শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জনরোষের ভয়ে শুধু আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মী বা মন্ত্রীরাই পালিয়ে যাননি, পালিয়েছেন প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা, বিচারপতি, পুলিশের নানা স্তরের কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারাও।
তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ দমনে নির্বিচার বল প্রয়োগ করে মানুষ হত্যা এবং গত ১৫ বছরে ঘটে যাওয়া গুম, খুন, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের তদন্ত হবে এবং অভিযুক্তরা শাস্তি পাবেন—নতুন সরকারের কাছে এটা সবাই আশা করে।
গত কয়েক দিনে সরকারের ঘনিষ্ঠ আলোচিত কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। কিন্তু এসব গ্রেপ্তারের ঘটনার সঙ্গে গত সরকারের আমলের কৌশলের মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ মনে করছে, শেখ হাসিনা পালানোর দিন ৫ আগস্ট থেকেই তাঁরা আটক আছেন। কিন্তু পুলিশ সেই পুরোনো কায়দায় তাঁদের গ্রেপ্তারের গল্প প্রচার করছে।
এ পর্যন্ত ক্ষমতাচ্যুত সরকারের যে ছয় আলোচিত ব্যক্তি ঢাকায় গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁদের গ্রেপ্তার প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে যে প্রশ্ন আছে, তা আগেই উল্লেখ করেছি। তাই এ ব্যাপারে স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করার বিষয়টি জরুরি হয়ে পড়েছে। যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া মেনেই কাজটি করা উচিত, যাতে ভবিষ্যতে কোনো প্রশ্ন উঠতে না পারে। আটক বা গ্রেপ্তার নিয়ে যেন আগের মতো গল্প বানানো না হয়।
জনরোষের ভয়ে অনেকে যে সেনাবাহিনীর কাছে আশ্রয় চেয়েছিলেন এবং সেনাবাহিনী যে আশ্রয় দিয়েছে, তা সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান নিজে নিশ্চিত করেছেন। ১৩ আগস্ট সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘কারও যদি জীবন বিপন্ন হয়, ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে, অবশ্যই আমরা তাঁদের আশ্রয় দিয়েছি। তাঁদের প্রতি যদি কোনো অভিযোগ থাকে, মামলা হয়, অবশ্যই তাঁরা শাস্তির আওতায় যাবেন। কিন্তু অবশ্যই আমরা চাইব না যে বিচারবহির্ভূত কোনো কাজ হোক, হামলা হোক। তাঁদের জীবনের যে হুমকি আছে, সেটার জন্য আমরা তাঁদের আশ্রয় দিয়েছি। যে দলেরই হোক, যে মতেরই হোক, যে ধর্মের হোক, সেটা আমরা করব।’
গত সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও তাঁদের সহযোগীরা কে কোথায় আছেন, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন ও কৌতূহল থাকা স্বাভাবিক। সেনাপ্রধানের বক্তব্যে সেই কৌতূহল অনেকটাই দূর হয়ে যায়। কিন্তু এরপর সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান যে কায়দায় গ্রেপ্তার হলেন বলে ডিএমপি থেকে জানানো হলো, তা জনগণের কাছে খুব বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। এরপর একই কায়দায় আরও কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছেন বা গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
এ নিয়ে গতকাল রোববার প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে আমরা প্রশ্ন তুলেছিলাম, সাবেক মন্ত্রীসহ আলোচিতরা কোথা থেকে গ্রেপ্তার হচ্ছেন। এরপর আমরা আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাই। সেখানে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে প্রাণ রক্ষায় বিভিন্ন সেনানিবাসে মোট ৬২৬ জনকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ৬১৫ জন পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় নিজ উদ্যোগে সেনানিবাস ছেড়ে গেছেন। বিভিন্ন অভিযোগ ও মামলার কারণে চারজনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে হস্তান্তর করা হয়েছে। আর এখনো সেনানিবাসে আছেন সাতজন।
আইএসপিআরের এই বিবৃতিতে মানুষের অনেক প্রশ্ন ও বিভ্রান্তির জবাব পাওয়া গেছে। দ্রুত বিষয়টি পরিষ্কার করায় সেনা নেতৃত্ব ও আইএসপিআরকে ধন্যবাদ জানাই।
এরই মধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অনেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা হচ্ছে। আইএসপিআরের বিবৃতি অনুযায়ী, আশ্রয় নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৭ জন ছাড়া বাকি ৬১৫ জন সেনানিবাস ত্যাগ করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁরা এখন কোথায় আছেন? বিশেষ করে যাঁদের বিরুদ্ধে নানা গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের আইনের আওতায় আনার ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কী পদক্ষেপ নিচ্ছে?
এ পর্যন্ত ক্ষমতাচ্যুত সরকারের যে ছয় আলোচিত ব্যক্তি ঢাকায় গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁদের গ্রেপ্তার প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে যে প্রশ্ন আছে, তা আগেই উল্লেখ করেছি। তাই এ ব্যাপারে স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করার বিষয়টি জরুরি হয়ে পড়েছে। যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া মেনেই কাজটি করা উচিত, যাতে ভবিষ্যতে কোনো প্রশ্ন উঠতে না পারে। আটক বা গ্রেপ্তার নিয়ে যেন আগের মতো গল্প বানানো না হয়।
অন্যদিকে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যেভাবে মামলা হচ্ছে, সেগুলোর ভবিষ্যৎ কী, সেই প্রশ্নও উঠেছে। যার সন্তান, ভাই বা স্বজন নিহত হয়েছেন, তিনি আদালতের কাছে প্রতিকার চাইতে মামলা করতেই পারেন। কিন্তু কাউকে আসামি করার ক্ষেত্রে তা কতটা প্রমাণযোগ্য, তা বিবেচনার দায়িত্ব পুলিশের। যেভাবে মামলা করা হচ্ছে, তাতে আদৌ অভিযোগ প্রমাণ করা যাবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে আইনজীবী ও আইনবিশেষজ্ঞদের মধ্যে।
দেখা যাচ্ছে গ্রেপ্তার, মামলা বা রিমান্ড—এগুলো এখনো পুরোনো কায়দাতেই হচ্ছে। বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর যদি একটি-দুটি মামলাও খারিজ হয়ে যায়, তবে মামলাগুলো প্রতিহিংসামূলক বা রাজনৈতিক হিসেবে বিবেচিত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে পারে। পুলিশ ও আদালতের ভূমিকা এবং বিচারের প্রক্রিয়ায় যেন কোনোভাবেই পুরোনো অভ্যাসের প্রতিফলন না ঘটে, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।
অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার বা রিমান্ডের ক্ষেত্রে মানবাধিকারের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। আগের সরকার যেহেতু এসব ক্ষেত্রে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন করেছে, তাই নতুন সরকারকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলী রীয়াজ তাঁর এক লেখায় (শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা: বিচারপ্রক্রিয়া যেন বিতর্কিত না হয়, প্রথম আলো ১৬ আগস্ট) লিখেছেন, ‘এমন আচরণ করা ঠিক হবে না, যা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অপরাধকে লঘু করে দিয়ে অন্যান্য বিষয়কে প্রধান করে ফেলে। মনে রাখতে হবে, সারা পৃথিবী এখন বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে, অধিকাংশ মানুষ এই অভ্যুত্থানের মধ্যে তৈরি সরকারের কাছে আশা করে যে তাদের আচরণ হবে আইনানুগ; কেননা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া দেশকে বদলে দেওয়া যাবে না।’
জুলাই-আগস্টের শিক্ষার্থী আন্দোলনের সময় যেসব হত্যার ঘটনাগুলো ঘটেছে এবং আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের শাসনের সময় ঘটে যাওয়া গুম, খুনের অভিযোগ বা আয়নাঘরে বছরের পর বছর আটকে রাখার মতো ঘটনাগুলোর বিচার সবচেয়ে কার্যকরভাবে করার পথ কী, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
দেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের কথা আইন উপদেষ্টার মুখে শুনেছি। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি), জাতিসংঘের অধীনে তদন্তসহ অনেক কিছুই আলোচনায় আছে। কোন বিচারিক প্রক্রিয়ার সম্ভাব্য ফলাফল কী হতে পারে, সেই আলোচনা শুরু হয়েছে। সরকারকে এ ব্যাপারে দ্রুত নীতিগত সিদ্ধান্তে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য হওয়া উচিত সব অপরাধের বিচার নিশ্চিত করা এবং সেই বিচার হতে হবে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য।
এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক