জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা সড়কের দুর্যোগ ‘সড়ক দুর্ঘটনা বা রোড ক্র্যাশ’ আমাদের জাতীয় জীবনে বড় ধরনের একটা নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে আছে। তৃণমূল থেকে উচ্চপর্যায় এ সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে সোচ্চার হলেও কোথায় যেন একটা গলদ থেকে যাচ্ছে। অদৃশ্য একটা বলয় সব ইচ্ছার অপমৃত্যু ঘটাচ্ছে। এ কারণে সড়কের ভয়াবহতার লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। ২৯ বছর আগে যে আবেগ ও শোকাবহ শক্তিকে অদমিত ইচ্ছায় পরিণত করে সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ স্লোগানে সোচ্চার হয়েছিলাম, সেই আহ্বান, সেই চাওয়া আজ পুরো জাতির। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, এ সমস্যা আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি কেন? কেন সড়ক দুর্ঘটনা নিরসন হচ্ছে না? কেন সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না? কেন আইন বারবার হোঁচট খাচ্ছে? তাহলে কি বলব, মহল বিশেষের একান্ত ইচ্ছার কাছে বন্দী হয়ে আছে সব উদ্যোগের চাবিকাঠি।
আমি ২৯ বছর ধরে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কাজ করছি, সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে, ইচ্ছার জন্ম হয়েছে, গভীরতার পরিমাপ হয়েছে, কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারিনি। আমি বলব, বেসরকারিভাবে যতই আওয়াজ উঠুক, জনমত তৈরি হোক, এটি রোধ করা সম্ভব নয় যতক্ষণ না সরকারিভাবে ফলপ্রসূ কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়। জাতিসংঘ সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করার জন্য একটা ফর্মুলা দিয়েছে। তারা ফর্মুলাটির পাঁচটি পিলার চিহ্নিত করেছে। প্রধান পিলার হলো ম্যানেজমেন্ট বা ব্যবস্থাপনা, তারপর নিরাপদ গাড়ি, নিরাপদ সড়ক, সড়ক ব্যবহারকারী এবং দুর্ঘটনা-পরবর্তী চিকিৎসা। এই কাজগুলো করা হলে উন্নত দেশের মতো আমরাও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব।
প্রথমত, সড়ক দুর্ঘটনা নিরাময়ে জাতিসংঘ ঘোষিত পাঁচটি পিলারকে ম্যানেজমেন্টের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। তার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি, অভিজ্ঞ লোক এবং কাকে দায়িত্ব দিলে সঠিকভাবে কাজ হবে, সেই জিনিসটা ম্যানেজমেন্ট ও পরিকল্পনার মধ্যে থাকতে হবে। দেখতে হবে সড়ক পরিবহন আইন কেন অকার্যকর হচ্ছে, কত লোক আহত ও মারা যাচ্ছে, কেন ও কী ধরনের দুর্ঘটনা হচ্ছে? কী ধরনের গাড়ির সঙ্গে দুর্ঘটনা হচ্ছে? সেগুলোরও একটি পরিসংখ্যান থাকতে হবে। সঠিক পরিসংখ্যান থাকলে সে অনুযায়ী ম্যানেজমেন্ট করে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
সড়ক হচ্ছে জাতির লাইফলাইন। আর এ সড়কের মূল ব্যবহারকারী হচ্ছেন চালক। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, অধিকাংশ চালকেরই নেই উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং তাঁরা জানেন না কোন সড়ক কীভাবে ব্যবহার করতে হয়। এসব ক্ষেত্রে চালককে যদি সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত না করা যায়, তাহলে সে নিজের বোধ ও বুদ্ধিতে চলবে। সড়কের চরিত্র সম্পর্কে অনভিজ্ঞ সাইন, সিগন্যাল বা নির্দেশিকা না জানা এই চালকেরাই তখন দুর্ঘটনা ঘটাবেন এবং ঘটাচ্ছেন। একটি পিস্তল বা আগ্নেয়াস্ত্রের একটি গুলিতে একজন মানুষ মারা যায়, কিন্তু একজন চালকের হাতে অনেকগুলো মানুষের জীবন সমর্পিত থাকে। যদি সেই চালক অনুপযোগী চালক হন, তাহলে যাত্রী কিংবা পথচারীদের জীবনের নিরাপত্তা কোথায়?
পাশাপাশি পরিবহনমালিক যাঁরা আছেন, ব্যবসার পাশাপাশি তাঁদের মানবিক দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে হবে। তাঁদেরও সচেতন হতে হবে। যদি এই মানসিকতা থাকে যে তাঁরা শুধু এখানে ব্যবসা করবেন আর অর্থ উপার্জন করবেন, তাহলে সড়ক নিরাপদ হবে না। প্রথমে চালক নিয়োগের বিষয়টি সঠিকভাবে করতে হবে। জানতে হবে, চালকের মানসিকতা কী রকম, তিনি নেশাগ্রস্ত কি না এবং কী রকম আচরণ করেন? যদি উগ্র আচরণ করেন, তাহলে গাড়ি চালাতে দেওয়া উচিত নয়। উপযুক্ত চালক নিয়োগ, গাড়ির ফিটনেস মালিকদের দায়িত্বসহকারে দেখা উচিত। ট্রিপ বেসিসে এবং চালকের কাছে গাড়ি ভাড়া দিয়ে অর্থ উপার্জন করা যাবে না। চালক সড়কে কীভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন, কেমন আচরণ করছেন, তা প্রযুক্তির মাধ্যমে মনিটরিং করতে হবে। এই কাজগুলো না করা হলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয়।
আরেকটি বিষয়, একটি দুর্ঘটনা ঘটার পর আহত ব্যক্তিদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। তাহলে প্রাণহানির সংখ্যা কমবে এবং পঙ্গুত্ব হ্রাস পাবে। কেননা, সঠিক সময়ে সঠিকভাবে চিকিৎসা না হলে বিশেষ করে প্রাথমিক চিকিৎসাসহ আহত ব্যক্তিদের দ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তর না করা গেলে দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তির জীবনমানের শঙ্কা থেকে যায়। মূলত সড়ক দুর্ঘটনায় বেশি মারা যায় আহত ব্যক্তির শরীর থেকে রক্ত বের হয়ে যাওয়ায়, শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে। যদি প্রাথমিকভাবে আহত রোগীর রক্তক্ষরণ বন্ধ করা যায় এবং শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক করা যায়, তাহলে মৃত্যুর শঙ্কা কমিয়ে আনা যায়। তার জন্য হাইওয়েতে ট্রমা সেন্টার ও রেসকিউ টিম (অ্যাম্বুলেন্স-সুবিধাসহ) অপরিহার্য। আর এটা সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি কমাতে ম্যানেজমেন্টে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে রাখতে হবে এবং বাস্তবায়ন করতে হবে।
বেসরকারি সংস্থা হিসেবে আমি বা আমরা যাঁরা সড়কের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করি, তারা পথচারীদের ও শিক্ষার্থীদের সচেতন করা, চালকদের দক্ষ করে গড়ে তোলা ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে পারি। সেই সঙ্গে কমিউনিটিভিত্তিক প্রশিক্ষণ চালু করে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে সড়ক ব্যবহারে সচেতন করে গড়ে তোলা যাবে। তার জন্যও প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা ও সহযোগিতা। সবকিছুই নির্ভর করবে সড়ক নিয়ে সরকারের ম্যানেজমেন্ট ও পরিকল্পনার ওপর।
যাত্রীর নিরাপত্তায় সিটবেল্ট অপরিহার্য একটা বিষয়। যেসব দেশ সমন্বিত পরিকল্পনায় সড়ক দুর্ঘটনাকে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসতে পেরেছে, সেসব দেশে গাড়িতে সিটবেল্টের সঠিক ব্যবহারও একটি উপযোগী কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। গাড়ির চালকের পাশাপাশি যাত্রীদের সিটবেল্ট বাধা অনেক দেশেই বাধ্যতামূলক। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশের অধিকাংশ চালক কিংবা যাত্রী সিটবেল্টের সঙ্গে পরিচিত নন। শুধু প্রাইভেট গাড়ির চালক ও তার পাশের সিটের যাত্রীর সিটবেল্টের সঙ্গে পরিচিত, যদিও এসব গাড়িতেও সিটবেল্টের ব্যবহার সঠিকভাবে হচ্ছে না। প্রাইভেট গাড়ির পেছনে যারা বসে, তারা সিটবেল্ট বাঁধে না। এখন দেখা যাচ্ছে, সামনে বা পেছন থেকে কোনো গাড়ি সংঘর্ষ হলে বা দুর্ঘটনায় পতিত হলে পেছনের যাত্রী সামনের দিকে ছিটকে পড়ে এবং সামনের মানুষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমনকি মৃত্যুমুখেও পতিত হয়। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, গাড়িতে যাত্রী ও চালকের সিটবেল্ট যথাযথভাবে ব্যবহারের কারণে দুর্ঘটনায় মৃত্যুঝুঁকি অনেকাংশে কমে আসে।
এবার আসা যাক গাড়িতে শিশুদের আসন প্রসঙ্গে। গাড়িতে শিশুদের আসন যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়, তাহলে শিশুর মৃত্যুহার অনেক কমে আসবে। কারণ, গাড়িতে যে আসন থাকে, তা প্রাপ্তবয়স্কদের উপযোগী আসন। সেই আসনে শিশুদের বসানো হলে সিটবেল্টের যথাযথ প্রয়োগ কিংবা শিশুর শারীরিক কাঠামোগত উপযোগী নয়। ফলে দুর্ঘটনা ঘটলে শিশুরা দ্রুত আসন থেকে ছিটকে পড়ে এবং মৃত্যুমুখে পতিত হয়। নিরাপদ ভ্রমণ ও যাত্রীদের নিরাপত্তায় জাতিসংঘ তাই শিশুদের আসনের গুরুত্ব তুলে ধরে সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচটি অতিঝুঁকিপূর্ণ কারণের মধ্যে শিশুর আসনকেও চিহ্নিত করেছে। আমাদের নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনায় সিটবেল্টের পাশাপাশি শিশু আসনের উপযোগিতা ও গুরুত্ব সমানভাবে স্থান পেতে হবে।
নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠায় আমাদের দেশে এখন প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখা দিয়েছে মোটরসাইকেল। নিত্য মোটরসাইকেলের দুর্ঘটনা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার প্রধান কারণ অল্প বয়সী চালক, উপযুক্ত ট্রেনিংয়ের অভাব, বেপরোয়া গতি, একের অধিক যাত্রী, নিয়মকানুন না মানা, মানসম্পন্ন হেলমেট ও সঠিকভাবে পরিধান না করা। নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনায় স্ট্যান্ডার্ড হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক।
মোট কথা নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের পাঁচটি পিলার ও অতিঝুঁকিপূর্ণ ৫টি কারণকে যদি সরকার ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসতে পারে, তাহলে আমরা আশার আলো দেখতে পারি। আমি আশা করব, পৃথিবীর অন্যান্য দেশ জাতিসংঘের নির্দেশনা মেনে সড়ক দুর্ঘটনাকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। সরকার যদি চায়, তাহলে এ জায়গায় নিয়ে আসতে পারবে।
বেসরকারি সংস্থা হিসেবে আমি বা আমরা যাঁরা সড়কের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করি, তারা পথচারীদের ও শিক্ষার্থীদের সচেতন করা, চালকদের দক্ষ করে গড়ে তোলা ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে পারি। সেই সঙ্গে কমিউনিটিভিত্তিক প্রশিক্ষণ চালু করে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে সড়ক ব্যবহারে সচেতন করে গড়ে তোলা যাবে। তার জন্যও প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা ও সহযোগিতা। সবকিছুই নির্ভর করবে সড়ক নিয়ে সরকারের ম্যানেজমেন্ট ও পরিকল্পনার ওপর।
বিশেষ করে সড়ক পরিবহন আইনের যথাযথ প্রয়োগ সড়ককে অনেকটা নিরাপত্তায় সুসংহত করতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আইন আছে, আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই। কারণ, আইনে সবকিছুর ব্যাখ্যা নেই। আইনকে পুরোপুরি কার্যকর করতে বিধিমালা অপরিহার্য। অথচ সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ প্রণীত হলেও চার বছরেও এর বিধিমালা আলোর মুখ দেখেনি। বরং এই আইনকে যতটা অকার্যকর করে রাখা যায়, তারই প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। কেউ যদি আইন না মানে এবং তাকে আইনের আওতায় না আনা যায়, তাহলে সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে কী করে? আমি মনে করি, আইন এমন একটি জিনিস, যা প্রতিটি মানুষকে একটি নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে নিয়ে আসে। উদাহরণ হিসেবে যেকোনো সেনানিবাসের কথা বলা যায়। সেখানে আইনের যথাযথ ব্যবহার ও প্রয়োগ পদ-পদবির চেয়ে অনেক ঊর্ধ্বে, তাই সেখানে প্রতিটি মানুষ একটা শৃঙ্খলার মধ্যে রয়েছে এবং প্রতিপালন করছে। তাহলে সর্বত্রই এ সিস্টেম প্রতিষ্ঠিত হবে না কেন?
আমাদের যে সড়ক আইনটি আছে, তার বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা দেওয়ার পরও কেন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না, তা নিয়ে সরকারের সব অংশীজনের চিন্তা করতে হবে। আমরা আশা করব, সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এই বিষয়গুলোকে অনুধাবন করবে। প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে জাতিসংঘের দেওয়া ফর্মুলা মেনে অনেক দেশ সড়ক দুর্ঘটনা অনেক কমিয়ে ফেলেছে। নিয়মকানুন মানলে আমরাও নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠা করতে পারব।
ইলিয়াস কাঞ্চন নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান