পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা দেশটিকে ঋণের বোঝায় ডুবিয়ে দিয়েছে। সরকারি আয়ের ৬০ শতাংশ ঋণের সুদ পরিশোধে চলে যাচ্ছে। সামনের পাঁচ বছরে প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ শোধ করতে হবে; অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে আছে মাত্র ১১ বিলিয়ন ডলার।
এ অবস্থায় কেউ কেউ বলছেন, দেশটির উচিত নিজেকে ঋণখেলাপি ঘোষণা দিয়ে অর্থনীতি পুনর্গঠন করা। কেউ কেউ আবার দেশটিকে আইএমএফের তিন বছরের কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচি মেনে চলতে বলছেন। তবে এ দুই পদ্ধতিই দেশটিকে আরও কষ্ট দেবে, কিন্তু সমস্যার স্থায়ী সমাধান দেবে না।
পাকিস্তানের অর্ধেক ঋণ আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো বহুজাতিক সংস্থাগুলোর কাছে। এসব প্রতিষ্ঠান যদি নতুন কোনো ঋণমুক্তি কর্মসূচি চালু করে, কেবল তখনই এসব ঋণ মওকুফ হতে পারে। অন্যদিকে, দ্বিপক্ষীয় ঋণদাতাদের (মূলত চীন, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত) কাছে বাকি ঋণ ইতিমধ্যেই আইএমএফ কর্মসূচির অধীনে নবায়ন করা হচ্ছে। সুতরাং, ঋণ পরিশোধ বন্ধ করলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে; কারণ কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক এবং ভবিষ্যৎ অর্থায়নে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
এটি ঠিক যে অভ্যন্তরীণ ঋণ পুনর্গঠন সুদের খরচ কমাতে পারে। কিন্তু দিন শেষে তা দেশের অর্থনীতিকে বড় বিপদে ফেলবে।
দেশের অভ্যন্তরীণ ঋণের বেশির ভাগই ব্যাংকগুলোর কাছে। এসব ব্যাংকের ৬০ শতাংশ এই ঋণেই বিনিয়োগ করা। যদি সরকার ১০ শতাংশ ঋণ কমিয়ে দেয়, তাহলে ব্যাংকগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারবে না। এতে আর্থিক অস্থিরতা ও বড় অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেবে। যদি ঋণ পুনর্গঠন কাজ না করে, তবে নতুন আইএমএফের কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচি কি সমাধান হতে পারে?
আইএমএফের এই কর্মসূচি তিন বছরে কর-জিডিপি অনুপাত ৩ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্য স্থির করেছে। সত্যি বলতে, পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের রাজস্ব–ঘাটতি দূর করা জরুরি। বর্তমানে পাকিস্তানে রাজস্ব–ঘাটতি একটি বড় সমস্যা। মাত্র ১ শতাংশ মানুষ আয়কর দেয়। সরকারের মোট রাজস্ব আদায় জিডিপির মাত্র ১২ শতাংশ, যা বিশ্বে মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, পাকিস্তানের অর্থনীতির প্রধান খাতগুলো যেমন কৃষি, খুচরা ব্যবসা এবং আবাসন ব্যবসা—প্রায় পুরোপুরি করের বাইরে। এই বিশাল অর্থনৈতিক খাতগুলো থেকে রাজস্ব না এলে দেশের অর্থনীতি কার্যকরভাবে চলতে পারে না। তাই এভাবে চলা সম্ভব নয়।
আইএমএফ কর্মসূচি প্রথম বছরেই কর-জিডিপি অনুপাত ২ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এটি একটি অস্বাভাবিক গতি এবং খুবই অযৌক্তিক। পাকিস্তান এর আগে কখনো এক বছরে এ ধরনের বড় পরিবর্তন আনতে পারেনি। এমনকি যদি অলৌকিকভাবে সরকার এই লক্ষ্য অর্জন করতে পারে, তবু এর ফলে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং দারিদ্র্যের হার ব্যাপকভাবে বাড়বে।
সরকারের খরচের দিকেও কোনো স্বস্তি দেখা যাচ্ছে না। জিডিপির তুলনায় সুদবিহীন খরচ বিগত ১০ বছরের গড় স্তরের চেয়ে কম রাখতে হবে। কিন্তু ওই গড় খরচ ইতিমধ্যে বিশ্বের অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতির তুলনায় খুবই কম ছিল। এই খরচ দেশের মৌলিক উন্নয়নের চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্টও নয়। এমনকি যদি সরকার এই খরচ কমানোর লক্ষ্য পূরণ করতেও পারে, এর সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে স্থায়িত্ব বজায় রাখা কঠিন হবে। কারণ, এই কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচি চালু করা হলে জনগণ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি এর বিরোধিতা করতে পারে।
তাই বলা যায়, ঋণ পুনর্গঠন সঠিক সমাধান নয়। আবার আইএমএফ কর্মসূচি কার্যকর হলেও তা এত কঠিন যে এটি দেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তবে একটি তৃতীয় পথও আছে।
প্রথমে পাকিস্তান সরকারকে পাঁচ বছরে প্রতিবছর জিডিপির ১ শতাংশ করে করের আয় বাড়াতে হবে। এটি অর্জন করতে হবে কঠোর কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে, যাতে করে বেশি মানুষ করের আওতায় আসে। এরপর এই বাড়তি আয়ের অর্ধেক অংশ দেশব্যাপী শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং জলবায়ু–সহনশীল অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ব্যয় করতে হবে।
এই সংস্কার চলাকালে, দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় ঋণদাতাদের পাকিস্তানকে শুধু পুরোনো ঋণ নবায়নের সুযোগ দিলেই হবে না, এর পাশাপাশি দেশটিকে নতুন ঋণ দিতে হবে। এ ধরনের অর্থনৈতিক তারল্য বাড়ানোর উদ্যোগ দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াবে। কারণ, এতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়বে এবং বেসরকারি বিনিয়োগেও উৎসাহ জোগাবে।
তবে এই তহবিল যে ঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য ঋণদাতাদের উচিত সংস্কারের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করা এবং সরকারি বিনিয়োগ প্রকল্পের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সরাসরি অংশগ্রহণ করা।
আইএমএফকে নিয়মিত ঋণপ্রবাহ এবং প্রতিটি বড় সরকারি ঋণদাতার কাছে পরিশোধিত সুদের তথ্য প্রকাশ করতে হবে। ঋণদাতা যদি জানে যে অন্য ঋণদাতারাও নতুন ঋণ দিচ্ছে, তবে তারা আরও সহজ শর্তে ঋণ দিতে বেশি আগ্রহী হবে।
বর্তমানে আইএমএফের কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচি সম্ভবত সফল হবে না। এতে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে এবং আইএমএফের সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে যদি নীতিনির্ধারকেরা এখনই ঋণের চাপ কমান এবং ঋণদাতারা আরও তারল্য দেন, তাহলে পাকিস্তান তার ঋণ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হতে পারে। এ ধরনের পদ্ধতি অন্য উদীয়মান অর্থনীতির ঋণ সমস্যার সমাধানেও প্রয়োগ করা যেতে পারে।
● আসিম এম হুসাইন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মধ্যপ্রাচ্য ও কেন্দ্রীয় এশিয়া বিভাগের সাবেক উপপরিচালক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ