সেনা ও ছাত্র–জনতার ঐক্যে যেন ফাটল না ধরে

গণ–অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ছাত্র–জনতার বিজয় উদ্‌যাপন। জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বিকেলেছবি: কবির হোসেন

সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ধরনের বিবৃতি, সাম্প্রতিক সময়ে স্পর্শকাতর তথ্য প্রকাশ এবং এসব বিবৃতি ও তথ্যের বিপরীতে পাল্টাবিবৃতি নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা মাত্রার উৎকণ্ঠা লক্ষণীয়। সেনাবাহিনী ও নির্দিষ্টভাবে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের গণ-অভ্যুত্থান ও গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ের ভূমিকা নিয়ে নানামুখী মন্তব্য এবং তা নিয়ে যার যার মতো বিশ্লেষণের মাধ্যমে অস্থিরতা ও উদ্বেগ সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে বলে মনে হয়।

অথচ এই সেনাবাহিনী ও সেনাবাহিনীর প্রধান কর্তৃক ৩ আগস্ট ছাত্র-জনতার ওপর গুলি না চালানোর সিদ্ধান্ত যেভাবে তরুণদের আরও সাহসী করেছিল এবং আন্দোলনকে বেগবান করেছিল, কেউ কেউ যেন তা মনে রাখার প্রয়োজনবোধ করছেন না। বিষয়টি দুঃখজনক। বর্তমানে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে মাঠপর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেসি বা তাৎক্ষণিক কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে সেনাসদস্যরা নিয়োজিত আছেন।

যাঁরা আগেকার সামরিক শাসন প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বর্তমান সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধানের ধৈর্য ও তরুণ প্রজন্মের প্রতি সম্মানবোধের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পার্থক্য লক্ষ করেছেন। এমন একটি পরিপ্রেক্ষিতে কেবল প্রচার ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত লক্ষ্য নিয়ে কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই বেফাঁস কিংবা স্পর্শকাতর বা চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ মাঠপর্যায়ে থাকা সেনাসদস্যদের মনোবলের ওপর স্বাভাবিকভাবেই প্রভাব পড়ে। ফলে পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়ে এভাবে বক্তব্য দেওয়া কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

সম্প্রতি আলোচিত এক আইনজীবী, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাড়া জাগানো বক্তা, সর্বোপরি জুলাই বিপ্লবের নেতৃত্ব দেওয়া দুজন ছাত্রনেতাসহ কেউ কেউ এমন কিছু কথা বলেছেন, যা সশস্ত্র বাহিনীর বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতীয়মান হয়েছে। জুলাই বিপ্লবের অপর অংশীজনেরাও দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এমন বিরূপ বক্তব্য করা উচিত নয় বলে সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছেন। সুস্থ রাজনীতির চর্চা, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও গণতন্ত্রের বৃহত্তর স্বার্থে মাঠপর্যায়ে সেনাবাহিনীর সদস্যদের একতা, শৃঙ্খলা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কর্তব্য পালন ও নির্বাচন শেষে সেনানিবাসে ফিরে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। বিষয়টি বিবেচনায় নিলে কোনো বিশেষ মহল থেকে এমন বিভ্রান্তিকর বক্তব্য আশঙ্কার জন্ম দেয়, যা দেশ ও সশস্ত্র বাহিনীর জন্য অকল্যাণকর।

অন্যদিকে ভারতীয় কিছু সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমাদের দেশপ্রেমী সেনাবাহিনীর মধ্যে অঘটন সৃষ্টির অসৎ উদ্দেশ্যেই যেন কাল্পনিক ও অযৌক্তিক সংবাদ পরিবেশনার ক্ষেত্রে অশুভ প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এমনকি সামরিক অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান ও উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের বন্দী ও অচিরেই হত্যাযজ্ঞ শুরুর মতো বানোয়াট সংবাদ পরিবেশনও করেছে ভারতে কিছু তথাকথিত সংবাদমাধ্যম। ভারতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও একই ধারাবাহিকতা মিথ্যা প্রচারণা চলছে।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই ভুল-বোঝাবুঝির সময়ে আলোচনার মাধ্যমে সব পক্ষের মধ্যে জুলাইয়ে দেখা ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও ঐক্য ফিরিয়ে আনবেন, এটাই আজ চরম প্রত্যাশিত। সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সমঝোতা এবং সব পক্ষের ধৈর্য ও বিচক্ষণতার ওপর নির্ভর করছে জাতির ভবিষ্যৎ। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দিকে সবাইকে ধাবিত করলেই সফলভাবে গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার ইতিহাস রচিত হতে পারে, যা হবে স্বর্ণাক্ষরে লেখার মতো। অন্যথায় অনৈক্য আর ভুল-বোঝাবুঝির চোরাপথে অন্য কোনো মহল প্রবেশ করে নষ্ট করে দিতে পারে সব অর্জন।

পাকিস্তান আমলে ১০ বছর সামরিক শাসন ও অনেক উন্নয়ন করেও সেনাশাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে পাকিস্তানি অপর জেনারেলদের সমর্থন না পাওয়ায় আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। আমাদের মনে আছে, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আইয়ুব খানের মতো প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দাপটের সঙ্গেই দেশ চালিয়েছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ নূরউদ্দীন এবং অপরাপর সেনা কর্মকর্তা ও সদস্যরা রাজনৈতিক কারণে জনগণের প্রতিপক্ষ না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে নব্বইয়ে এরশাদের পতন ঘটে। ১৯৯৬ সালের মে মাসে সেনাপ্রধান জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম ও কতিপয় জেনারেল সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর বৃহত্তর অংশের সমর্থন না থাকায় সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

 ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ মূলত গুটিকয় জেনারেল ও ডিজিএফআইয়ের দু-তিনজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিয়ে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সামনে রেখে দেশ পরিচালনার স্বপ্নযাত্রা শুরু করেছিলেন। এর আগে ২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মেয়াদ শেষ হয়। এই মেয়াদ পূর্তিকালে প্রকাশ্য রাজপথে এই জোটের সঙ্গে আওয়ামী জোটের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে এক অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতেই জেনারেল মইনের এক-এগারোর সরকারের প্রতি তখন সমর্থন জুটেছিল।

তবে শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর নীরব অসম্মতি ও নানামুখী চাপের কারণে দুই বছরের মাথায় জেনারেল মইন ইউ আহমেদ অনেকটা হতাশ হয়ে পড়েন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন হলে তিনি কেবল ক্ষমতাই ছাড়েননি, দেশ ছাড়তেও বাধ্য হন। তাঁর ছায়াসঙ্গীরাও আজ দেশছাড়া। তবে এ সময়ে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ কর্মযজ্ঞে এই জাতি প্রথমবারের মতো একটি গ্রহণযোগ্য ভোটার তালিকা পেয়েছিল, যা পরবর্তী সময়ে কেবল যথাযথ নির্বাচনই নয়, জনগণের জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরিতেও সহায়তা করে। সেনাবাহিনীর করা ভোটার তালিকাভিত্তিক সে নির্বাচনও সব মানদণ্ডেই গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। দেশের রাজনীতির ও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় সেনাবাহিনীর অবদানের এসব ঘটনা বা ইতিহাস ভুলে যাওয়াও ভুল হবে।

জুলাই অভ্যুত্থানে বিপ্লবী ছাত্র-জনতার সাহসী ভূমিকা ও ব্যাপক অবদান অবশ্যই চিরস্মরণীয়। বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মৃত্যুঞ্জয়ী ভূমিকাকে অন্য কিছুর সঙ্গে তুলনা করা চলে না। তবে এ কথাও সত্য যে এই তরুণেরা তখন পাশে পেয়েছিল দেশের প্রায় সর্বস্তরের মানুষকে। এর আগে দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও বিভিন্ন দল তাদের ঐক্য ধরে রাখে এবং সুযোগমতো প্রতিবাদ করেছে। বিগত ১৬ বছরে গুম ও খুন হওয়া রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের অবদানকেও শ্রদ্ধা জানাতে হবে। যে নেতারা ১৬ বছর জেল, হাজত আর বিচারালয়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন, তাঁরা ও তাঁদের পরিবার জুলাই বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। দেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম সরকার পতনে প্রকাশ্যে এককাট্টা হয়ে সপরিবার রাজপথে নেমেছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারা।

আন্দোলনে ছাত্র-জনতার এই ঐক্যে ক্রমাগত আঘাত করেও ফাটল ধরাতে পারেনি স্বৈরাচারী সরকার ও তার পেটোয়া বাহিনী। সবার মধ্যে তখন ছিল দেশের স্বার্থে কিছু করার অদম্য বাসনা, যা ইতিহাসে বিরল। পদ-পদবি আর আসনবিন্যাসের বদলে দেশের জন্য আর কী করা যায়, এমন ভাবনাই যেন ছিল আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি। বহু প্রাণহানি, অঙ্গহানি ও সম্পদহানির বিনিময়ে লক্ষ্য অর্জনের পর একই ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় দেশ কাঙ্ক্ষিত ধারায় ফিরে যাবে, এমনটাই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে একের প্রতি অপরের তির্যক মন্তব্য, সন্দেহ ও কাদা-ছোড়াছুড়ি জাতিকে কিছুটা হতাশ করেছে।

এক জটিল ও কঠিন পরিস্থিতিতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়। বিচারালয়ের বিচারক থেকে জাতীয় মসজিদের খতিব আর পুলিশপ্রধান থেকে থানার কনস্টেবল একযোগে পালিয়ে যাওয়ার এমন নজির বিশ্বের কোথাও আছে বলে মনে হয় না। প্রশাসনের তিন স্তম্ভ—আইন, বিচার ও শাসন বিভাগে ব্যাপক শূন্যতা ও অতীতের অরাজকতা মোকাবিলা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। আর নিমজ্জিত অর্থনীতি, বিশেষত ব্যাংক ব্যবস্থাপনার ধস ঠেকানো ছিল প্রায় অসম্ভব কাজ। সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে দেশ। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যোগ্য নেতৃত্ব, উপদেষ্টাদের উদ্যোগ এবং সেনাবাহিনীর অনাবশ্যক হস্তক্ষেপ ও ক্ষমতাচর্চার বদলে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনী দায়িত্ব শেষে ব্যারাকে ফেরার সংকল্প জাতির জন্য স্বস্তিদায়ক।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই ভুল-বোঝাবুঝির সময়ে আলোচনার মাধ্যমে সব পক্ষের মধ্যে জুলাইয়ে দেখা ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও ঐক্য ফিরিয়ে আনবেন, এটাই আজ চরম প্রত্যাশিত। সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সমঝোতা এবং সব পক্ষের ধৈর্য ও বিচক্ষণতার ওপর নির্ভর করছে জাতির ভবিষ্যৎ। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দিকে সবাইকে ধাবিত করলেই সফলভাবে গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার ইতিহাস রচিত হতে পারে, যা হবে স্বর্ণাক্ষরে লেখার মতো। অন্যথায় অনৈক্য আর ভুল-বোঝাবুঝির চোরাপথে অন্য কোনো মহল প্রবেশ করে নষ্ট করে দিতে পারে সব অর্জন।

  • নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ অবসরপ্রাপ্ত মেজর ও বিশ্লেষক

    directoradmin2007@gmail.com