প্রবীণ নদীকর্মীর ছেঁড়া পাঞ্জাবি ও দখলদারপন্থী প্রশাসন

নদী–অন্তঃপ্রাণ নজির হোসেনকে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তার সামনে লাঞ্ছিত করে অবৈধ দখলদারেরা। তাঁকে নদীতে ডোবানোর হুমকিও দিয়েছে তারা। কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাটেছবি: সংগৃহীত

কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাটে ব্যাপক জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। অবৈধ দখলদারদের স্থাপনার কারণে চাকিরপশার নদের পানি নেমে যেতে না পারায় এই জলাবদ্ধতা। কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসকের নির্দেশে সম্প্রতি জলাবদ্ধতার অবস্থা দেখতে এসেছিলেন কুড়িগ্রাম কৃষি বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা।

কীভাবে, কতটুকু দখল হয়েছে, তার দাগ নম্বরসহ বলতে পারেন নজির হোসেন। তিনি প্রামাণ্য কাগজপত্র নিয়ে এসেছিলেন। ৮৭ বছর বয়স তাঁর। তিনি অত্যন্ত গরিব। চাকিরপশার নদ আন্দোলনে তিনি সারা জীবনে লাখখানেক টাকা ব্যয় করেছেন। তাঁর নামে অনেক মামলাও হয়েছে। এখনো মামলা চলমান। চাকিরপশার কীভাবে প্রভাবশালীরা লুট করেছে, তিনি তা জানেন। এই বয়সে ঠিকমতো কানেও শোনেন না।

সেই নদী–অন্তঃপ্রাণ নজির হোসেনকে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তার সামনে টানাহেঁচড়া করে, মেরে, পাঞ্জাবি ছিঁড়ে দিয়ে হাত থেকে টাকা ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ছিনিয়ে নিয়েছে অবৈধ দখলদার। নদীতে ডোবানোর হুমকিও দিয়েছে তারা।

জনসম্পত্তি অবৈধভাবে দখল করার পর আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হওয়া, প্রশাসনের আনুকূল্য লাভ করা কেবল বাংলাদেশেই সম্ভব। পৃথিবীর আর কোথাও এমনটা আছে কি না, তা জানা নেই।

প্রবীণ নজির হোসেন দীর্ঘদিন ধরে অন্তর্বর্তী সরকারের পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছেন। দুই বছর ধরে তাঁর বড় ইচ্ছা, তিনি রিজওয়ানা হাসানকে একবার বাড়িতে দাওয়াত করে খাওয়াবেন। এমন সহজ–সরল লোকটি যখন স্বপ্ন দেখছিলেন নদ উদ্ধারের, ঠিক তখনই তাঁকে যেভাবে লাঞ্ছিত করা হলো, তা আমাদের সামষ্টিক লজ্জার।

এই লজ্জা কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসককে স্পর্শ করে কি না, জানি না। ছেঁড়া পাঞ্জাবিতে তাঁর দাঁড়িয়ে থাকার ছবি আর তাঁকে টানাহেঁচড়া করার বর্ণনা শুনে আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। নজির হোসেন ভাইয়ের কাছে আমাদের মাফ চাওয়া ছাড়া আর কী করার আছে!

কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন যদি দায়িত্বশীল হতো, তাহলে চাকিরপশার নদের এক ইঞ্চি জায়গাও বেদখল হতো না। এমনকি তারা যদি উদ্ধারে সচেষ্ট হতো, তাহলেও এমন ঘটনা ঘটত না।

মার খাওয়া, মামলার শিকার হওয়া আর নানান ধরনের হুমকি পাওয়া চাকিরপশার নদ সুরক্ষা কমিটির সদস্যদের নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এ কমিটির সমন্বয়ক হিসেবে আমার নামেও দুটি মামলা আছে। আহ্বায়ক, সদস্যদের নামেও অনেক মামলা। চাকিরপশারের অবৈধ দখলদারেরা আমাকে রাজারহাট উপজেলায় অবাঞ্ছিতও ঘোষণা করেছে। এ যদি হয় পরিস্থিতি, তাহলে কীভাবে নদী টিকবে? নদীকে ঘিরে কৃষিভিত্তিক সমাজ কীভাবে টিকবে? পরিবেশ–প্রাণ–প্রকৃতি টিকবে কীভাবে?

আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের কালে দখলদারেরা নিজেদের পরিচয় দিতেন আওয়ামী লীগের নেতা। তখন তাঁরা আন্দোলনকারীদের জামায়াত-বিএনপি বলে সংবাদ সম্মেলন-মানববন্ধন করতেন। বর্তমানে একই দখলদারেরা আন্দোলনকারীদের আওয়ামী লীগ বলে মানববন্ধন করছেন। আন্দোলনকারীদের সরকারবিরোধী প্রমাণ করাই তাঁদের চেষ্টা।

আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের কালে দখলদারেরা নিজেদের পরিচয় দিতেন আওয়ামী লীগের নেতা। তখন তাঁরা আন্দোলনকারীদের জামায়াত-বিএনপি বলে সংবাদ সম্মেলন-মানববন্ধন করতেন। বর্তমানে একই দখলদারেরা আন্দোলনকারীদের আওয়ামী লীগ বলে মানববন্ধন করছেন। আন্দোলনকারীদের সরকারবিরোধী প্রমাণ করাই তাঁদের চেষ্টা।

একজন নব্য দখলদার জুটেছে। তিনি স্থানীয় একটি পত্রিকার মালিক। পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হয় না। আন্দোলনকারীদের নামে হেন অপবাদ নেই, যা ওই পত্রিকা লিখছে না। এত কিছুর মধ্যেও থেমে নেই আন্দোলন।

উচ্চ আদালতের কিংবা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের অবৈধ দখল উচ্ছেদের নির্দেশনা আমলেই নিচ্ছে না কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন। গত ছয় বছরে আন্দোলন চলাকালে তিনজন জেলা প্রশাসক, রাজারহাট উপজেলার জনা ছয় ইউএনও, এর চেয়ে বেশি এসি ল্যান্ড বদলি হয়েছেন। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কয়েকজন চেয়ারম্যানও বদল হয়েছেন। কেবল এডিসি উত্তম কুমার তিন ডিসির আমলে বহাল আছেন।

আন্দোলনকারীদের দীর্ঘদিনের আশঙ্কা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) অবৈধ দখলদারদের রক্ষাকর্তা। তিনি সম্প্রতি আন্দোলনকারীদের ডেকেছিলেন নদের পারে। সেখানে অনেক অবৈধ দখলদারও ছিলেন। তাঁর উপস্থিতিতে আন্দোলনকারীদের হেনস্তা করা হয়েছে। তিনি কোনো প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেননি। শর্ষের মধ্যে ভূত রেখে কুড়িগ্রাম প্রশাসন চলছে কি না, এই প্রশ্ন বারবার তোলা হলেও তিনি বহাল আছেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী হিসেবে সৈয়দা রিজওয়ানা চাকিরপশার পরিদর্শন করেছেন দুই বছর আগে। এক বছরের বেশি হয়েছে উচ্চ আদালতে তিনি চাকিরপশার থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের আদেশ চেয়ে মামলা করেছিলেন। উচ্চ আদালত সেই নির্দেশনাও দিয়েছেন। সেই নির্দেশনা আমলে নেওয়া হয়নি। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে নির্দেশনা দিলেও সেই নির্দেশনাও পালন করেননি জেলা প্রশাসক। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে বারবার বলা হলেও তিনি সেসবের ভ্রুক্ষেপ করেননি।

জেলা প্রশাসকের অবহেলার কারণে হাজার হাজার কৃষকের ফসল পানিতে ডুবে গেছে। সিএস, এসএ, আরএস রেকর্ড এবং গেজেটে সরকারি স্থানে তিনটি পুকুর আছে। সেই পুকুর তিনটির পাড় ভেঙে দিলে এই কৃষকদের ফসল পানির নিচে ডুবত না। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক তাঁর কার্যালয়ে গিয়ে লিখিত দিলেও কোনো কাজ হয়নি।

কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার সদর ইউনিয়নের ইটাকুড়ি নামের নিম্নাঞ্চল থেকে একটি প্রাকৃতিক প্রবাহ বর্তমানে উলিপুর উপজেলার থেতরাই নামক স্থানে তিস্তা নদীতে মিলিত হয়েছে। প্রবাহটির কোথাও নাম চাকিরপশার, কোথাও মরা তিস্তা, কোথাও বুড়ি তিস্তা। এই প্রবাহের পাঁচটি মৌজা সিএস রেকর্ডে বিল শ্রেণিভুক্ত। এখানে অবৈধ দখল আছে প্রায় আড়াই শ একর জমি। স্থানীয় প্রশাসন এই দখলদারের পরম বন্ধু হয়ে আছে। আগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দখলদারেরা বুক উঁচিয়ে বেড়িয়েছে, এখন বিএনপির নামে। তবে এখনো মূল বিএনপির লোকজন দখলদারদের নেতা হয়ে ওঠেননি।

কেউ কেউ কিছু অংশে নিজেদের দখলদারি বজায় রাখার জন্য নিম্ন আদালতের রায় নিয়েছেন। দখল হওয়া জমির মালিক সরকার। এ জমি সরকার বিক্রি করেনি, বন্দোবস্ত দেয়নি, বিক্রি কিংবা বন্দোবস্ত দেওয়ার অধিকারও নেই। সেই জমি ব্যক্তির হওয়ার সুযোগ আইনগতভাবে নেই। আপিল করলেই সেই রায় বদলে যাবে বলে মনে করি। কিন্তু জেলা প্রশাসক এই আপিল করেন না। বিল অংশে অনেকখানি জমি কবুলিয়ত দিয়েছেন জেলা প্রশাসক। জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব সেই কবুলিয়ত বাতিল করা। তিনি সেটিও করেননি। অনেক জমি আছে, যেগুলোর নিরঙ্কুশ মালিক সরকার। সেগুলো থেকেও অবৈধ দখল উচ্ছেদ করছেন না।

বিলের ১৪১ একর জমি লিজ দেওয়া হতো। গত নব্বইয়ের দশকে উন্মুক্ত প্রবাহটিকে বদ্ধ জলাশয় নাম দিয়ে লিজ দেওয়া শুরু হয়েছিল। বছর দুয়েক আগে আন্দোলনের মুখে রংপুর বিভাগীয় কমিশনারের উদ্যোগে আবারও উন্মুক্ত ঘোষণা করা হয় এবং বন্দোবস্ত বন্ধ করা হয়।

এ কাজে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতিরও (বেলা) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এই প্রবাহের ওপর একটি আড়াআড়ি পাকা সড়ক তৈরি করা হয়েছে। সেখানে কোনো সেতু নেই। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন, উচ্চ আদালতের প্রতিটি নির্দেশনায় সেখানে একটি সেতু স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। এখনো সেই সেতু হয়নি।

নদী উদ্ধারে জেলা প্রশাসকদের অবশ্যই শক্ত জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। জেলা প্রশাসক নদী উদ্ধারে অবহেলা করলে তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলেই কেবল নদী বাঁচানো সম্ভব। নয়তো কেবল চাকিরপশার নয়, দেশের কোনো নদী বাঁচানো সম্ভব নয়।

  • তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদীরক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক

  • [email protected]