রাজাপক্ষেদের রাজত্বের পতন অন্যদের জন্যও সতর্কবার্তা

রাজনীতিতে যাঁরা পারিবারিক রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাঁদের জন্যও এই ঘটনা একটি সতর্কবার্তাছবি : রয়টার্স

দুই দশকের কাছাকাছি সময় ধরে রাজাপক্ষেদের চার ভাই এবং তাঁদের সন্তানেরা শ্রীলঙ্কাকে এমনভাবে শাসন করছেন, যেন দেশটা তাঁদের পারিবারিক ব্যবসাক্ষেত্র। এর পরিণামই আজকের পরিণতি। অবকাঠামো খাতে নেওয়া তাঁদের বড়, বড় প্রকল্প এবং বন্যার পানির মতো টাকার অপচয়, শ্রীলঙ্কার ঘাড়ে পরিশোধ অযোগ্য ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে স্বাধীনতার পর দেশটিকে সবচেয়ে বাজে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এখন রাজাপক্ষেদের সেই রাজত্বের পতন হলো।

রাজাপক্ষেদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এক দশক ধরে তিনি কঠোর হাতে দেশ শাসন করেছিলেন। নাগরিক স্বাধীনতা হরণ, প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং চীনের সঙ্গে একের পর এক বাজে চুক্তি তিনি করেছিলেন। এসব কর্মকাণ্ডে তিনি তাঁর পরিবারের লোকজনকে সঙ্গে রেখেছিলেন। তাঁর ছোট ভাই গোতাবায়ে রাজাপক্ষে ছিলেন প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রের নীতিনির্ধারক।

২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে খুব কম ব্যবধানে মাহিন্দা রাজাপক্ষে হেরে যান। ক্ষমতা থেকে তাঁকে খুব কম সময়ের জন্য সরে যেতে হয়েছিল। শ্রীলঙ্কার আইনসভায় সে সময় প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা কমানোর সঙ্গে সঙ্গে দুই বারের বেশি কেউ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারবেন না, এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে মাহিন্দা রাজাপক্ষের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু রাজাপক্ষে পরিবার তাদের রাজত্ব পুনরুদ্ধারে নতুন ছক এঁকে ফেলে। গোতাবায়ে তাঁর মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেন।

প্রেসিডেন্ট পদে জয়ী হওয়ার জন্য খুবই ভালো অবস্থানে ছিলেন গোতাবায়া। ২০০৯ সালে মাহিন্দা রাজাপক্ষে যখন বিদ্রোহী তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত অভিযানের নির্দেশ দেন, সে সময় গোতাবায়া ছিলেন তাঁর প্রতিরক্ষাসচিব। ওই অভিযানের মধ্য দিয়ে ২৬ বছরের নির্মম রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরিসমাপ্তি ঘটে। এরপর রাজাপক্ষের ভাইয়েরা শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিদের মাঝে বীর হিসেবে আবির্ভূত হন।

চীনের লক্ষ্য হচ্ছে কোনো দেশের ক্ষমতাশালী লোকদের সঙ্গে চুক্তি করা এবং দেশটির দুর্বল জায়গাগুলো ব্যবহার করে সেখানে তাদের কৌশলগত অবস্থানকে পোক্ত করা। শ্রীলঙ্কায় চীনের বৃহত্তর লক্ষ্যটা কী, সেটা ২০১৪ সালের একটি ঘটনা থেকে আঁচ করা যায়। সে সময়ে চীনের দুটি সাবমেরিন কোনো ঘোষণা ছাড়াই কলম্বোয় আসে।

তামিল টাইগার বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত চূড়ান্ত ওই সামরিক অভিযানে ৪০ হাজার বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করা হয়েছিল। এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুদ্ধাপরাধের জোরালো অভিযোগ ওঠে। জাতিসংঘ এ ঘটনাকে ‘আন্তর্জাতিক আইনের পুরোপুরি লঙ্ঘন’ বলে বর্ণনা করে। যুদ্ধকালীন সামরিক কমান্ডার সারাথ ফনসেকা বলেন, গোতাবায়ে বিদ্রোহী নেতাদের আত্মসমর্পণের জন্য এই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দেন। পরবর্তীকালে গোতাবায়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতে স্থায়ী আবাস গড়ে তোলেন। সেখানে যুদ্ধাপরাধের দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছিল।

কিন্তু তামিলদের বিরুদ্ধে এই নির্মম দমন অভিযানের মধ্য দিয়ে রাজাপক্ষের ভাইয়েরা শুধু ঠান্ডা মাথায় সিংহলিদের স্বার্থকেই রক্ষা করেছিলেন। গোষ্ঠীগত–জাতীয়তাবাদের স্বার্থ রক্ষার পুরস্কার হিসেবে গোতাবায়া ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয় লাভ করেন। নির্বাচিত হওয়ার পরপরই ভাই মাহিন্দাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন। মাহিন্দা এরপর তাঁর দুই ছেলে, অন্য দুই ভাই ও ভাতিজাকে মন্ত্রীর পদে বসান।

শ্রীলঙ্কায় বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে ঢুকে তাঁর শয়নকক্ষের বিছানায় গড়াগড়ি খেয়েছেন
ছবি : রয়টার্স

ওই বছরেই ইস্টার সানডের প্রার্থনা অনুষ্ঠানে ইসলামি চরমপন্থীদের হামলায় ২৭৭ জন নিহত হন, শত শত মানুষ আহত হন। ২০০৯ সাল থেকে শ্রীলঙ্কার ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে যে উত্তেজনা ভেতরে–ভেতরে ফুটছিল, এ হামলা ছিল তারই বহিঃপ্রকাশ। ২০০৯ সালের সামরিক অভিযান হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ তামিলদের প্রান্তিক করে ফেলা হয়। গৃহযুদ্ধ শেষে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি ও শ্রীলঙ্কার মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় সংঘাতের বীজ রোপিত হয়। যদিও শ্রীলঙ্কার মোট জনসংখ্যার খুব ক্ষুদ্র অংশ মুসলমান। ইস্টার সানডের দিনে বোমা হামলার ঘটনাটি সিংহলি জাতীয়তাবাদের পালে নতুন জোয়ার তোলে।

শ্রীলঙ্কায় জাতিগত ও ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে যখন বিভাজন গভীর থেকে গভীর হচ্ছিল, সে সময় গোতাবায়ে তাঁর ভাই মাহিন্দার দেখানো পথে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বাড়ানোর (সম্রাটদের যে রকম ক্ষমতা থাকে) উদ্যোগ নেন। ২০২০ সালে একটি সাংবিধানিক সংশোধনী পাস করা হয়, যেখানে প্রেসিডেন্টকে আইনসভা ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে গোতাবায়া শ্রীলঙ্কাকে অর্থনৈতিক মরণদশার সর্পিল পথে ঠেলে দেন। চীনের সঙ্গে চুক্তি করার মধ্য দিয়ে যার সূচনা করেছিলেন তাঁর ভাই মাহিন্দা।

মাহিন্দার শাসনামলে জাতিসংঘে যুদ্ধাপরাধের দায়ে রাজাপক্ষেদের বিচারের হাত থেকে রক্ষা করেছিল চীন। রাজাপক্ষেদের রক্ষায় সব সময়ই বর্ম হিসেবে দাঁড়িয়েছিল বেইজিং। এর বিনিময়ে চীন শ্রীলঙ্কার প্রধান প্রধান অবকাঠামো নির্মাণের চুক্তি করে এবং দেশটির প্রধান ঋণদাতা হয়ে ওঠে। চীনের ঋণ বাড়তে বাড়তে পাহাড়সম হয়। রাজাপক্ষেদের বাড়ি হামবানটোটা জেলায় বিশাল খরচের প্রকল্প নেওয়া হয়।

এর মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বিরান বিমানবন্দর, একটা জেলায় যত মানুষ বাস করে তার চেয়েও বেশি আসনের একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম, ১৪০ কোটি ডলার ব্যয়ে সমুদ্রবন্দর (২০১৭ সালে চীনকে ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দেওয়ার আগে যেটি বেশির ভাগ সময় অলস পড়ে থাকত) প্রকল্প রয়েছে। চীনের অর্থায়নে নির্মিত সবচেয়ে বেহিসাবি প্রকল্প হচ্ছে ১৩০০ কোটি ডলারে নির্মিত ‘বন্দর নগর’।

চীনের লক্ষ্য হচ্ছে কোনো দেশের ক্ষমতাশালী লোকদের সঙ্গে চুক্তি করা এবং দেশটির দুর্বল জায়গাগুলো ব্যবহার করে সেখানে তাদের কৌশলগত অবস্থানকে পোক্ত করা। শ্রীলঙ্কায় চীনের বৃহত্তর লক্ষ্যটা কী, সেটা ২০১৪ সালের একটি ঘটনা থেকে আঁচ করা যায়। সে সময়ে চীনের দুটি সাবমেরিন কোনো ঘোষণা ছাড়াই কলম্বোয় আসে। চীনের রাষ্ট্রমালিকানাধীন কোম্পানির বেশির ভাগ মালিকানা আছে, সে রকম একটি কনটেইনার টার্মিনালে সাবমেরিন দুটি ভেড়ে।

সুতরাং চীন এমন একটি দেশকে তাদের কৌশলগত উদ্দেশ্য সাধনের উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছে, যে দেশটি আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীলঙ্কা ক্রমাগত চীনের ঋণে জর্জরিত হয়েছে। এর মধ্যে অনেক ‘গোপন ঋণ’ও রয়েছে, যেগুলোর চুক্তি জনসম্মুখে প্রকাশ না করার শর্তও রয়েছে। কিন্তু ঔদ্ধত্য রাজাপক্ষেদের অন্ধ করে ফেলে, তাঁরা আসন্ন সংকটকে মোটেও পাত্তা দিতে রাজি হননি। ২০১৯ সালে তাঁরা মূল্য সংযোজন কর ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশ করেন। শ্রীলঙ্কার রাজস্ব আয়ের তৃতীয় বড় উৎস মূল্য সংযোজন কর।

প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে ঢুকে সেলফি তুলছেন বিক্ষোভকারীরা
ছবি : রয়টার্স

এরপরই মহামারির আঘাত। শ্রীলঙ্কার বিদেশি মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় দুটি খাত, পর্যটন ও তৈরি পোশাকশিল্পে বড় ধাক্কা লাগে। সম্প্রতি ইউক্রেন যুদ্ধ সর্বশেষ আঘাতটি হানে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। ফলে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ফুরিয়ে যায়। ফলে জ্বালানি, বিদ্যুৎ, খাবার ও ওষুধ ফুরিয়ে যায়। খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো লোকজন রাস্তায় নেমে আসে। বিক্ষোভকারীদের ক্ষোভ প্রশমনের জন্য মে মাসের ৯ তারিখে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। কিন্তু তাতে জনবিক্ষোভ থামেনি। তাঁরা প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ের পদত্যাগের দাবিতে অনড় থাকেন।

আরও পড়ুন

শ্রীলঙ্কায় বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে ঢুকে তাঁর শয়নকক্ষের বিছানায় গড়াগড়ি খেয়েছেন, উঠানে রান্না করে খেয়েছেন। এ ঘটনা জনগণের ক্ষমতার একটি প্রতীক। এশিয়া থেকে লাতিন আমেরিকার রাজনীতিতে যাঁরা পারিবারিক রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাঁদের জন্যও এই ঘটনা একটি সতর্কবার্তা। যখন একটি পরিবার সরকার বা দলের নিয়ন্ত্রণ করে, প্রায়ই তা বিপর্যয়ের কারণ হয়। দুনিয়ার সবচেয়ে সুরক্ষিত রাজত্বের সবচেয়ে দ্রুত পতনের কারণ এটাই।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: মনোজ দে

ব্রহ্ম চেলানি নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ