সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ থমকে ছিল। কিন্তু একবিংশ শতকের সবচেয়ে মারাত্মক মানবিক সংকট শুরুর ১৩ বছর পর সহিংসতার নতুন পর্ব শুরু হয়েছে সেখানে। সিরিয়ার বিদ্রোহী বাহিনী আলেপ্পোতে আবার বড় আকারের আক্রমণ শুরু করে। কয়েক বছরের স্থিরতার পর সিরিয়ার একসময়ের সমৃদ্ধশালী এই বাণিজ্যিক কেন্দ্র আবার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের শাসনের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে হাজির হয়েছে। ইতিমধ্যেই অস্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্যকে করে তুলেছে আরও অস্থিতিশীল ।
কেন আলেপ্পো গুরুত্বপূর্ণ
রাজধানী দামেস্ক থেকে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার উত্তরে আলেপ্পো সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। সংঘাতের আগে আলেপ্পো ছিল সিরিয়ার বৃহত্তম শহরগুলোর একটি। জনসংখ্যা ২৩ লাখ।
২০১২ সালে বিদ্রোহী বাহিনী আলেপ্পোর পূর্ব অংশের অর্ধেক দখল করে আসাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত করে। ২০১৬ সালে অবস্থা বদলায়। রুশ বিমান অভিযানের সহায়তায় সিরিয়ার সরকারি বাহিনী শহরটি আবার দখল করে। আলেপ্পো পুনরুদ্ধার করার মাধ্যমে, রাশিয়া এবং ইরানের সমর্থনে আসাদ গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোর ওপর তাঁর দখলকে দৃঢ় করেন।
এই আক্রমণের পেছনে কারা
এই নতুন আক্রমণের প্রধান বাহিনী হলো হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)। এরা ছিল সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এইচটিএস বছরের পর বছর ধরে নিজেকে নতুনভাবে তৈরি করেছে। জাতিসংঘ এইচটিএসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে চিহ্নিত করে। এর নেতা আবু মোহাম্মদ আল-গোলানি গ্রুপটিকে এর চরমপন্থী শিকড় থেকে দূরে রাখতে চেয়েছেন।
এইচটিএস নিজেকে রূপান্তরের মধ্যে নিয়ে গেছে বলে দাবি করে। তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় তারা বেসামরিক প্রশাসনের সুযোগ দিচ্ছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছে কমিয়ে। তবে চরমপন্থী উপাদানকে আশ্রয় দেওয়ার এবং তার অঞ্চলের মধ্যে জঙ্গি কার্যকলাপ আশকারা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এইচটিএসের সঙ্গে যোগ দিয়েছে তুর্কি-সমর্থিত কয়েকটি দল। এই গোষ্ঠীগুলো আসাদের বিরোধিতা করে আবার প্রায়ই নিজেদের মধ্যেও লড়াই করে।
আক্রমণের উদ্দেশ্য
এক ভিডিও বিবৃতিতে, বিদ্রোহী সামরিক কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসান আবদুল গনি তাঁদের আক্রমণকে প্রতিরক্ষামূলক হিসেবে দাবি করে বলেছেন, ‘এই আক্রমণ না করে উপায় ছিল না। আমাদের জনগণ এবং তাদের ভূমিকে রক্ষা করার জন্য এ ছিল অনিবার্য। এটা সবার কাছে স্পষ্ট যে ইরানের ভাড়াটে সৈন্যসহ শাসক মিলিশিয়া এবং তাদের মিত্ররা সিরিয়ার জনগণের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।’
বিদ্রোহীদের তাৎক্ষণিক লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে বেসামরিক এলাকায় বিমান হামলা বন্ধ করা, এলাকা পুনরুদ্ধার করা এবং সরকারি বাহিনীর রসদ ও অন্যান্য সরবরাহের পথ বন্ধ করা। তাদের অগ্রগতি এখন পর্যন্ত দ্রুত হয়েছে। আলেপ্পো প্রদেশে বেশ কয়েকটি গ্রাম, কৌশলগত হাইওয়ে এবং সামরিক ঘাঁটি তাদের দখলে এখন।
উত্তর-পশ্চিম সিরিয়া প্রায় ৪০ লাখ মানুষের আবাসস্থল। গত যুদ্ধের সময় তাদের অধিকাংশই একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে। আবার সহিংসতার ফলে শুরু হবে ব্যাপক বাস্তুচ্যুতির নতুন স্রোত।
আসাদ সরকারের প্রতিক্রিয়া
সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বিদ্রোহী যোদ্ধাদের ক্ষয়ক্ষতি করেছে বলে দাবি করে সরকারি বাহিনীর তীব্র প্রতিরোধের কথা জানিয়েছে। রাশিয়ার বিমান সহায়তায় সিরিয়ার সামরিক বাহিনী বেশ শক্তিশালী। তারা ইদলিব এবং আতারেব শহরসহ বিরোধীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় তীব্র বিমান হামলা শুরু করেছে। বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে। আসাদের প্রধান মিত্র ইরানও আক্রমণে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। হতাহতদের মধ্যে ইরানের বিপ্লবী গার্ডের একজন সিনিয়র কমান্ডারও রয়েছেন।
আসাদ শিয়া পরিবারের মানুষ। ক্ষমতায় থাকার জন্য ইরানের ওপর তাঁর নির্ভরতা আছে। প্রথমবার বিদ্রোহের মুখোমুখি হওয়ার পর থেকে ইরানের সঙ্গে তাঁর জোট খুব কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। সিরিয়া বিশৃঙ্খলায় পড়ার পর, ইরান আসাদের সেনাবাহিনীকে প্রায় ৮০,০০০ যোদ্ধা সরবরাহ করেছে। রাশিয়া দিয়েছে বিমান সহায়তা।
আঞ্চলিক গতিপ্রকৃতি
এই আক্রমণ এমন একসময়ে হয়েছে, যখন ইরান ও তাদের সমর্থিত হামাস এবং হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের সঙ্গে অন্যত্র সংঘাতে লিপ্ত। লেবাননে হিজবুল্লাহ এবং গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সামরিক অভিযান তাদের সামর্থ্যে চাপ সৃষ্টি করেছে। ইউক্রেনের যুদ্ধে মনোযোগ দেওয়ার ফলে সিরিয়ায় যথেষ্ট শক্তি জোগান দেওয়া রাশিয়ার জন্য সম্ভব হবে না।
সিরিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তুরস্ক। তুরস্ক আক্রমণে জড়িত কিছু বিদ্রোহী দলকে সমর্থন করে। এদিকে আবার ইসরায়েল বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে সিরিয়ার মধ্যে ইরান-সম্পর্কিত লক্ষ্যবস্তুতে। লক্ষ্য হিজবুল্লাহকে দেওয়া অস্ত্রের চালান ব্যাহত করা।
নতুন করে যুদ্ধের ফলে সিরিয়ার, বিশেষ করে বিরোধী-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বেসামরিক নাগরিকদের জীবন বিপর্যস্ত হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি অনুমান করছে যে সম্প্রতি প্রায় ৭,০০০ পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
উত্তর-পশ্চিম সিরিয়া প্রায় ৪০ লাখ মানুষের আবাসস্থল। গত যুদ্ধের সময় তাদের অধিকাংশই একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে। অনেকে খাদ্য, পানীয় ও চিকিৎসাসেবার সীমিত সুযোগের শিবিরগুলোতে বাস করে। আবার সহিংসতা শুরু হওয়ায় এই অবস্থার আরও অবনতি ঘটবে। শুরু হবে ব্যাপক বাস্তুচ্যুতির নতুন স্রোত।
আসাদ সরকারের ওপর কী প্রভাব পড়বে
আসাদ সরকার সিরিয়ার প্রায় ৭০ শতাংশ ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে। তবে এই নিয়ন্ত্রণের বেশির ভাগই রাশিয়া এবং ইরানের মতো মিত্রদের সমর্থনের ওপর নির্ভর করে। ইসলামিক স্টেট অনেকাংশে পরাজিত হলেও এখনো তারা এই অঞ্চলে স্লিপার সেলের মাধ্যমে সক্রিয় আছে। সরকারি নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা আছে। যার সুযোগ নিয়ে এই চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো আবার সংগঠিত হয়ে নিজেদের বিস্তৃতি ঘটানোর চেষ্টা করতেই পারে।
সমীরণ মিশ্র এনডিটিভির জ্যেষ্ঠ উপসম্পাদক
এনডিটিভি থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন