বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রচলিত কুসংস্কার উন্মোচনে প্রয়োজন সাংস্কৃতিক রূপান্তর
বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন প্রায় ১৭ কোটি। এদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত ১৫-৩৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী। কিন্তু দেশে মনোবিজ্ঞানী ও মনোরোগবিশেষজ্ঞের সংখ্যা একদমই অপর্যাপ্ত। দক্ষ ও নির্ভরযোগ্য মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক পেশাজীবীর সংখ্যাও অত্যন্ত অপ্রতুল। পাশাপাশি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য–সহযোগিতা, সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা নির্ধারণে, রেফার করা ও পেশাগত সাহায্যের ক্ষেত্রে কোথায় যেতে হবে, সে–বিষয়ক তথ্য ও সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে।
বিদ্যালয়, উচ্চশিক্ষা, ক্যারিয়ার, পরিবার বা জীবনের সব ক্ষেত্রে সামাজিক ও পারিবারিক প্রত্যাশা পূরণের চাপের কারণে মানসিক ও আবেগগত অবসাদ তৈরি হতে পারে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার আরেকটি কারণ হতে পারে পারিবারিক সহিংসতা। এতে ভুক্তভোগী ও অপরাধী—উভয়েরই মানসিক স্বাস্থ্যসমস্যা হতে পারে। নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণের ফলেও মানসিক স্বাস্থ্যসমস্যা দেখা দিতে পারে। নেশাজাতীয় দ্রব্যের সহজলভ্যতা ও ব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এতে মনোসামাজিক লক্ষণ ও সাইকোসোমাটিক ডিজঅর্ডার বেড়ে যেতে পারে।
যদিও ব্যক্তিগত ঘটনা ও অনুশীলনের কারণে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সমস্যা হয়, তারপরও দেখা যায়, বিভিন্ন বাহ্যিক কারণসমূহ মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশে শরণার্থী–সংকট চলছে। এর কারণে যে কেবল মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে, এমনটা নয়; বরং বাংলাদেশের অনেকেরও এই সমস্যা দেখা দিয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তন ও জলবায়ু-প্রভাবিত মানুষেরা মানসিক ও আবেগজনিত সমস্যায় ভুগছেন। বাংলাদেশ অত্যন্ত জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। এ কারণে আমাদের প্রায়ই স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দেয়। এখানকার অপ্রত্যাশিত জলবায়ু বিপর্যয় ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। সম্প্রতি একজন শিক্ষার্থী স্কুল চলাকালে হিট স্ট্রোকে মারা গেছে, আর তার সহপাঠীরা এই বিষয়টি দেখেছে। এ ঘটনার কারণে এসব শিক্ষার্থী খুবই ভয় পেয়েছে। ঘটনাটি তাদের অবস্থাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। এ ঘটনার পর মনোবিজ্ঞানীরা যখন ওই বিদ্যালয়ে প্রাথমিক মানসিক সহায়তা দিয়েছেন, তাদের কাছে বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দিন দিন বাড়ছে, কিন্তু এর চিকিৎসা খুবই সীমিত। এর সঙ্গে সমস্যা কমিয়ে নিয়ে আসা বা দ্রুত সেবা প্রদানের বিষয়টিও অবহেলিত। তার ওপর মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক নানা কুসংস্কার, মানুষকে সহযোগিতার জন্য খোঁজ করা ও সাহায্য নেওয়ার ইচ্ছাকে আরও সীমাবদ্ধ করে ফেলে। এসব কুসংস্কার ও শ্রুতিকথা (মিথ) আমাদের চিন্তাপ্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করে। মানসিক স্বাস্থ্যকে ঘিরে খারাপ শক্তিতে বিশ্বাস, ধর্মীয় ব্যাখ্যা নিয়ে ভুল-বোঝাবুঝি বা পুরোনো রীতিনীতি অনুশীলনের মতো নানা ধরনের কুসংস্কার রয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যসমস্যার কারণ খুঁজতে গিয়ে আমরা এসব কুসংস্কারের প্রভাব দেখতে পাই।
আমাদের এখানে নেতিবাচক ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে ডিপ্রেশন (বিষণ্ণতা) আসলে নিজের তৈরি করা সমস্যা, এড়িয়ে চলার মাধ্যমে এ থেকে মুক্ত থাকা যায়। অর্থপূর্ণ কাজে যথেষ্ট ব্যস্ত না থাকার কারণে ডিপ্রেশন হয় বলেও অনেকে মনে করেন। কিন্তু এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কিছু মানসিক সমস্যা, যেমন বাইপোলার ডিজঅর্ডার বা সিজোফ্রেনিয়ার ক্ষেত্রে মনে করা হয় অতিপ্রাকৃত শক্তি বা খারাপ আত্মার প্রভাবে এসব রোগ হয়।
এ সময় চিকিৎসা বা নিরাময়ের ক্ষেত্রে ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক বা আঞ্চলিক রীতিনীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা করা হয়। আঞ্চলিক রীতিনীতি অনুযায়ী চিকিৎসার ফল কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইতিবাচক হলেও বেশির ভাগ সময়ই দেখা যায়, তা আরও বেশি ক্ষতির কারণ হয়। কখনো তা ট্রমা বা ডিজঅর্ডারের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এসব ক্ষেত্রে অজ্ঞানতা ও কুসংস্কার এতটাই অন্তর্নিহিত অবস্থায় থাকে যে অসুস্থতার শারীরিক ও মানসিক কারণগুলো উপেক্ষা করা হয়।
আমরা দেখেছি যে আত্মহত্যার মতো ঘটনাকে মানসিক স্বাস্থ্যগত অবস্থা হিসেবে চিহ্নিত না করে দুর্ঘটনা হিসেবে দেখা হয়। যদিও আমাদের সমাজে আত্মহত্যার কথা চিন্তা করা বা আত্মহত্যা চেষ্টার মতো ঘটনা ঘটছে। ধারণা করা হয়, খবরে আসা ঘটনাগুলোর চেয়ে এসব চিন্তা বা চেষ্টার সংখ্যা ১০-২০ গুণ বেশি হতে পারে।
সুতরাং আমরা এখানে পরিষ্কার বুঝতে পারছি, আত্মহত্যা কোনো দুর্ঘটনা নয়; বরং মানসিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ার চূড়ান্ত মুহূর্ত। আর তাই, মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থাকে বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে আমাদের কুসংস্কার ও শ্রুতিকথার ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সচেতনতা ও বোঝাপড়া তৈরি করতে হবে এবং বিশেষজ্ঞ পেশাজীবীদের সহযোগিতা গ্রহণ করতে হবে।
তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা এর গুরুত্ব স্বীকার করে নিচ্ছে, জানাশোনার পরিধি বাড়াচ্ছে এবং কীভাবে সেবা পাওয়া যায়, সে ধারণা রাখছে। সিলেটের সরকারি কলেজের এক শিক্ষার্থী স্পষ্টভাবে বলেন, ‘আমরা ভালো থাকার চেয়ে ভালো থাকার অভিনয় করি বেশি।’ এ থেকেই বোঝা যায়, আসলে তাদের ভেতর কতটুকু বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে আর বাইরে তারা নিজেদের কতটুকু প্রকাশ করতে পারছে। তারা বিষণ্ণতা বা উদ্বিগ্নতা শনাক্ত করতে সক্ষম এবং সেশন নেওয়ার জন্য দক্ষ মানসিক সেবা প্রদানকারীর কাছে যেতে চান।
যা–ই হোক, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তাঁরা জানেন না কোথায় যেতে হবে বা প্রাথমিক সেবার ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞকে কীভাবে খুঁজে পেতে হবে। ফল হিসেবে, তাঁদের না–বলা অনুভূতি আর চিন্তার ভার দিনের পর দিন বাড়তে থাকে। আমরা এমন একটি সংস্কৃতিতে বাস করি, যেখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে উপেক্ষা করা হয় এবং মানসিক ও আবেগগত স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা আরও বেশি। প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে এই অবহেলা প্রায়ই বহুগুণ বেড়ে গিয়ে আরও বড় কোনো মানসিক স্বাস্থ্যসমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা বা কখনো কখনো আজীবন চিকিৎসার দ্বারস্থ হতে হয়।
সুস্বাস্থ্য ও সুস্থতার জন্য ভালো মানসিক স্বাস্থ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক স্বাস্থ্য মানবাধিকারের আওতায় পড়ে এবং মানসিক স্বাস্থ্যগত অবস্থা কখনোই সমাজে বা কর্মক্ষেত্রে বঞ্চিত হওয়ার কারণ হওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশ মানসিক স্বাস্থ্য আইন ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কৌশলগত পরিকল্পনা পাস করেছে। বিভিন্ন খাতের আলোচনায় মানসিক স্বাস্থ্য অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এর পরিধি আগের চেয়ে কিছুটা হলেও বেড়েছে। এ রকম প্রশংসনীয় উদ্যোগ সামনে আরও বেশি হওয়া দরকার।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব নিয়ে আসতে চাইলে আমাদের সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে, এমন মানুষের প্রতি আমাদের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে। আর যেখানে আমরা থাকি ও প্রতিদিন যোগাযোগ করি অর্থাৎ ঘর থেকেই এই উদ্যোগ নেওয়া শুরু করতে হবে। যখন আমরা মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে প্রচলিত কুসংস্কার ও শ্রুতিকথার ধোঁয়াশা কাটিয়ে উঠে সামনের দিকে এগিয়ে যাব, তখনই আমরা মানসিক স্বাস্থ্যের মতো মানবাধিকার আমাদের নাগরিকদের জন্য নিশ্চিত করতে পারব।
তাবাস্সুম আমিনা, পিএইচডি, সহকারী অধ্যাপক এবং লিড অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড সাইকোসোশ্যাল সাপোর্ট টিম, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি