিনের বীভৎস হত্যা ও ধ্বংসকে পাশের রুমের ঘটমান চিত্র হিসেবে আমাদের সামনে হাজির করছে। এ যেন পাশের কক্ষে শব রেখে বা মৃত্যুপথযাত্রীকে রেখে দৈনন্দিন স্বাভাবিক জীবন চালিয়ে নেওয়ার ব্যাপার।
প্রশ্ন হলো, এভাবে গণমাধ্যমে ক্রমাগত অপরাধ ও নেতিবাচক খবর শুনতে শুনতে মানুষের চেতনা, সংবেদনা এবং বিবেক কি এসব সইতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে? তদুপরি সর্বাত্মক বাণিজ্যিকীকরণের এই কালে মানুষের মনোযোগ কেড়ে নেওয়ার জন্য রয়েছে বাজারের আকর্ষণ সৃষ্টির সার্বক্ষণিক তৎপরতা। একালের মানুষ সেই ফাঁদে পা না দিয়ে পারেনি। তাই মানুষ নিয়ে মানুষের অতৃপ্তি, অনুশোচনার শেষ নেই। সবার চোখের সামনে মানুষের এই পরিণতি ঘটে চলেছে।
এই হীন কাজটি ইসরায়েল একক শক্তিতে করছে না। তার অস্তিত্ব রক্ষার নৈতিক অধিকারের যুক্তি দেখিয়ে গাজায় আক্রমণ চালানোর জন্য নৈতিকসহ সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমা শক্তিগুলো। আপাতত তারা কেউই ইতিহাসের দায়, মানবাধিকার কিংবা নিছক বিবেকের দায়ের কথাও ভাবছে না।
২.
আমি ভাবি, যত মারণপিপাসুই হোক না কেন, নেতানিয়াহু ও তাঁর দোসরদের তো একদিন থামতেই হবে। তাদের সাফাই হলো তারা ইসরায়েলের বর্তমান ও ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। তারা চাইছে যেভাবে ১৯৪৮-এ ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় ফিলিস্তিনি আরবদের মরুভূমিতে তাড়িয়ে দিয়েছিল তাদের পূর্বসূরিরা সেভাবেই ২৪ লাখ বাসিন্দাকে মরু শহর গাজা থেকে সিনাইয়ের মরুভূমিতে তাড়িয়ে দিয়ে সবটা নিজেরা দখল করে ইসরায়েলের সীমানা বাড়িয়ে নেবে। বর্তমানে চলমান ভয়ংকর হত্যা-ধ্বংসের ও বিতাড়নের পর্ব-শেষেও যারা থেকে যাবে, তাদের থাকতে হবে ইসরায়েলের আজ্ঞাধীন অধিকারহীন নাগরিক হিসেবে। তখন হয়তো তারা পশ্চিম তীরে এমন এক প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠনে রাজি হবে, যেটি তাদের শর্তের অধীনেই থাকবে।
ইসরায়েল ভালোভাবেই জানে প্রতিবেশী আরবের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর জাতীয়তাবাদী বা প্যান-আরব চেতনার কিছুই আর বাকি নেই। আর তাই ইসরায়েল গাজায় হত্যা কিংবা ধ্বংস চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো আপসে রাজি হচ্ছে না। তার সব ক্ষতি যে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্ররা পুষিয়ে দেবে, সে নিশ্চয়তা ও রক্ষাকবচ তার রয়েছে।
তবু ভাবি, একটি দেশ বা জাতি তো কেবল তার বর্তমান নিয়ে চলে না। নিরাপদ ভবিষ্যৎ নির্মাণের অজুহাতেও এমন ধ্বংসাত্মক বর্তমান চালিয়ে যেতে পারে না। কারণ, এ তো তাদের ইতিহাসেরই অংশ হবে। গাজায় হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর এ পর্ব তো তাদের ইতিহাসেরই একটি অধ্যায়। এটি কি সেই ইতিহাসের এক কৃষ্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে না? এর জন্য ইসরায়েলের নতুন প্রজন্ম কি লজ্জিত হবে না? এ লজ্জার ভার যুগ যুগ ধরে কীভাবে বহন করবে একটি জাতি? একসময় যুযুধান জায়নবাদী ইহুদিদের মধ্যেও তো বিবেকবোধ জেগে উঠবে, অন্তত কিছু মানুষের মধ্যে তো জাগবেই, যদি তারা মানুষ হয়ে থাকে। তখন এত গ্লানির বোঝা তারা নামাবে কী করে!
না, তারা ইতিহাসের কৃষ্ণ অধ্যায় রচনার এই পর্বে এসব বিবেকি ভাবনা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। এখনো তারা জনগণের অধিকাংশের মনে প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে রাখতে পারছে। সে আগুনের ইন্ধন হিসেবে ফিলিস্তিনিদের মনে ক্ষোভ ও ক্রোধ তৈরি ও জিইয়ে রাখার মতো উসকানিমূলক অন্যায়ের ধারাবাহিকতা চালিয়ে যেতে পারছে, যাতে তারা ছোটখাটো আক্রমণ চালিয়ে তাদের (ইসরায়েলকে) ব্যাপক হামলা চালানোর সুযোগ করে দেয়। এভাবে প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে রাখার কাজ তারা ৭০ বছর ধরেই চালিয়ে গেছে।
ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ব্রিটেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং পরবর্তীকালে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে পাশ্চাত্য শক্তির পরিকল্পনার অংশ এবং তাদের নির্ভরযোগ্য মিত্র হিসেবেই ইসরায়েল রাষ্ট্রের উদ্ভব। প্যালেস্টাইনের আরবদের ভাগ্য নিয়ে ব্রিটেন বা পশ্চিমা শক্তি একটুও মাথা ঘামায়নি। তখনো ভাবেনি, এখনো নয়। কেবল ইসরায়েলকে শক্তিশালী হয়ে উঠতে ও তাদের সম্প্রসারণবাদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অব্যাহত সহায়তা দিয়ে গেছে।
৩.
গাজায় মৃতের সংখ্যা ৩০ হাজার ছোঁয়ার পথে। পুরো জনবসতি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েলের লক্ষ্য হলো গাজাকে মানুষের বসবাসের অনুপযোগী করে তোলা।
এই হীন কাজটি ইসরায়েল একক শক্তিতে করছে না। তার অস্তিত্ব রক্ষার নৈতিক অধিকারের যুক্তি দেখিয়ে গাজায় আক্রমণ চালানোর জন্য নৈতিকসহ সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমা শক্তিগুলো। আপাতত তারা কেউই ইতিহাসের দায়, মানবাধিকার কিংবা নিছক বিবেকের দায়ের কথাও ভাবছে না।
আসলে যেভাবে গোটা বিশ্বজুড়ে পশ্চিম তার আধিপত্য বিস্তার করেছিল, তখন যেমন এসব নৈতিকতার ধার ধারেনি তারা, এখনো সেই সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষায় তাদের অবস্থান ও ভূমিকার কোনো পরিবর্তন হয়নি। তারা বহুকাল পরে বুলিসর্বস্ব ক্ষমা চেয়ে ইতিহাসের দায় চুকাতে চাইবে যেমন উত্তর আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের নিপীড়ন ও নিশ্চিহ্ন করার জন্য চেয়েছে। কিন্তু কখনোই শক্তি ও সম্পদের জোরে বিশ্বব্যাপী প্রভুত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ছাড় দেবে না।
আপাতত বাকি বিশ্বের সাধারণ মানুষকে তাদের নৈতিক দায় পালন করতে এবং বিবেকের ডাকে সাড়া দিতে হবে। দৃশ্যমান প্রতিবাদ তাই আজ সময়ের দাবি।
● আবুল মোমেন লেখক ও সাংবাদিক, সম্পাদক, দৈনিক আমাদের সময়