মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে উপস্থিত না থেকেও সম্মেলনে কারও কারও মধ্যমণি হয়ে ওঠার ঘটনা এবারই প্রথম ছিল না। এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। এবারকার সেই ব্যক্তি হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
‘ডাভোস অব ডিফেন্স’খ্যাত এই সম্মেলনে যোগ দেওয়া অন্য বেশির ভাগ অংশগ্রহণকারীর মতো আমিও মরিয়া হয়ে চাই, এই রিপাবলিকান নেতা যেন চিরদিনের জন্য ‘প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে থেকে যান।
ট্রাম্পকে আমেরিকান প্রজাতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য ভয়ানক হুমকি হিসেবে দেখা আমার সেই সব আমেরিকান বন্ধুদের প্রতি সহমর্মিতা থেকেই যে আমি এটি চাই তা নয়। বরং গোটা বিশ্বব্যবস্থার জন্য তিনি সর্বগ্রাসী হয়ে উঠতে পারেন—এমন একটি আশঙ্কাও আমার এই চাওয়ার পেছনে কাজ করছে। তবে একজন ইউরোপীয় নাগরিক হিসেবে আমি ট্রাম্পের প্রতি কিছুটা হলেও কৃতজ্ঞ। কারণ, তিনি ইউরোপীয়দের নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এমনকি তিনি যদি আগামী নভেম্বরের নির্বাচনে হেরেও যান, এরপরও তিনি ইউরোপিয়ান ‘প্রকল্পের’ অনিচ্ছাকৃত ত্রাণকর্তা হয়ে উঠতে পারবেন।
ইউক্রেনের যুদ্ধ, ইউরোপের নিজস্ব প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এবং ইউরোপীয় রাজনৈতিক ঐক্যের বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করতে ইউরোপের দেশগুলো এত দিন গড়িমসি করছিল। ট্রাম্প ইউরোপকে সেসব বিষয়ে মনোযোগী হতে বাধ্য করেছেন।
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ দ্বিতীয় বছর শেষ করার পথে রয়েছে; কিন্তু এখনো জয়–পরাজয় নির্ধারিত হওয়ার কোনো আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় যুদ্ধের জয়-পরাজয় নিয়ে ইউরোপিয়ান মানসিকতার ওপরে ট্রাম্পের প্রার্থিতা আলোকপাত করেছে।
ইউরোপের বেশির ভাগ নাগরিকের চাওয়া ইউক্রেন তার হৃত ভূখণ্ড ফেরত পাক। রাশিয়ার বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনির বিধবা স্ত্রী ইউলিয়া নাভালনায়া তাঁর স্বামীর মৃত্যুর খবর শোনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সম্মেলন মঞ্চে উঠলেন। এই দৃশ্য যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের পক্ষে ভ্লাদিমির পুতিনের হাতে ইউক্রেনের এক বর্গইঞ্চি জমি ছেড়ে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করা অসম্ভব ছিল। কিন্তু যুদ্ধ শুধু ক্ষয়ক্ষতি বাড়াতেই পারে—এই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ইউরোপকে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথেই হাঁটতে হবে।
তবে নিজের ভূমি হারানোর চেয়েও বড় হুমকির মুখে রয়েছে ইউক্রেন। কারণ, ট্রাম্প যদি নির্বাচিত হয়ে তার ‘শান্তি পরিকল্পনা’ বাস্তবায়ন করেন, তাহলে ইউক্রেনকে ভূখণ্ড হারাতে তো হবেই, দেশটিকে নিরস্ত্রীকরণের মুখেও পড়তে হতে পারে।
ইউরোপিয়ানরা অন্তত এই বিষয়ে সচেতন হয়েছে যে ইউক্রেন শুধু ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে দ্বৈত যোগদানের মাধ্যমে তার ইউরোপীয় এবং পশ্চিমা উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারে; অন্য কোনোভাবে নয়।
দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্প তাঁর নিজের অজান্তেই ইউরোপকে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। এই সপ্তাহে মিউনিখে ডেনিশ প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেন তাঁর দেশের ‘সব সামরিক সমর্থন’ ইউক্রেনীয়দের হাতে তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইউরোপীয়রা ইতিমধ্যে ইউক্রেনের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি সহায়তা (সামরিক এবং অন্যান্য) দেওয়া শুরু করেছে।
গত জুলাইয়ে ওয়াশিংটনে ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলনের আগে, জোটে থাকা ২২ ইইউ সদস্যদের মধ্যে ২০টি সদস্যদেশ (জার্মানিসহ) তাদের জিডিপির কমপক্ষে ২ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করার পথে রয়েছে বলে দেখা গেছে।
এটি ঠিক, ইউক্রেনের পুনরুদ্ধার করা ভূমি পুনরায় ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য পুতিন তোড়জোড় শুরু করার ফলেই ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে এই পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু ট্রাম্পের সাম্প্রতিক একটি মন্তব্য ইউরোপীয়দের নড়েচড়ে বসতে সহায়তা করেছে। ট্রাম্প বলেছেন, ন্যাটো সদস্যদের সঙ্গে রাশিয়া ‘যা মনে চায় সে আচরণ করতে পারে’ এবং এ নিয়ে তাঁর মতে যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার কারণ থাকতে পারে না।
এ অবস্থায় ইউরোপীয়দের শুধু বেশি করে অর্থ ঢাললে হবে না, বরং অর্থ কীভাবে ব্যয় করা হবে, সে কৌশলও বদলাতে হবে। একই সঙ্গে ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে পুরোনো সব মনস্তাত্ত্বিক বিভাজন কাটিয়ে উঠতে হবে।
তবে সম্ভবত ইউরোপে ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় অবদান হলো ইউরোপের রাজনৈতিক ঐক্য ধরে রাখা। ট্রাম্প ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর অনেকে একটি ‘অনুদার আন্তর্জাতিক’ গোষ্ঠীর উত্থানের আশঙ্কা করেছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, ট্রাম্পের গদিতে বসার জের ধরে ইউরোপে কট্টর দক্ষিণপন্থী জনতুষ্টিবাদী দলগুলো ট্রাম্পের হোয়াইট হাউস ও পুতিনের ক্রেমলিনের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠবে।
কিন্তু ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের একটি প্রতিবেদনে (শিগগিরই প্রকাশিত হবে) দেখা গেছে, যদি ট্রাম্প দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হন, তাহলে বেশির ভাগ ইউরোপীয় দেশ তাঁকে আগের মতো উৎসাহভরে স্বাগত জানাবে না। এমনকি হাঙ্গেরিও তেমনভাবে ট্রাম্পের বিষয়ে উৎসাহী হবে না।
ইউক্রেন যুদ্ধের (এবং ব্রেক্সিটের) বিস্ময়কর পরিণতি হিসেবে অনেক ডানপন্থী দলের মধ্যেও বোধোদয় ঘটেছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি সতর্কতার সঙ্গে তাঁর আগেকার ‘ইউরোসকেপটিসিজম’ (ইউরোপ থেকে সরে আসার প্রবণতা) অবস্থান থেকে সরে এসেছেন এবং পুতিনের সঙ্গে ইতালির সব সম্পর্ক ছিন্ন করার উদ্যোগ নিয়েছেন।
পোল্যান্ডে ডোনাল্ড টুস্কের প্রত্যাবর্তন ভূরাজনীতিগতভাবে ইউরোপকে একত্রে রাখার স্পৃহা ইউরোপীয়দের মধ্যে পুনরুজ্জীবিত করেছে। আগামী জুনে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে দক্ষিণপন্থীদের পাল্লা ভারী হতে পারে। কিন্তু অনেক দেশে ট্রাম্পের হুমকি ভোটারদের একত্র করতে পারে এবং ইউরোপীয় সার্বভৌমত্ব সমর্থনকারী প্রার্থীদের জন্য তা সহায়ক হয়ে উঠতে পারে। এই গতিশীলতা শুধু যে ইইউতে আটকে থাকবে তা নয়। যুক্তরাজ্যেও এর ছোঁয়া লাগতে পারে।
যুক্তরাজ্য সম্ভবত চলতি বছরের শেষ হওয়ার আগে একটি নতুন সরকার নির্বাচন করবে। মিউনিখে যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির ছায়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি স্পষ্ট করেছেন, তিনি নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষা ইস্যুতে ইউরোপীয়দের সঙ্গে সম্ভাব্য সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের জন্য তাঁর দেশের সরকারকে কঠোর চাপ দেবেন।
অনেক মার্কিন পর্যবেক্ষক উল্লেখ করেছেন, ট্রাম্প একদিকে আমেরিকান গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি, অন্যদিকে ডেমোক্রেটিক পার্টির ভোটারদের ‘সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠক’।
মার্ক লিওনার্ড ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের পরিচালক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ