যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ৪৬ জন প্রেসিডেন্টের মধ্যে তৃতীয় প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন। জেফারসন ছিলেন একাধারে উদ্ভাবক, কূটনীতিক, আইনজীবী, স্থপতি, রাজনীতিক, আইন প্রণয়নকারী ও দার্শনিক। সব ছাপিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের প্রাথমিক খসড়া প্রণয়নকারী। খসড়া প্রণয়ন কমিটিতে আরও চারজন সদস্য ছিলেন। প্রাথমিকভাবে জেফারসনকেই দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রাথমিক খসড়া তৈরি করার জন্য। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৩৪ বছর।
ঘোষণাপত্র লেখায় মনোনিবেশ করার জন্য জেফারসন তাঁর নিজ বাসা ছেড়ে ফিলাডেলফিয়ায় তিনতলা একটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন। ওই বাড়িতে বসেই দেশটির স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের প্রথম খসড়া সম্পন্ন করেছিলেন।
ঘোষণাপত্রটি কংগ্রেস কর্তৃক গৃহীত হয় ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই। এই দিনটি যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার এ ঘোষণা বানচাল করার জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তা সফল হয়নি। সে ইতিহাস বেশ লম্বা।
ফিলাডেলফিয়ার যে বাড়িতে বসে জেফারসন সে দেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র লিখেছিলেন, সেটি ‘দ্য ডিক্লারেশন হাউস’ হিসেবে আজও পরিচিত। যে চেয়ার ও টেবিলে বসে জেফারসন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র লিখেছিলেন, সেগুলো আজও অবিকৃতভাবে রয়েছে। টমাস জেফারসন সে দেশের ফাউন্ডিং ফাদারদের একজন। উল্লিখিত বর্ণনা এ কারণে দেওয়া হলো, মার্কিন জাতি তাদের স্বাধীনতার ঘোষণাকে কত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে, সেটি দেখানোর জন্য।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ১৫ জানুয়ারির মধ্যে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণা দেওয়ার দাবি তুলেছে। সরকারের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে ইতিবাচক বার্তা দেওয়া হয়েছে। এই ঘোষণাপত্রে সবার মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। জুলাইয়ের ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থানে দল-মত, ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই অংশ নিয়েছিল।
দুই.
দেশে বর্তমানে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে রাজনীতির অঙ্গনে রীতিমতো বইছে লু হাওয়া। কয়েক সপ্তাহ আগেও এটা নিয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য ছিল না। বিষয়টি সামনে এল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা যখন ঘোষণা করলেন গত ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তাঁরা জুলাই ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র পাঠ করবেন। এর দুই দিন পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সংবাদ সম্মেলন করে জানালেন, ছাত্রদের ঘোষণাপত্র পাঠের সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই এবং এটি হচ্ছে ‘প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ’।
এটা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করল। এর এক দিন পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানালেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরি করবে সরকার। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ অংশগ্রহণকারী সব শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দল ও পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্রটি প্রস্তুত করা হবে। এতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ঐক্যের ভিত্তি ও জনগণের অভিপ্রায় ব্যক্ত হবে (প্রথম আলো, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪)। অর্থাৎ সরকার সবাইকে নিয়ে গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরি করবে। এটি তখন আর কোনো একটি গ্রুপের কিংবা পক্ষের ‘প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ’ থাকল না। এটি রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে ‘পাবলিক ইনিশিয়েটিভে’। এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ১৫ জানুয়ারির মধ্যে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণা দেওয়ার দাবি তুলেছে। সরকারের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে ইতিবাচক বার্তা দেওয়া হয়েছে। এই ঘোষণাপত্রে সবার মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। জুলাইয়ের ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থানে দল-মত, ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই অংশ নিয়েছিল।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে দাবি তোলা হয়েছে জুলাই ঘোষণাপত্রে গত ১৬ বছরে তাদের ওপর যে নির্মম নির্যাতন চলেছে, সেটি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অবশ্যই। শুধু বিএনপি নয়, বিগত স্বৈরাচারের আমলে বিরোধী দলের যেসব নেতা-কর্মীর ওপর নির্যাতন চলেছে, গুম, খুন, জখম হয়েছে, নির্বিচার গুলি চলেছে, হাজার হাজার হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে রাখা হয়েছে, সেগুলোও ঘোষণাপত্রে তুলে ধরতে হবে। আয়নাঘরের নির্মম নির্যাতনের কথা আসতে হবে।
শুধু রাজনৈতিক দল নয়, সিভিল সোসাইটির ওপর যে দমন-পীড়ন চলেছে, সেগুলোও থাকতে হবে। স্বাধীন মতামত প্রকাশে বিগত সরকার যে বাধা দিয়েছে, সেগুলোর বর্ণনা থাকতে হবে। উল্লেখ করতে হবে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো ঘৃণ্য আইন করে মানুষকে দিনের পর দিন কীভাবে হয়রানি করা হয়েছে। স্বাধীন সংবাদপত্রের ওপর যে খড়্গ নেমে এসেছিল, সেটিও আসা দরকার। ঘোষণাপত্রে থাকা দরকার দেশ ও দেশের বাইরে থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংবাদকর্মীরা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন।
পাশাপাশি এটিও থাকা দরকার একটি নির্বাচিত সরকার জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ধীরে ধীরে কীভাবে একনায়কতন্ত্রের চরমে পৌঁছায় এবং জনগণের শত্রুতে পরিণত হয়। ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে বারবার মানুষকে কীভাবে স্বৈরাচারী সরকার প্রতারিত করেছে, সেটির বর্ণনা থাকতে হবে।
সাবেক সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকার লুটপাট, দুর্নীতি, বিদেশে টাকা পাচার, দলীয়করণ, সন্ত্রাস, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা—এসব উল্লেখ থাকতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বের সঙ্গে ঘোষণাপত্রে যেটি আসতে হবে, তা হলো ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে এই দেশের তরুণসমাজ কীভাবে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে জুলাই-আগস্টে আন্দোলন সফল করেছেন। বিশেষ করে তাঁদের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের কথা।
এই অভ্যুত্থানে সেনাবাহিনী যে সাহসিকতা দেখিয়েছে, সেটিও সেখানে আসা দরকার। এ আন্দোলনে রিকশাচালক থেকে শুরু করে সব পেশার মানুষের অবদান উল্লেখ করতে হবে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পীসমাজ, সাংস্কৃতিক কর্মী, অভিভাবক-সমাজ, নারীসমাজ, চিকিৎসকসহ অন্যান্য পেশার নাম উল্লেখ করা জরুরি। এ ঘোষণাপত্র পাঠ করে যেন দেশের প্রতিটি মানুষ উপলব্ধি করতে পারেন যে ঘোষণাপত্রে তাঁদের কথা বলা হয়েছে এবং তাঁদের অবদানের কথা স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
তিন.
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে যেহেতু বলা হয়েছে, আশা করা যায় যে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র পেশ করা হবে। এর অর্থ দাঁড়ায় এটি হতে হবে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ঘোষণাপত্র। যেখানে সবার স্বার্থ সংরক্ষিত হবে। বিভিন্ন জায়গা থেকে কথা উঠেছে যে গণ-অভ্যুত্থানের পর ফ্যাসিস্টবিরোধী শক্তির মধ্যে ফাটল ধরেছে এবং তারা একে অপরের সঙ্গে স্বার্থকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সংগঠন কিংবা ব্যক্তিবিশেষ জুলাই অভ্যুত্থানে নিজেদের ভূমিকাকে বড় করে দেখানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। জুলাই অভ্যুত্থানের সম্মিলিত ঘোষণা এলে ফ্যাসিস্টবিরোধী সংগঠনগুলোর মধ্যে দূরত্ব কমে ঐক্যের পথ প্রশস্ত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে কেউ কেউ বলছেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র আন্দোলনের শুরুতে দেওয়া উচিত ছিল। এটা ঠিক। ঘোষণাপত্র আগে দিতে পারলে ভালো হতো। ঘোষণাপত্র দিতে দেরি হলেও এর তাৎপর্য রয়েছে। কারণ, রাষ্ট্রের আগামী দিনের পথচলার অনেক বিষয় এ ঘোষণাপত্রে থাকবে। সংবিধান সংস্কারেও থাকবে এর ছাপ। ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে ঐক্যের পথ সুগম হওয়ারও সুযোগ থাকবে। এ সুযোগ হেলায় নষ্ট করা ঠিক হবে না।
প্রায় আড়াই শ বছর আগে তৈরি যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তৈরির ঘটনা সে দেশের জন্য এখনো প্রাসঙ্গিক। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাও যেন এমন একটি দলিল হিসেবে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সমান গুরুত্ব পায়, সে প্রত্যাশা সবার। ঘোষণাপত্রটি সেভাবেই রচিত হওয়া দরকার।
● ড. মো. সাহাবুল হক অধ্যাপক, পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়