শহর ও গ্রামে যক্ষ্মা এখনো একটি বড় জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সমস্যা। এ ব্যাকটেরিয়াবাহিত রোগ কিন্তু কার্যকর এবং নিয়মিত চিকিৎসার কারণে প্রতিরোধ ও নিরাময়যোগ্য। কিন্তু এখনো যক্ষ্মা বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের মৃত্যুর বড় একটা কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে বাংলাদেশে প্রায় ৩ লাখ ৭৯ হাজার মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছেন, যার মধ্যে ৪২ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, দেশের প্রায় ৩১ শতাংশ যক্ষ্মা রোগী এখনো শনাক্তের বাইরে রয়ে গেছেন।
এর মধ্যে বড় একটা অংশ শিশু-কিশোর ও তরুণ। এ রোগ শনাক্ত না করার কারণে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ও মানুষের জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে। অনেকে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হলেও তাঁদের সঠিকভাবে শনাক্ত করা যাচ্ছে না। যার ফলে তাঁরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ ধরনের একটি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই আমাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ও সহযোগী সংস্থা যক্ষ্মা চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণে দৃঢ়ভাবে কাজ করছে। তারপরও সবাইকে চিকিৎসার আওতায় আনা যাচ্ছে না। যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ ও রোগী শনাক্ত করতে বেসরকারি অংশীদারত্বের মাধ্যমে সমন্বিত প্রচেষ্টা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
সচেতনতার অংশ হিসেবে যক্ষ্মাবিরোধী আন্দোলনে তরুণদের সম্পৃক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে তাঁদের এই সামাজিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে হবে
বাংলাদেশে যক্ষ্মার বিনা মূল্যে চিকিৎসা প্রদান করা হলেও এখনো অনেক মানুষ এ বিষয়ে সচেতন নন। অনেক যক্ষ্মা রোগী শনাক্তের বাইরে থেকে যান। আবার অনেকে রোগ গুরুতর আকার ধারণ করার পরেই চিকিৎসা গ্রহণ করেন। এই অসচেতনতা কাটিয়ে উঠতে সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজন। সরকারের পাশাপাশি যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে বেসরকারি খাতের সক্রিয় ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ, এ খাতটি সমাজের একটি বড় অংশের কাছে পৌঁছানোর ক্ষমতা রাখে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে বেসরকারি খাতের কার্যক্রম দিন দিন বাড়ছে এবং তারা যক্ষ্মা রোগ প্রতিরোধে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যক্ষ্মার মতো এমন সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে বেসরকারি খাতের সঠিক ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করবে।
বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে যুক্ত চিকিৎসকদের একটি বড় অংশ রয়েছে, যাঁরা প্রতিদিন অসংখ্য রোগীকে চিকিৎসা প্রদান করেন। যক্ষ্মা রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে তাঁদের সম্পৃক্ততা এখনো পর্যাপ্ত নয়। অনেক বেসরকারি চিকিৎসক তাঁদের ক্লিনিকে বা চেম্বারে যক্ষ্মা রোগীদের শনাক্ত করলেও তাঁরা জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিকে অবহিত করার সুযোগ পাচ্ছেন না।
চিকিৎসকেরা ‘জানাও’ অ্যাপের মাধ্যমে যক্ষ্মা রোগীর নোটিফিকেশন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারেন। বেসরকারি চিকিৎসকদের যক্ষ্মা রোগীদের শনাক্ত করে যথাযথভাবে অবহিত করার জন্য প্রশিক্ষণ দিতে হবে ও তাঁদের এ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে উৎসাহিত করতে হবে। এ উদ্যোগে সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সমন্বয় করা গুরুত্বপূর্ণ।
বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল এখন বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যারা দেশের বিশাল একটি অংশের নাগরিকদের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে। এই হাসপাতালগুলোর যক্ষ্মা রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় সক্রিয় অংশগ্রহণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে উচ্চমানের যক্ষ্মা পরীক্ষার সুবিধা বেশি করে চালু করা উচিত। এ ধরনের সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে রোগ শনাক্তের হার বাড়বে এবং দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত করে রোগীদের সঠিক তথ্য প্রদান ও তাঁদের রিপোর্টিং সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
এ ছাড়া বেসরকারি সংস্থা (এনজিও), বিভিন্ন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান, সামাজিক প্রতিষ্ঠান (স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন), ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, গণমাধ্যমসহ সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যক্ষ্মা সচেতনতা ও প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার (সিএসআর) অংশ হিসেবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সিএসআর কার্যক্রমের মধ্যে যক্ষ্মা রোগের সচেতনতা বৃদ্ধি, রোগনির্ণয় এবং চিকিৎসাসেবা প্রদানকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মী ও গ্রাহকদের জন্য যক্ষ্মা পরীক্ষা ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালু করতে পারে। এ ছাড়া তারা জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং অন্যান্য প্রচারমাধ্যম ব্যবহার করতে পারে। এ ধরনের কার্যক্রম সমাজের সব স্তরের মানুষের কাছে যক্ষ্মার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে সহায়ক হবে। আইসিডিডিআরবি পরিচালিত ইউএসএআইডি ‘অ্যালায়েন্স ফর কমব্যাটিং টিবি ইন বাংলাদেশ (এসিটিবি)’ সচেতনতা বিকাশে কাজ করছে।
যক্ষ্মার মতো রোগের বিরুদ্ধে সর্বক্ষেত্রে সামাজিক আন্দোলন দরকার। বিশ্বের যে ৩০টি দেশে যক্ষ্মা রোগী বেশি, বাংলাদেশ তার মধ্যে রয়েছে। ঝুঁকি থাকলেও শহর ও গ্রামে রোগনির্ণয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা যাচ্ছে না। আমাদের দেশে এখনো অনেক মানুষ জানেন না যে সরকার যক্ষ্মার চিকিৎসা বিনা মূল্যে দিচ্ছে। এ জন্য সরকারের উচিত বেসরকারি খাতের সক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করা। এর মধ্যে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোকে যক্ষ্মা নির্ণয় এবং চিকিৎসাসেবায় সম্পৃক্ত করতে বিভিন্ন সহায়তা প্রদান করা যেতে পারে। এ ছাড়া সরকারি নিয়মনীতি ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বেসরকারি খাতকে আরও দক্ষ ও কার্যকরী করে তুলতে হবে। যক্ষ্মার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সরকার ও বেসরকারি খাতের মধ্যে একটি মজবুত অংশীদারত্ব গড়ে তোলা জরুরি। এ অংশীদারত্বের মাধ্যমে আমরা সমাজের প্রত্যন্ত অঞ্চল যেমন চরাঞ্চল, পাহাড়ি দুর্গম এলাকার মতো জায়গায় যক্ষ্মা প্রতিরোধ ও চিকিৎসাসেবা পৌঁছাতে পারব। এতে যক্ষ্মা রোগটি বাংলাদেশ থেকে নির্মূল করা সম্ভব হবে।
সচেতনতার অংশ হিসেবে যক্ষ্মাবিরোধী আন্দোলনে তরুণদের সম্পৃক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে তাঁদের এই সামাজিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে হবে। এ ছাড়া গণমাধ্যম যক্ষ্মার বিরুদ্ধে সামাজিক যুদ্ধে অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হতে পারে। সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দ্বারা যক্ষ্মার বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়ানো সম্ভব। যক্ষ্মাবিষয়ক অনেক স্টিগমা ও কুসংস্কার চালু আছে। এ ক্ষেত্রে সঠিক তথ্য প্রদান ও সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতার গণমাধ্যমে আরও সচেতনতা বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ প্রয়োজন।
যক্ষ্মা একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা যা শুধু সরকার বা স্বাস্থ্যকর্মীদের দ্বারা সমাধান করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা যেখানে সরকার, বেসরকারি খাত, তরুণ প্রজন্ম এবং সাধারণ মানুষ একসঙ্গে কাজ করবে। সঠিক উদ্যোগ ও সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হব এবং বাংলাদেশকে যক্ষ্মামুক্ত একটি দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারব।
ডা. সায়েরা বানু সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ও হেড, প্রোগ্রাম অন ইমার্জিং ইনফেকশনস, আইডিডি, আইসিডিডিআরবি ও কোর গ্রুপ মেম্বার, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনস পিপিএম ওয়ার্কিং গ্রুপ।