আওয়ামী লীগের উকিল মডেল: সাপ মারা ও লাঠি না ভাঙার কৌশল

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল অন্নদা সরকারি উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটারের অপেক্ষায় ছিলেন নির্বাচনী কর্মকর্তারা
ছবি : তানভীর আহাম্মেদ

ছয়টি আসনের উপনির্বাচন থেকে আগামী জাতীয় নির্বাচনের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা পাওয়া গেল। ছয়টি আসনের নানাবিধ ঘটনা বিচ্ছিন্নভাবে বিবেচনার সুযোগ কম। শক্তি প্রয়োগ, হুমকি, কেন্দ্র দখল, কেন্দ্রের গোপন কক্ষে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির উপস্থিতি, প্রার্থী নিখোঁজ হয়ে যাওয়া, গুম হওয়া, বিএনপির দলত্যাগী প্রার্থী উকিল আবদুস সাত্তারের পক্ষে আদাজল খেয়ে আওয়ামী লীগের মাঠে নামা, এ ধরনের নানা ঘটনার ভেতর দিয়ে নগণ্য সংখ্যক ভোটারের উপস্থিতিতে ভোট সম্পন্ন হয়েছে। এ নির্বাচনে বহুমাত্রিক ইঙ্গিত রয়েছে। বিশেষ করে অন্যতম প্রধান দল বিএনপির জন্য এ নির্বাচন খুবই বার্তাবাহী।

উপনির্বাচন আবারও স্মরণ করিয়ে দিল, দেশে নির্বাচনব্যবস্থা বলতে এখন আর তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই। সরকারের ইচ্ছা অনুয়ায়ী এবং নির্বাচন কমিশনের সম্মতিতে ও নীরবতায় চলছে ভোটের নামে প্রহসন। এ প্রক্রিয়ায় যেহেতু জনসাধারণের ভোটের প্রয়োজন নেই, তাই ভোটাররাও এ ধরনের ভোট প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করেছে। যে কারণে উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই কম। এমনকি কোথাও কোথাও মাইকিং করেও জনসাধারণকে ভোটকেন্দ্রে আনা যায়নি।

আরও পড়ুন

জনসাধারণ ভোটকেন্দ্রে না এলেও সরকারি দল ভোটের নামে নিজেদের বিজয়ী করার একটি নিজস্ব কায়দা তৈরি করতে সক্ষম করেছে। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন থেকে সব ধরনের স্থানীয় সরকার নির্বাচনেই একই কায়দা অবলম্বন করেছে আওয়ামী লীগ। এটা হচ্ছে গোপনীয়তার পরিবর্তে প্রকাশ্য ভোট। কৌশলটি হচ্ছে পুলিশ, নির্বাচনী কর্মকর্তা বা আওয়ামী লীগের কাউকে সাক্ষী রেখে কেবল মাত্র আওয়ামী লীগকেই ভোট দিতে হয়। অন্যথায় ভোটকেন্দ্রে আসার প্রয়োজন নেই। পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের প্রকাশ্য ভোটের ব্যবস্থা নেই। আওয়ামী লীগ এ ধরনের অভিনব ও বিরল কৌশলের সঙ্গে এবার উদ্ভাবন করেছে উকিল সাত্তার মডেল। অন্য দল থেকে নেতা-কর্মীদের ভাগিয়ে এনে স্বতন্ত্র হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়া। এবং সর্বতোভাবে বিজয়ী করার জন্য কৌশল অবলম্বন করা। এটা অনেকটা সাপ মারা ও লাঠি না ভাঙার কৌশলের মতো। বিএনপির ঘর ভাঙল। আবার কেউ দোষারোপ করতে পারবে না আওয়ামী লীগ ঘর ভেঙেছে বা জোর করে জিতেছে। এ নতুন মডেল সামনের নির্বাচনে বিএনপির জন্য মাথাব্যথার কারণ হতে পারে। বিএনপিকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

আরও পড়ুন

উকিল আবদুস সাত্তার ছাড়াও সংসদ থেকে পদত্যাগী আরও দু-একজনের প্রতি প্রলোভন ও চাপ ছিল ধারণা করা যায়। তবে অন্যরা শেষ পর্যন্ত উকিল আবদুস সাত্তারের পথে হাঁটেননি। আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন অনিশ্চিত হওয়ায় উকিল আবদুস সাত্তার প্রলোভন বা চাপের মুখে নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। তিনি প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বিএনপির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। পাঁচবার সংসদ সদস্য পদে বিএনপি থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। মন্ত্রিত্বের দায়িত্বও পালন করেছেন। হতে পারে কোনো কারণে তিনি দলের ভেতরে অবহেলিত ও কোণঠাসা মনে করেছেন।  

উকিল আবদুস সাত্তার হয়তো আরও একবার সংসদ সদস্য হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে পারবেন। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তিনি একজন দলত্যাগী হিসেবেই বিবেচিত হবেন। তাঁর দীর্ঘদিনের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের ইতি ঘটেছে এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। ইতি ঘটল এই কারণে বলা যে সম্ভবত তিনি আর ভবিষ্যতে নির্বাচন করতে পারবেন না। যদি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়, তবে তিনি আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কোনো দল থেকেই তার মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। আবার ২০১৮ সালের মতো আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও কোনো দল থেকে তাঁর মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তিনি বিএনপির চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেননি। আবার বর্তমানে নির্বাচন নামের গণবিরোধী অবস্থানের বাইরেও তিনি যেতে পারলেন না।

তবে বিএনপির জন্য সংকটের জায়গাটা হচ্ছে আওয়ামী লীগ যদি শেষ পর্যন্ত আগামী নির্বাচন নিজেদের অধীনে সম্পন্ন করতে সবকিছু চূড়ান্ত করে ফেলে, তবে উকিল আবদুস সাত্তারের মতো দলত্যাগ করে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে যোগ দেওয়ার মিছিলে আরও অনেকেই যোগ দিতে পারেন। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও দলটির অনেকেই দলত্যাগ করে উকিল সাত্তারের মতো নির্বাচনমুখী হতে পারেন। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। সরকারের পক্ষ থেকে নানা ধরনের চাপ, জেল, গুম, জুলুমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, অলীক মনোনয়ন নিয়ে মারামারি। আগামী নির্বাচনে বিএনপি আদৌ যাবে কি না বা বিএনপির দাবিমতো নির্বাচন হবে কি না, তা নিষ্পন্ন হয়নি। অথচ বিএনপির নেতা-কর্মীরা মনোনয়ন নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছেন এখনই।

নির্বাচনের এক বছর বাকি আছে। এর আগেই বিএনপিকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া নির্বাচনে উকিল সাত্তার মডেল প্রয়োগের কারণে বিএনপি আগাম সতর্ক হওয়ার সুযোগ পাবে। এ সুযোগকে মোক্ষম অস্ত্রে পরিণত করে এককাট্টা হয়ে দাবি আদায়ে নিয়োজিত হতে হবে।

উকিল আবদুস সাত্তারের দলত্যাগ মনোনয়নকেন্দ্রিক কোন্দলের কুফল। চরম কোন্দলের কারণে অনেকেই উকিল আবদুস সাত্তারের পথ অনুসরণ করতে পারেন। এ শঙ্কা দিন দিন শক্তভাবেই দানা বাঁধছে। কারণ, ১০ ডিসেম্বরের পর আওয়ামী লীগ ও এর সমর্থকেরা এখন বেশ জোরেশোরে প্রচারণা করছে, নিজেদের অধীনেই তারা নির্বাচন করতে সমর্থ হবে। বিএনপি ও অন্যদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি কোনোভাবেই মানা হবে না। চাপের মুখে পল্টনে বিএনপির সমাবেশ করতে না পারা ও সমাবেশস্থল সরিয়ে নেওয়ার কারণে আওয়ামী লীগ এ ধরনের প্রচারণার সুযোগ পেয়েছে। ফলে বিএনপি নির্বাচনে না গেলেও দলটির অনেকেই সংসদ সদস্য হওয়ার লোভ সামলাতে পারবেন বলে মনে হয় না। তাঁদের অতীত ইতিহাস এমন সাক্ষ্যই দেয়। এই দলের নেতারা নিজেদের নেত্রী খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে সুবোধ বালকের মতো চার বছরের বেশি সময় সংসদেই বসে ছিলেন।

কার্যত বিএনপিকে সরকারি দলের চাপের পাশাপাশি উকিল আবদুস সাত্তার মডেলকেও মোকাবিলা করতে হবে। দলের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস, কোন্দল ও দ্বন্দ্ব নিয়ে বেশি দূর এগোনো মুশকিল। বরং অনেকেই উকিল আবদুস সাত্তার হওয়ার চেষ্টা করতে পারে। নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা ও কোন্দল ভিন্ন জিনিস। কোন্দলকে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা বলে বিএনপি আড়াল করার চেষ্টা করছে। কমিটি গঠনে দীর্ঘসূত্রতা ও পদ বিক্রি বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের অন্যতম কারণ। কোন্দল ও দ্বন্দ্বকে আড়াল না করে যেকোনো মূল্যে এর নির্মূল করতে হবে।

নির্বাচনের এক বছর বাকি আছে। এর আগেই বিএনপিকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া নির্বাচনে উকিল সাত্তার মডেল প্রয়োগের কারণে বিএনপি আগাম সতর্ক হওয়ার সুযোগ পাবে। এ সুযোগকে মোক্ষম অস্ত্রে পরিণত করে এককাট্টা হয়ে দাবি আদায়ে নিয়োজিত হতে হবে। বাইরের কোনো শক্তি কাউকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে যাবে না। বিশ্বরাজনীতির অগ্রাধিকারের পরিবর্তন হয়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সময় অনেক দেশেই নিজস্ব লোকদের ক্ষমতায় বসিয়েছিল পশ্চিমারা। ইরাক, লিবিয়া এর বড় উদাহরণ। এখন আর সেই অবস্থা নেই। বরং নিজস্ব শক্তি, সামর্থ্য প্রমাণ করতে পারলে পশ্চিমারাই সহযোগিতা, শান্তির কথা বলে সন্ধি স্থাপন করবে।

বিএনপির বিশাল সমর্থক গোষ্ঠী আছে। কিন্তু এই জনসমর্থন নিয়েও দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, কোন্দল, বিশ্বাসহীনতার স্থবির নিশ্চল মহাসাগর হয়ে কোনো লাভ নেই। যে সাগরে ঢেউ ওঠে না, স্রোত নেই, সেই সাগর শেওলা জমে মজা পুকুরে পরিণত হয় একসময়। ঢেউহীন সাগর অপেক্ষা খরস্রোতা ক্ষীণকায় পাহাড়ি নদীও অনেক সময় কার্যকর হয়। এই নদীতে তেজ থাকে। বিএনপিকেই ঠিক করতে হবে বিশাল জনসমর্থন নিয়ে নিশ্চল সাগর হয়ে স্থবিরতায় ভুগবে, না খরস্রোতা নদীর মতো বয়ে যাওয়া কৌশল নেবে।

  • ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক