গুজব ও ভুয়া খবরের ভিড়ে আসল চিনি কেমন করে

ডিজিটাল প্রযুক্তিকে ভিত্তি করে বিশ্বব্যাপী সংবাদমাধ্যমের ব্যাপক রূপান্তর ঘটে গেছে। একটি মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেট সংযোগ থাকলে যে কেউ হয়ে উঠছেন সংবাদমাধ্যম। মূলধারার গণমাধ্যম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়া বা যাচাই-বাছাই করার আগেই বিভিন্ন (সামাজিক যোগাযোগ) মাধ্যমের বদৌলতে মুহূর্তেই সেটি পৌঁছে যাচ্ছে লাখো-কোটি মানুষের কাছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন আঙ্গিকের ব্যবসায়িক মডেল। যত ক্লিক তত টাকা, যত ভিউ তত ডলার। টাকাপয়সার হিসাবে একাকার হয়ে গেছে সত্য-মিথ্যার বালাই, শুরু হয়েছে আসল আর নকল সংবাদের লড়াই। 

নকল খবর, ফেক নিউজ, ভুয়া সংবাদ কিংবা গুজব—যে নামেই ডাকা হোক না কেন, কখনো কখনো সেটির প্রতিক্রিয়ায় ক্ষণিকের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে ক্ষোভ, জড়িয়ে পড়ে সমাজ, বিচার-বিবেচনাবোধ বাদ দিয়ে জায়গা করে নেয় শোধ-প্রতিশোধ।

ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে দ্রুততার সঙ্গে সংবাদ ছড়িয়ে দিতে পারার সুবিধা যেমন আছে, জবাবদিহিহীন সে পদ্ধতিতে তেমনি আবার আছে যাচাই-বাছাই করতে না পারার অসুবিধাটুকুও। মূলধারার গণমাধ্যম সেন্সরশিপের কারণে সংবাদ প্রচার করতে না পারলেও সিটিজেন জার্নালিজমের মাধ্যমে সে সংবাদ সবার কাছে পৌঁছে যাওয়ার সুযোগ যেমনটা আছে, তেমনি আবার আছে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থে গুজব ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগটুকুও। 

সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও তৈরি করার প্রযুক্তি জেনারেটিভ এআই। যেটিকে আমরা ‘ডিপফেক’ হিসেবে জানি। ডিপমিডিয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ডিপফেক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নকল ভিডিও তৈরি আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে ৩ গুণ, নকল অডিও তৈরি বেড়েছে ৮ গুণ। ২০২৪ সালে সারা পৃথিবীতে তৈরি হবে আরও ৫ লাখ নকল অডিও-ভিডিও।

এ প্রযুক্তি এতটাই এগিয়েছে যে আসল-নকলের পার্থক্য করাটাই দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে শুরু করে শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মী, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু—কেউই যেন রক্ষা পাচ্ছেন না প্রতারণার হাত থেকে। সামান্য টাকা খরচ করলেই কণ্ঠ নকল করে ইচ্ছেমতো কথা বলিয়ে নেওয়া যাচ্ছে, একজনের দেহে আরেকজনের মুখ বসিয়ে ছবি-ভিডিও বানিয়ে নেওয়া যাচ্ছে। কয়জন মানুষের দক্ষতা আছে এই আসল-নকলের পার্থক্য করার? কয়জনের সামর্থ্য আছে সিন্ধু সেচে মুক্তো আনার? 

তথ্য বিকৃতি সাধারণত তিন ধরনের—ভুল তথ্য (মিসইনফরমেশন), অপতথ্য (ডিসইনফরমেশন) ও ক্ষতিকারক তথ্য (ম্যালইনফরমেশন)। মিসইনফরমেশন হলো অনিচ্ছাকৃত ভুল অর্থাৎ এটি ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয় না। ডিসইনফরমেশন হলো মিথ্যা অপপ্রচার, যেটি ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সংস্থা বা দেশের ক্ষতি করার জন্য তৈরি করা হয়। ম্যালইনফরমেশন সত্য কোনো ঘটনা থেকে পাওয়া তথ্য হলেও উপস্থাপন করা হয় অতিরঞ্জিত করে, যা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ হিসেবে ফেক নিউজ (ভুয়া তথ্য) বা গুজব ডিসইনফরমেশন শ্রেণিতেই বিবেচিত হওয়ার কথা।

এই মিস-ডিস তথ্য থেকে পরিত্রাণের পথ্য খুঁজে পাওয়াটা অতটা সহজ নয়। স্বল্পতম ডিজিটাল লিটারেসি–সম্পন্ন একজন মানুষকে গুগলে ছবি দিয়ে উল্টো (রিভার্স) সার্চ করতে বলা, ইঞ্জিনচালিত রিকশার চালককে ব্যাটারির ভেতর সালফিউরিক অ্যাসিড আছে কি না, সেটি যাচাই করতে বলার মতো।

যে দেশের মানুষ ‘এআই চ্যাটবট সপ্তাহে একদিন বিশ্রামে থাকে’ বিশ্বাস করে গরু বিক্রি করে এনে লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে পারে (এমটিএফই ফাঁদ, প্রথম আলো, ২১ আগস্ট ২০২৩), সে দেশে ফেক নিউজ যাচাইয়ের জন্য ইউআরএল বা ডোমেইন দেখতে বলা, ক্যালকুলাসের মাধ্যমে ক্ষেত্রফল মেপে জানালার পর্দার দাম নির্ধারণ করতে বলার মতো। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া গেলেও, ব্যক্তিপর্যায়ে এ ধরনের প্রযুক্তিব্যবস্থা খুব একটা কার্যকর কিছু নয়।

তবে প্রযুক্তির ব্যবহার না করেও সহজ কিছু জিনিস খেয়াল রেখে, পরোক্ষভাবে ফেক নিউজ, গুজব কিংবা অপপ্রচার থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। কোনো তথ্য অপপ্রচার বা ভুয়া তথ্য হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না, সেটি যাচাইয়ের জন্য নিজেকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে হবে। যেমন এটি তীব্র মানসিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে কি না? এটি কোনো বিতর্কিত বিষয়ে জোরালো কোনো অবস্থান প্রচার করছে কি না? এটি অতিরঞ্জিত করে খণ্ডিত তথ্য প্রচার করছে কি না? এটি অবিশ্বাস্য ধরনের কোনো দাবি করছে কি না? (সূত্র: কানাডিয়ান সেন্টার ফর সাইবার সিকিউরিটি) 

এ প্রশ্নগুলোর চিন্তা করার পর সন্দেহ তৈরি হলে সেটির অর্থ কিন্তু এই নয় যে তথ্যগুলো সত্য বা মিথ্যা, সেটির অর্থ হলো তথ্যগুলো বিশ্বাস করতে হলে অধিকতর যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন হবে। প্রযুক্তিগতভাবে সেটি করা সম্ভব হলে ভালো, না হলে কমপক্ষে মূলধারার কোনো গণমাধ্যম থেকে সে সংবাদ প্রচার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই শ্রেয়। ফেক নিউজ এমনভাবে তৈরি করা হয়, সেটি যেন আমাদের প্রলুব্ধ করে। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষণের মতো, ফেক নিউজের প্রতিও আকর্ষণ থাকাটা স্বাভাবিক। তবে জেনে–বুঝেও সেটি বিশ্বাস করার প্রবণতা থাকাটা অস্বাভাবিক। 

ড. বি এম মইনুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক

[email protected]