সম্প্রতি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) শিক্ষার্থী ও যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইংল্যান্ডের বাংলাদেশি প্রকৌশল সংঘের আয়োজনে অনুষ্ঠিত সেমিনারে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে কী কী সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, এ বিষয়ে আমার মূল বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ হয়েছে। সেমিনারে এমআইটি, হার্ভার্ড, বোস্টন, নর্থ ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ এখানকার প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা মিলে প্রায় শতাধিক ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন।
অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কে জানার আগ্রহ ছিল বেশ লক্ষণীয়। সেমিনারে আলোচনার সারকথা ছিল উদ্ভাবনী, জ্ঞানভিত্তিক ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিসমৃদ্ধ দেশ গড়তে হলে জ্বালানি নিরাপত্তা ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ অত্যাবশ্যক। সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ বিষয়ে সবাই ইতিবাচক মত পোষণ করলেও পারমাণবিক বিদ্যুৎ বিষয়ে চেরনোবিল কিংবা ফুকুশিমার দুর্ঘটনার দুশ্চিন্তা থেকে অনেকেই বের হতে পারছেন না।
মানুষের মধ্যে এই দুশ্চিন্তার ভাবনাটাই হচ্ছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালনা, নতুন করে নির্মাণ কিংবা এর সম্প্রসারণের মূল বাধা। গবেষণায় দেখা গেছে, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশপাশের বাসিন্দাদের মধ্যে যদি পারমাণবিক প্রযুক্তি সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকে তবে তারা এর পক্ষে কাজ করে থাকেন। এমনকি রেডিয়েশনের ভয় দেখিয়ে গুজব রটালেও এর বিরুদ্ধে তাদের দাঁড় করানো যায় না।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকারী কর্তৃপক্ষের মধ্যে অনেকেরই ধারণা, সাধারণ নাগরিক, পেশাজীবী কিংবা সুশীল সমাজকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে ধারণা দিতে গেলে তাঁরা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে চলে যেতে পারেন। এ ধারণা মোটেই সত্য নয়। বাস্তবতা হচ্ছে তাঁরা অন্ধকারে থাকলেই বরং সমস্যা।
এবার মূল প্রসঙ্গ জ্বালানি ও বিদ্যুৎসংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে আসি। দেশে বর্তমান বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনার দিকে তাকালে দেখা যায় যে ২০৩০ সালে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার প্রক্ষেপণে মিশ্র জ্বালানিনীতি অনুসরণ করে গ্যাস, কয়লা, তেল ও ইউরেনিয়াম থেকে যথাক্রমে ৩৭, ৪০, ১০ ও ৩ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের উল্লেখ রয়েছে। একইভাবে ২০৪১ সালে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে গ্যাস, কয়লা, তেল ও ইউরেনিয়াম থেকে যথাক্রমে ৪৩, ৩২, ২ ও ৭ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সিদ্ধান্ত রয়েছে।
বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস ও কয়লার ব্যবহারে প্রাধান্য থাকবে, তেলের ব্যবহার ব্যাপক হ্রাস পাবে। আমদানি করা বিদ্যুতের ব্যবহার শতকরা ১০ ভাগ থেকে ১৫ ভাগে উন্নীত করা হবে। ইউরেনিয়াম জ্বালানি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৭ শতাংশের বেশি হবে না। কারণ, ২০৩০ সালের মধ্যে রূপপুরের ২টি ইউনিট থেকে মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনই কেবল ভরসা। আবার সম্প্রসারণের মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে রূপপুর কিংবা অন্য স্থান থেকে যদি আরও ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়, তাহলে সর্বমোট ৪ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পরমাণু উৎস থেকে আসবে।
কাজেই বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী, সব মিলিয়ে পরমাণু উৎস থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৭ শতাংশের বেশি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাহলে আমদানিনির্ভর গ্যাস ও কয়লা ছাড়া জ্বালানিসংকট এবং বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধান করা যাচ্ছে না।
কিন্তু মুশকিল হলো এই জ্বালানিনীতি ও বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনা করলে বিপদ আছে। জলবায়ুর বিপর্যয় ঠেকাতে বিশ্বব্যাংক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে আর কোনো ঋণ দেবে না। তখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে ঝুঁকিপূর্ণ।
অপর দিকে ইউরেনিয়াম জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনকে সবুজ জ্বালানি হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক এবং ঋণ দেওয়ার জন্য তারা সম্মত হয়েছে। তাহলে বোঝা গেল, সৌর, বায়ু ও পারমাণবিক শক্তিই হচ্ছে ভবিষ্যৎ জ্বালানির মূল ভিত্তি। আসলে কি তা-ই?
সৌর প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ ও গবেষণার কারণে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে। এর ফলে সৌর কোষের দক্ষতা যেমন বেড়েছে, আবার অধিক উৎপাদন ও ব্যবহারের কারণে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচও আগের তুলনায় অনেক কমেছে, যা কিনা কয়লা ও তেলের তুলনায় কম। তদ্রূপ বায়ুশক্তির বেলায়ও ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ অনেক কম।
এ ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে, চাহিদামতো বিদ্যুৎ পাওয়া এবং সংরক্ষণ করার জন্য টেকসই প্রযুক্তি, অর্থাৎ ব্যাটারি।
পারমাণবিক শক্তি ফিশন ও ফিউশন আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে বলে এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট লোকজন মনে করছেন। আমি যেহেতু এমআইটিতে চতুর্থ প্রজন্মের ফিশনভিত্তিক পারমাণবিক প্রযুক্তি যেমন ছোট ও মাইক্রো মডিউলার চুল্লির উন্নয়নে কাজ করছি, তাই আমি বলতে পারি, এই ধরনের চুল্লিগুলোতে চেরনোবিল কিংবা ফুকুশিমার মতো পরিণতি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
এ ধরনের চুল্লি স্থাপনে প্রাথমিক বিনিয়োগ বর্তমান প্রজন্মের ৩+ (রূপপুর) এর চেয়ে এক-তৃতীয়াংশ থেকে এক-চতুর্থাংশ হবে। নির্মাণে সময় লাগবে এক থেকে পাঁচ বছর। বর্জ্য উৎপাদনের হার অনেক কম হবে এবং ব্যবহৃত জ্বালানি দণ্ড, যা উচ্চ তেজস্ক্রিয় বর্জ্য নামে পরিচিত, সেগুলো কম তেজস্ক্রিয় বর্জ্যে রূপান্তর করার প্রযুক্তি আসছে। প্রতিবছর জ্বালানি ভরতে হবে না। ৫ বা ১০ বছর পরপর জ্বালানি দেওয়ার সুবিধাও থাকছে এবং চাহিদামতো সব স্থানে, এমনকি জরুরি অবস্থায় দ্রুত বিদ্যুৎ-সংযোগের লক্ষ্যে এদের বসানো যাবে।
প্রাকৃতিক গ্যাসকে রাসায়নিক প্রক্রিয়া কিংবা ইলেক্ট্রোলাইসিস পদ্ধতিতে হাইড্রোজেন জ্বালানি তৈরি করা একদিকে ব্যয়বহুল এবং অন্যদিকে কার্বন নিঃসরণযুক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু চতুর্থ প্রজন্মের ফিশনভিত্তিক পারমাণবিক প্রযুক্তির চুল্লিতে নির্মল বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি সাশ্রয়ীভাবে সবুজ হাইড্রোজেন জ্বালানি তৈরি করা যাবে। সৌর ও বায়ুপ্রযুক্তির মাধ্যমেও হাইড্রোজেন জ্বালানি তৈরির সাশ্রয়ী প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হচ্ছে। এখন গবেষণা হচ্ছে হাইড্রোজেন জ্বালানির সাশ্রয়ী সংরক্ষণ ও বিতরণব্যবস্থার ওপর।
এখন কাজ হচ্ছে প্রযুক্তি টেকসই ও সহজলভ্যকরণ নিয়ে। ফিউশনভিত্তিক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য মূল জ্বালানি হচ্ছে হাইড্রোজেন। সমুদ্রের পানি হচ্ছে এই হাইড্রোজেনের মূল উৎস, যা সরবরাহের কখনো ঘাটতি হবে না এবং জলবায়ু উষ্ণায়নে কোনো ভূমিকা রাখবে না। সেই জন্য অনেকেই বলছেন, ভবিষ্যতে কয়লা, তেল, গ্যাস পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সমস্ত উৎসগুলো আধুনিক পারমাণবিক প্রযুক্তিতে প্রতিস্থাপিত হবে।
জ্বালানি সংরক্ষণে উন্নত ও সাশ্রয়ী ব্যাটারি উদ্ভাবনে গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ছে। আশা করা যাচ্ছে, এই ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। অপর দিকে আরেকটি সুসংবাদ হচ্ছে প্রথমবারের মতো গত বছরের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীরা একটি ফিউশন বিক্রিয়া সফলতার সহিত সম্পন্ন করেছেন, যা ব্যয়ের চেয়ে বেশি শক্তি উৎপাদন করেছে।
এটি একটি বড় ধরনের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি, যা ফিউশনভিত্তিক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পথ প্রশস্ত করবে এবং নির্মল বিদ্যুতের ভবিষ্যৎ হবে। এই প্রযুক্তিতে দুর্ঘটনা ঘটানো বা তেজস্ক্রিয়া বর্জ্য তৈরির কোনো সমস্যা নেই, যার ফলে ফিউশনভিত্তিক পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ইতিমধ্যে বিশ্বে ৩৩টি কোম্পানি তৈরি হয়েছে এবং কয়েকটি কোম্পানি নির্মাণকাজে হাতও দিয়েছে।
তারা ঘোষণা দিয়েছে, আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাবে।
এখন কাজ হচ্ছে প্রযুক্তি টেকসই ও সহজলভ্যকরণ নিয়ে। ফিউশনভিত্তিক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য মূল জ্বালানি হচ্ছে হাইড্রোজেন। সমুদ্রের পানি হচ্ছে এই হাইড্রোজেনের মূল উৎস, যা সরবরাহের কখনো ঘাটতি হবে না এবং জলবায়ু উষ্ণায়নে কোনো ভূমিকা রাখবে না। সেই জন্য অনেকেই বলছেন, ভবিষ্যতে কয়লা, তেল, গ্যাস পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সমস্ত উৎসগুলো আধুনিক পারমাণবিক প্রযুক্তিতে প্রতিস্থাপিত হবে। আমরা এখন নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পারছি, রেডিয়েশনের ঝুঁকির চেয়ে জলবায়ু উষ্ণায়নের কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয় অনেক বেশি ভয়াবহ হবে।
একবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে আমরা হয়তো জীবাশ্ম জ্বালানিবিহীন সব ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব নির্মল বিদ্যুৎ উৎপাদনের আশা করতে পারি। তখন তেল কিংবা গ্যাস নিয়ে তেল উৎপাদনকারী দেশের সঙ্গে অন্য কোনো দেশের বৈরী মনোভাব তৈরি হবে না। জ্বালানিনীতিতে আলোচিত আধুনিক প্রযুক্তিসমূহের প্রক্ষেপণ করে তদনুযায়ী জ্বালানি ও বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনা করে ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে সময়োচিত পদক্ষেপ। এই প্রযুক্তি সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিতে প্রয়োজন প্রায়োগিক গবেষণা, পাঠ্যসূচি প্রণয়ন ও শিক্ষিত জনবল তৈরি করা।
ড. মো. শফিকুল ইসলাম: ভিজিটিং প্রফেসর ও ফুলব্রাইট স্কলার, নিউক্লিয়ার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি), যুক্তরাষ্ট্র এবং প্রফেসর, নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল: [email protected]; [email protected]