প্রাথমিক শিক্ষার জন্য পঞ্চম দফা উন্নয়ন কার্যসূচি (পিইডিপি ৫) এখন সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীদের বিবেচনাধীন। আলাদাভাবে মাধ্যমিক শিক্ষা উন্নয়নের একটি কার্যক্রমের কথাও ভাবা হচ্ছে। প্রশ্ন, এখনো কি একটি সর্বজনীন বিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম তৈরি ও বাস্তবায়নের সময় আসেনি?
প্রাথমিক স্তরে বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ শিক্ষার্থী আছে। কিন্তু ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সের শিশুদের আনুমানিক ১০ লাখ বিদ্যালয়ে নাম লেখায়নি বা অকালে ঝরে পড়েছে। প্রায় নিরক্ষর এই শিশুদের নিজেদের জীবনের সম্ভাবনা পূরণের বা সমাজে অবদান রাখার সুযোগ নিঃসন্দেহে সীমিত।
মৌলিক শিক্ষার অধিকার থেকে শিশুদের এক বড় অংশের বঞ্চিত থাকাই আমাদের বিদ্যালয় শিক্ষার বৈশিষ্ট্য। ১৯৯০ সালে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক সর্বজনীন শিক্ষার আইন প্রবর্তন করে রাষ্ট্র ও অভিভাবকের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দেওয়ার পরও এই অবস্থা চলে এসেছে।
আরও আগে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পর ১৯৭৪ সালে কুদরাত-এ-খুদা কমিশন বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার সুপারিশ করে। পরে ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে এ সুপারিশ সমর্থন করে দ্রুত তার বাস্তবায়নের কথা বলা হয়। কিন্তু আজও তা ঘটেনি।
কার্যক্রমের লক্ষ্য ও কৌশলের প্রয়োজনে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় পরিবর্তনে তাঁদের প্রবল অনীহা। বিদ্যালয়শিক্ষাকে দুই ভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রাখার ব্যবস্থা আর কোনো দেশে আছে বলে আমরা জানি না।
বিদ্যমান বিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রমে বিপুলসংখ্যক শিশুর শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত না হওয়ায় ব্র্যাক ১৯৮০-র দশকে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করে। এক কামরা, এক শিক্ষক- কমিউনিটিভিত্তিক এ উদ্যোগের মাধ্যমে ৮ থেকে ১৪ বছরের শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের (বিশেষত মেয়েদের) জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। কমিউনিটি থেকে নির্বাচিত শিক্ষকের নিবিড় ও অবিরত প্রশিক্ষণ ও তত্ত্বাবধান, শিশুবান্ধব শিক্ষা পরিবেশসহ পরিবারের জন্য নিখরচার এই কার্যক্রম সফলতা পায়।
১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি ৩০ হাজারের বেশি উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্রে (ব্র্যাক সুফল হিসেবে খ্যাত) এককালীন ১০ লাখের অধিক শিশু তিন থেকে চার বছরের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। তাদের ৮০ শতাংশের বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছে। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো এ সাফল্যকে স্বীকৃতি দিয়ে ব্র্যাক ও সহযোগী ক্ষুদ্র এনজিওগুলোকে এই কার্যক্রমে অর্থ জোগায়। পরিবারের জন্য বিনা মূল্যে এই শিক্ষাসেবা চালু রাখা হয়।
১৯৯০-র দশকের শেষে দাতা সংস্থা ও সরকারের মনোভাব ও আন্তর্জাতিক সাহায্যের পরিবেশে পরিবর্তন আসে। ১৯৯৭ সালে প্রাথমিক শিক্ষায় এক উপখাত উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। পিইডিপি-১ হিসেবে এ কার্যক্রম পরিচিতি লাভ করে। খাতভিত্তিক কার্যক্রম (সেক্টর ওয়াইড অ্যাপ্রোচ) তখন জনপ্রিয় হয়। যেকোনো খাতের বা উপখাতের উন্নয়নে সমন্বিত ও সামগ্রিক ভাবনা থাকবে (আংশিক বা খণ্ডিত নানা প্রকল্পের পরিবর্তে), তা-ই খাতভিত্তিক কার্যক্রমের মূল কথা।
কিন্তু এর আনুষ্ঠানিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখা দেয় দুটি বিষয়। সব বিদেশি অর্থায়ন পুরোপুরি সরকারের মাধ্যমে হবে এবং কার্যক্রমের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার পূর্ণ দায়িত্ব থাকবে সরকারের। ফলে ব্র্যাক ও অন্য এনজিওগুলোর শিক্ষা কার্যক্রমে বিদেশি সাহায্য সংকুচিত হয়ে যায়। শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের জন্য সফল উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার কার্যক্রমও প্রায় বিলুপ্ত হতে থাকে।
পিইডিপি-১ এবং পরে ২০০৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আরও তিন দফা প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কার্যসূচি গ্রহণ করা হয়। ১৯৯৭ সাল থেকে এই ৪ কার্যক্রমে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার (প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা) ব্যয় করা হয়। এই ব্যয়ের ৮০ শতাংশের অধিক আসে বাংলাদেশের নিজস্ব বিনিয়োগ হিসেবে।
এই বিপুল ব্যয়ের ফলে বিদ্যালয়ে শিশুর সংখ্যা বেড়েছে এবং অবকাঠামোর প্রসার হয়েছে, যদিও তা অনেকাংশে এখনো অপর্যাপ্ত রয়ে গেছে। অন্যদিকে দক্ষতা ও জ্ঞানের মাপকাঠিতে বিশেষ ফল পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে পঞ্চম শ্রেণি শেষ করেও অধিকাংশ শিশু লিখতে, পড়তে বা গুনতে পারে না। বিশ্বব্যাংকের ভাষায়, বাংলাদেশ অন্য অনেক দরিদ্র দেশের মতো শিক্ষা দারিদ্র্যের এক চক্রে আবদ্ধ হয়ে আছে।
পিইডিপি-২ থেকে ৪ পর্যন্ত (২০০৪ থেকে ২০২৪) কার্যক্রমে এনজিও প্রবর্তিত উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষার আদলে রিচিং আউট অব স্কুল ও পরে নাম পরিবর্তন করে সেকেন্ড চান্স বা দ্বিতীয় সুযোগ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এসব প্রকল্পে চুক্তিভিত্তিক এনজিওগুলোকে যুক্ত করলেও এগুলোর ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব রাখা হয় সরকারের হাতে।
প্রথমে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং পরে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো (বিএনএফই) এই দায়িত্ব নেয়। সরকার পরিচালিত এ দুই প্রকল্পের ফল ছিল হতাশাজনক। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিআইডিএস) নিরীক্ষায় বলা হয়, সংখ্যার দিক থেকে প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও কমিউনিটির প্রয়োজন ও পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখা হয়নি এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধান ছিল দুর্বল।
অভিজ্ঞ, দক্ষ ও সফল এনজিওগুলোকে সুযোগবঞ্চিত ও বিশেষ পরিস্থিতির শিকার শিশুদের শিক্ষার কাজে না লাগিয়ে সরকারি দপ্তরের সনাতনী ধারায় এগুলো চালানোর চেষ্টা করে সুফল পাওয়া যায়নি।
এদিকে সম্প্রতি সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ৫০ বছর আগের ও পরে ২০১০ সালের সুপারিশ অনুযায়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির পাঠদানের ব্যবস্থা করা হবে। এ সিদ্ধান্তে কিছু বড় প্রশ্ন সামনে চলে আসে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি যুক্ত করা শিখন-শিক্ষণের পদ্ধতি, অবকাঠামো তৈরি ও শিক্ষক নিয়োগ ও ব্যবস্থাপনার দিক থেকে কতখানি বাস্তবসম্মত? পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা ও ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা বিষয়বস্তু, পাঠক্রম, শিক্ষকের যোগ্যতা ও অবকাঠামোর প্রয়োজনের দিক থেকে গুণগতভাবে ভিন্ন।
২০১৬ সালে সরকার উদ্যোগ নিয়েছিল ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার দায়িত্ব প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রায় ৭০০ প্রাথমিক স্কুলে এসব শ্রেণি খোলা হয়। এই উচ্চতর শ্রেণির জন্য শিক্ষক, অবকাঠামো ইত্যাদি জোগানো ও ব্যবস্থাপনায় বহু সমস্যা দেখা দেয়। ফলে প্রকল্পটি আর এগোয়নি। এখন আবার সরকারের সেই পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত কেন, তা বোধগম্য নয়।
অনুমান করা যায় সরকারি কর্মকর্তারা স্কুলশিক্ষার জন্য বিদ্যমান দুই মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্ব ও সংগঠন অটুট রেখে শিক্ষা কার্যক্রম তৈরি করা শ্রেয় মনে করেছেন। কার্যক্রমের লক্ষ্য ও কৌশলের প্রয়োজনে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় পরিবর্তনে তাদের প্রবল অনীহা। বিদ্যালয় শিক্ষাকে দুই ভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রাখার ব্যবস্থা আর কোনো দেশে আছে বলে আমরা জানি না।
২০৩০ সালের এফডিজি-৪-এর লক্ষ্য, সব শিশুর জন্য মানসম্মত (প্রাক্-প্রাথমিক, প্রাথমিকসহ) মাধ্যমিক শিক্ষায়ন ২০৩০-এর মধ্যে না হলেও সময়সীমা বেঁধে এ রকম একটি পরিকল্পনার কোনো সরকারি উদ্যোগ নেই কেন? দেশের শিশু-কিশোরদের এক বড় অংশকে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে উচ্চমধ্যম আয়ের চৌকস বাংলাদেশের লক্ষ্য কীভাবে পূরণ হবে?
বাস্তবতার নিরিখে, শিখন-শিক্ষণের কার্যকারিতা রক্ষা করে সব শিশুর বিদ্যালয় শিক্ষার অধিকার নিশ্চিতকরণে কীভাবে এগোতে হবে?
প্রথমত, বিদ্যালয় শিক্ষাকে (প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত) এক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ন্যস্ত করা প্রয়োজন। সমন্বিত ও পূর্ণাঙ্গ বিদ্যালয় শিক্ষা উন্নয়নের বাধা এভাবে লাঘব হতে পারে। দ্বিতীয়ত, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক স্তর ও ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে পরবর্তী স্তরের ভিন্ন চরিত্র মেনে নিয়ে বর্তমান কাঠামোয় প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নের ব্যবস্থা করতে হবে। এ দুই নীতিগত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সব শিশুর মানসম্মত শিক্ষা-১ কার্যক্রম (পিইডিপি-৫-এর পরিবর্তে) বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।
এ ধরনের সামগ্রিক উপখাত পরিকল্পনার আওতায় বিদ্যালয় শিক্ষার জন্য (শুধু প্রাথমিক স্তরের জন্য নয়) উপানুষ্ঠানিক দ্বিতীয় সুযোগের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কারণ, শিশুদের এক অংশ নানা কারণে বিদ্যালয়বহির্ভূত থেকে যায়। কিন্তু এই শেষোক্ত কাজটি সরকারি দপ্তরের হাতে না রেখে (সরকারি অর্থায়নে) দক্ষ ও অভিজ্ঞ এনজিওর দায়িত্বে থাকলে সাফল্যের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। এ জন্য সবাইকে গতানুগতিক মানসিকতা পরিহার করতে হবে।
● ড. মনজুর আহমদ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর ইমেরিটাস, বাংলাদেশ প্রাথমিক শিশু বিকাশ নেটওয়ার্কের সভাপতি ও গণসাক্ষরতা অভিযানের উপদেষ্টা