পাকিস্তানকে যেমন দেখে এলাম

১০ দিন পাকিস্তান সফরে এই নবীনদের কথাই ছিল বড় পাওয়া।ফাইল ছবি : এএফপি

দ্বিতীয় পর্ব
দশ দিনে একটি দেশের রাজনীতি নিয়ে আমার পর্যালোচনা বা পর্যবেক্ষণের ভিত্তি পাকিস্তানের বেশ কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা আর আলাপ। তাঁরা পাকিস্তানের উচ্চ পদের আমলা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আর কিছু ব্যবসায়ী। সঙ্গে আছে কিছু টেলিভিশন আলোচনা। এসব আলোচনা থেকে যা পেয়েছি, তা হলো রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ইমরান খান এখনো খুব জনপ্রিয়। সে কারণে তাঁকে সেনাবাহিনী আর অন্যান্য দলের নেতারাও ভয় পান।

জনপ্রিয়তার কারণে তাঁকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর মতো হুট করে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই তাঁর বিরুদ্ধে এত মামলা, তাঁর দলের সঙ্গে এই বোঝাপড়ার চেষ্টা।

আরেকটি ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ হলাম যে পাকিস্তানের রাজনীতিবিদেরা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেবেন না। এটা আমাকে বোঝালেন একজন রাজনীতিবিদ, যিনি একদা পাকিস্তানে বৈদেশিক মন্ত্রী ছিলেন। আমি তাঁকে সোজাসুজি প্রশ্ন করেছিলাম যে পাকিস্তানে রাজনীতিবিদেরা সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ কেন বন্ধ করতে পারেন না।

তিনি উত্তরে বলেছিলেন যে পাকিস্তানের জন্য একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনীর প্রয়োজন। দেশকে একটি বৈরী প্রতিবেশীর হাত থেকে বাঁচাতে শক্তিশালী সেনাবাহিনী দরকার। এই যদি কারণ হয়, তা হলে পাকিস্তানের রাজনীতিতে অদূর ভবিষ্যতে সেনাবাহিনীর প্রভাব কমার কোনো সম্ভাবনা নেই।

আরও পড়ুন

এবার অর্থনীতি নিয়ে কিছু নিরীক্ষণ তুলে ধরি। পাকিস্তানের অর্থনীতির নাজুক পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশি পত্রিকায় বেশ আলোচনা পড়েছি গত দুই-তিন বছরে। পাকিস্তানের বৈদেশিক বাণিজ্য ক্রমাগত কমতে থাকায় পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে পড়ে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সহায়তায় আর কিছুটা সৌদি সরকারের আর্থিক সাহায্যে রিজার্ভের অবস্থা একটু ভালো। তবু দুই বছর ধরে মার্কিন এক ডলার পাকিস্তানি রুপিতে ২৮০ বা তার কাছাকাছি। বাংলাদেশে ডলারের মূল্য ১২২-১২৪ টাকা।

ভেবেছিলাম যে বৈদেশিক মুদ্রার মূল্যস্ফীতির প্রভাব আমি পাকিস্তানের অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ করব। কিন্তু তেমন দেখলাম না। অর্থাৎ পাকিস্তানি নিজস্ব রুপি, যা দিয়ে দেশের মানুষ দৈনন্দিন লেনদেন করে, তার বিশেষ কোনো অবমূল্যায়ন হয়নি। অর্থাৎ বাজারে দ্রব্যমূল্য এমন কোনো আকাশছোঁয়া হয়নি যে সাধারণ মানুষ খেতে পাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক হিসাবে জীবনযাত্রার খরচ পাকিস্তানে এক ব্যক্তির জন্য বছরে গড়ে ৩৮১ ডলার।

একজন দরিদ্র ব্যক্তি ডলারের হিসাবে ৩০ সেন্ট দিয়ে দুটি রুটি আর এক বাটি ডাল কিনে খেতে পারেন। কিন্তু তাই বলে সবার আয় গড়পড়তা নয়, তাই রাস্তায় ভিক্ষুক একেবারে যে নেই, তা–ও নয়। দেশে বেকারত্বের হার শতকরা প্রায় ১০। বিদেশি  জিনিসের দাম একটু বেশি। তবে পাকিস্তানে তৈরি পোশাক এবং অন্যান্য ব্যবহার্য সামগ্রীর মান খুবই উন্নত। কাজেই বিদেশি পণ্য যাঁরা কিনতে পারেন না, তাঁরা এমন কিছু হারাচ্ছেন না।

আমার ১০ দিন পাকিস্তান সফরে এই নবীনদের কথাই ছিল বড় পাওয়া। আজ আমরা বাংলাদেশে এক সন্ধিক্ষণে।  আমাদের অতীত একাধারে আমাদের ঐতিহ্য ও ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক। আমাদের পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণ শুধু অথনৈতিক ও রাজনৈতিক বঞ্চনা ছিল না। ছিল একটি বড় প্রতারণা। আজ মুক্তিযুদ্ধের ৫৫ বছর পরও আমাদের সে প্রতারণাকে ভুলতে পারব না।

এবার আসি যোগাযোগব্যবস্থার কথায়। পাকিস্তানের সড়ক এবং রেল যোগাযোগ বহু আগে থেকেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে উন্নত ছিল। গত ৫০ বছরে যোগাযোগব্যবস্থা, বিশেষ করে সড়ক যোগাযোগ আরও উন্নত হয়েছে।   পাকিস্তানের জন্ম থেকে (১৯৪৭) এই ৭৮ বছরে পাকিস্তানে সড়কপথের দৈর্ঘ্য বেড়েছে ১০ গুণ। গত ২০-২৫ বছরে দেশে যুক্ত হয়েছে নতুন মোটর ওয়ে এবং মহাসড়ক এক ডজনের ওপর।

আমি দুটি মোটর ওয়ে ব্যবহার করতে পেরেছি, যা ছিল লাহোর-ইসলামাবাদ আর ইসলামাবাদ-পেশোয়ার। রাস্তাগুলো প্রশস্ত ও খুবই উন্নত মানের। রাস্তায় টোল তোলা হয় স্বয়ংক্রিয় গেটের মাধ্যমে। পথে স্থানে স্থানে বিশ্রামের জায়গা, যেখানে অত্যাধুনিক খাওয়া ও বিশ্রামের স্থান আছে। গতিনিয়ন্ত্রণ তদারকির জন্য হাইওয়ে পেট্রল আছে। চারবার হাইওয়ে ব্যবহারে আমি রাস্তায় কোনো বিশৃঙ্খলা বা দুর্ঘটনার কারণে সড়ক বন্ধ পাইনি। এবার রেলের অভিজ্ঞতা আমার হয়নি।

এবার কিছু শহর ঘুরে বেড়ানো আর সামাজিক চালচলনের কথায় আসা যাক। আমি লাহোর এলাম ৩২ বছর পর।  ১৯৯২–এর লাহোরের সঙ্গে অনেক পার্থক্য দেখলাম। লাহোর শহর কলেবরে বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক। তবে তা পুরোনো লাহোর শহর ছাড়িয়ে। আর ঐতিহাসিক মোগল আমলের প্রাচীরবেষ্টিত শহর, যা ১২টি দরজার নাম বিখ্যাত, তাকে আবার পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। সেখানে কোনো বাণিজ্যিক যানবাহন চলাচল করতে পারে না।

এই সংরক্ষিত এলাকায় শুধু বংশপরম্পরায় থাকা বাসিন্দারা থাকতে পারেন। লাহোর শহরের নতুন বা বর্ধিত অঞ্চল, যা ডিফেন্স হাউজিং অথরিটির অধীন; তার বর্তমান আয়তন প্রায় ১০ হাজার একর।

বিভিন্ন অংশে বিভক্ত এ অঞ্চল অত্যন্ত আধুনিক পরিকল্পনায় তৈরি। এখানে বাসস্থানের ঘরসহ বাণিজ্যিক এলাকা ও বিনোদনের জন্য পার্কও আছে। এ ধরনের অঞ্চল পাকিস্তানের বিভিন্ন বড় শহরে স্থাপিত হয়েছে। এর দায়িত্ব পেয়েছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কল্যাণ সংস্থা। তারা এ অঞ্চলগুলো পরিচালনা করে ডিফেন্স হাউজিং অথরিটি নামে। ডিফেন্স হাউজিং অথরিটির দুটি জায়গায় গিয়েছিলাম। কোনো কোনো বাড়ি আর বাণিজ্যিক এলাকা দেখে মনে হচ্ছিল আমি পশ্চিমা কোনো দেশে আছি।
আরেকটি ব্যাপার চোখে পড়েছে, লাহোর ও ইসলামাবাদে মেয়েদের স্বচ্ছন্দে চলাফেরা।

পাকিস্তানকে একটি ধর্মান্ধ রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াসে আমি প্রায়ই মেয়েদের পোশাক বা চলাফেরার স্বাধীনতা হ্রাসের কথা শুনতাম। শুধু এ দুটি শহর কেন, পাঞ্জাবের গ্রামাঞ্চলেও মেয়েদেরও স্বচ্ছন্দে চলাচল করতে দেখেছি। মেয়েরা চলাফেরা করে তাদের গতানুগতিক পোশাক অর্থাৎ সালোয়ার-কুর্তা আর দোপাট্টা নিয়ে। হাটে–বাজারে বা রাস্তায় তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে আর দশটা দেশের মতো। এর ব্যতিক্রম অবশ্য পেশোয়ারে। পাখতুন মেয়েরা ঐতিহ্যগতভাবে বাইরে বাজারে আসে না।

আমার ১০ দিনের ব্যক্তিগত পাকিস্তান সফর পাকিস্তানের ওপর কোনো গভীর বিশ্লেষণ দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। সমবয়সী বা সে সময়ের সম্পর্কে অবহিত লোকদের বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনায় ছিল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি আর রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। তাঁরা সবাই বোঝেন যে এখন বাংলাদেশ আর পাকিস্তান দুটি পৃথক দেশ। দেশ দুটির মধ্যে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সহযোগিতা তাঁরা কামনা করেন।

বাংলাদেশ নিয়ে বেশি আগ্রহ দেখায় তরুণ প্রজন্ম। তারা বাংলাদেশের নাম শুধু শুনেছে। এর সৃষ্টির পেছনে রক্তাক্ত ইতিহাস সম্পর্কে জানে না। তারা জানে, এককালে বাংলাদেশ পাকিস্তানের একটি অংশ ছিল। ‘ভারত–পাকিস্তান’ যুদ্ধের পর বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়। কেন এ যুদ্ধ হলো আর বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে কী রক্তাক্ত ঘটনা ঘটেছে, কেন ঘটেছে, এ নিয়ে তারা সম্যক কিছু জানে না। যে তরুণদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, তারা আমার সতীর্থ তাসনীম নূরানীর একক চেষ্টায় পাঞ্জাবের ফয়সালাবাদে প্রতিষ্ঠিত বোর্ডিং স্কুলের ছাত্র। স্কুলটি সুবিধাবঞ্চিত ছেলেদের জন্য স্থাপিত, যা চলে মানুষের অনুদানে।

আমরা যখন এই কিশোরদের সঙ্গে পরিচিত হই, বেশ কয়েকজন ১৪-১৫ বছর বয়সী কিশোর আমরা বাংলাদেশি জেনে বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে কৌতূহল প্রকাশ করে। তারা শুধু জানে বাংলাদেশের শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। তিনি কী কারণে মারা যান, তারা তা–ও জানতে চায়। আমি কিছু সময় ব্যয় করে তাদেরকে বাংলাদেশের ইতিহাস এবং কেন এই স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রয়োজন হয়ে পড়ে তাদেরকে বলার চেষ্টা করি। তাদের একজন ইতিহাস শোনার পর বলে ওঠে, ‘এটা তো ভারী অন্যায় হয়েছিল শেখ মুজিবের সঙ্গে। নিয়মমাফিক তাকেই তো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা।’ তারপর সে সরলভাবেই বলে, ‘তা হলে তো আর কোনো যুদ্ধ হতো না।’

আমার ১০ দিন পাকিস্তান সফরে এই নবীনদের কথাই ছিল বড় পাওয়া। আজ আমরা বাংলাদেশে এক সন্ধিক্ষণে।  আমাদের অতীত একাধারে আমাদের ঐতিহ্য ও ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক। আমাদের পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণ শুধু অথনৈতিক ও রাজনৈতিক বঞ্চনা ছিল না। ছিল একটি বড় প্রতারণা। আজ মুক্তিযুদ্ধের ৫৫ বছর পরও আমাদের সে প্রতারণাকে ভুলতে পারব না।

জিয়াউদ্দিন চৌধুরী সিভিল সার্ভিসের সাবেক কর্মকর্তা