এবারের বাজেট কতটা সাদা, কতটা কালা

একধরনের অর্থনৈতিক অস্বস্তির মধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট জাতীয় সংসদে পেশ হলো। এটি জনমনে কতটা স্বস্তি বয়ে আনবে, সেটি নিয়ে নানা আলোচনা–বিশ্লেষণ চলছে। তবে একজন অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে মনে করি, প্রতিটি আর্থিক পরিকল্পনার কিছু ভালো দিক এবং কিছু কালো দিক থাকে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রধান যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষত, সেগুলোকে এই বাজেট কতটুকু ধারণ করছে, কতটুকু উপশম করতে পারছে, তার ওপর নির্ভর করছে বাজেটের ভালো, মন্দ বা কালো দিকটি।

এবারের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত, কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর করহার কমানো, সংসদ সদস্যের আমদানি করা গাড়ির ওপর কর আরোপ প্রভৃতি বাজেটের ইতিবাচক দিক। এ ছাড়া সরকারি কর্মচারীদেরও সর্বজনীন পেনশনের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত এবং শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি ভালো দিক।

বাজেটে আইসক্রিম, পানীয় (কার্বনেটেড বেভারেজ), সিগারেট, ফলের রস প্রভৃতি পণ্যের ওপর শুল্ককর বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। এ ছাড়া কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস সেবায় ব্যবহৃত ফিল্টার, ডেঙ্গুর কিট এবং ক্যানসারের ওষুধের কাঁচামাল ইত্যাদি ক্ষেত্রে শুল্ককর হ্রাসের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা বাজেটের ভালো দিক।

আরও পড়ুন

বর্তমান বাজেটে সরকার অনেক ক্ষেত্রে ভালো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ সত্ত্বেও বাজেটের কিছু মন্দ দিক রয়েছে, যা এই চকচকে চিত্রটির ওপর দাগ কেটে আছে। প্রথমেই বলতে হবে জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়। ডলারের মানের অবনমন এবং ক্রমবর্ধমান জ্বালানির দাম বৃদ্ধির প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়ে।

অনেক দরিদ্র মানুষ প্রতিদিন পেটপুরে খেতে হিমশিম খাচ্ছে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে পরিবহনের ভাড়া বেড়েছে। এই বৃদ্ধি অন্য সব পণ্য ও পরিষেবার দামকে সরাসরি প্রভাবিত করছে, যা মানুষের প্রতিদিনের জীবনসংগ্রামকে দুর্বিষহ করে তুলছে। কিন্তু বাজেটে মূল্যস্ফীতি প্রশমনে গৃহীত পদক্ষেপগুলো আশাব্যঞ্জক নয়। তেমনি স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ আশানুরূপ হয়নি। দেশের সরকারি হাসপাতালসহ সার্বিকভাবে স্বাস্থ্যসেবার মান নিম্নগামী। দেশের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে। স্বাস্থ্য খাতে কম বরাদ্দে মানুষ মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হবে।

অনেক কৃষককে তাঁদের উৎপাদিত পণ্যের দাম কমে যাওয়ায় লোকসান গুনতে হয়। উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম ঠিকমতো না পেয়ে বা কৃষিতে মুনাফা কমে গেলে কৃষক দিনে দিনে কৃষিকাজে আগ্রহ হারাচ্ছেন। অন্যদিকে কৃষকেরাও জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছেন এবং তাঁদের মৌলিক চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হয়। এ ক্ষেত্রে কৃষকদের বাজার ব্যবস্থাপনা এবং তাঁদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে দিকনির্দেশনামূলক কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

একদিকে বলা হচ্ছে দুর্নীতির বিষয়ে কাউকে ছাড় নয়, অন্যদিকে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জন উৎসাহিত করা হচ্ছে। কালোটাকা সাদা করার অনৈতিক সুযোগ ফিরিয়ে আনায় বাজেটের কালো দিকটি সবচেয়ে বেশি ফুটে উঠেছে।

প্রস্তাবিত বাজেটে সামগ্রিকভাবে শিল্পায়নের বিষয়টি অবহেলিত। শিল্পের কাঁচামালসহ বিভিন্ন পণ্যে আমদানি শুল্ক–কর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। এ ছাড়া, ক্ষুদ্র, কুটির এবং মাঝারি শিল্প নিয়ে সরকারের কোনো দিকনির্দেশনা নেই।

যদিও বাংলাদেশে ট্যুরিজম একটি সম্ভাবনাময় খাত, যা দিনে দিনে ব্যাপ্তি লাভ করছে, দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। এই খাতে ভ্যাট দ্বিগুণ করা হলে এই সম্ভাবনায় ভাটা পড়তে পারে। অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান শেয়ারের দাম পতনে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা চরম হতাশ এবং দিশেহারা। এবারের বাজেটে মন্দা শেয়ারবাজার চাঙা করার কোনো নির্দেশনা বা কোনো প্রণোদনা নেই। উল্টো মূলধনি মুনাফার ওপর কর বসানো হয়েছে।

দেশে শিক্ষিত বেকারত্ব প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিনিয়ত অনেক শিক্ষার্থী ডিগ্রি সমাপ্ত করে চাকরির বাজারে যুক্ত হচ্ছেন এবং বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেকারত্ব হ্রাসের বিষয়ে কোনো লক্ষ্যমাত্রা নেই।

বাংলাদেশ দুর্নীতিতে এখন আর চ্যাম্পিয়ন না হলেও এর সর্বব্যাপী এবং সর্বগ্রাসী কুৎসিত চেহারা সমাজে এখন আরও ব্যাপকতা লাভ করেছে। পুলিশের সাবেক আইজিপি, সাবেক সেনাপ্রধান এবং ভারতে নিহত সংসদ সদস্যের দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র সামনে এসেছে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের এসব দুর্নীতির চলমান সমালোচনার মধ্যেই বাজেটে এবারও কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

একদিকে বলা হচ্ছে দুর্নীতির বিষয়ে কাউকে ছাড় নয়, অন্যদিকে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জন উৎসাহিত করা হচ্ছে। কালোটাকা সাদা করার অনৈতিক সুযোগ ফিরিয়ে আনায় বাজেটের কালো দিকটি সবচেয়ে বেশি ফুটে উঠেছে।

দেশে খেলাপি ঋণ রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে। ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় ১১ শতাংশ। এর মাধ্যমে দেশের ব্যাংকগুলোর অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনার একটি ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। খেলাপি ঋণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অর্থ পাচার, যা দেশের অর্থনীতির আর এক ভয়াবহ কালো দিক। বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ অর্থ প্রতিবছর পাচার হচ্ছে, তা রোধ সম্ভব হলে ঋণের জন্য আইএমএফের দ্বারস্থ হতে হতো না, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত নিয়ে ভাবতে হতো না।

২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) এক প্রতিবেদনে প্রকাশ পায়, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে পাচার হয়েছে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের প্রায় ২০ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে পাচার হচ্ছে। অর্থনীতির এসব দুষ্ট ক্ষত সারাতে বাজেটে কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

সবশেষে বাজেট শুধু অঙ্কের হিসাব নয়, এটি একটি সমাজের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দর্শনের সংখ্যাবাচক প্রতিচ্ছবি। বাজেটকে যদি সত্যিকার গণমুখী হতে হয়, তবে সমাজের প্রধান অস্বস্তিগুলোর গুরুত্ব এবং সেসবের একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান সেখানে থাকাটা বাঞ্ছনীয়। সে বিচারে অঙ্কের হিসাবে বাজেটে ঘাটতি যা–ই থাকুক, এটি গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণ, সুশাসন নিশ্চিত এবং দুর্নীতি রোধে যে ভূমিকা রাখা প্রয়োজন, তার ঘাটতি প্রকট এবং সুস্পষ্ট।

  • ফরিদ খান অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, [email protected]