অভিমত
‘গণতান্ত্রিক’ পুলিশি ব্যবস্থার রূপরেখা যেমন হতে পারে
আমাদের দেশে পুলিশ বাহিনী পরিচালিত হচ্ছে ঔপনিবেশিক আমলে প্রণীত আইনের আওতায়। পুলিশকে দেখা হয় দমন–পীড়ন ও নিপীড়নের যন্ত্র হিসেবে। এ ব্যবস্থার বদলে ‘গণতান্ত্রিক’ পুলিশি ব্যবস্থার রূপরেখা নিয়ে লিখেছেন মির্জা হাসান ও খলিলউল্লাহ্।
পুলিশ সংস্কার নিয়ে অতীতের মতো আবারও বিতর্ক শুরু হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়টি। পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে পেশাদারত্বের সঙ্গে পরিচালনার জন্য স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা ছিল। এটি পুলিশেরও চাওয়া।
কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আওতায় গঠিত পুলিশ সংস্কার কমিশন এ বিষয়ে কোনো রূপরেখা দেয়নি। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’ ও ‘বিচার-বিশ্লেষণ’ করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছে সংস্কার কমিশন। প্রশ্ন হলো, কমিশন নিজে কেন বিষয়গুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিচার-বিশ্লেষণ করে সুপারিশ প্রদান করেনি? বিশেষজ্ঞ হিসেবেই তো কমিশনের সদস্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল!
পুলিশ নিয়ে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা বোঝা যায় সংস্কার কমিশনের ‘কেমন পুলিশ চাই’ জনমত জরিপের ফলাফল থেকে। মানুষ সবচেয়ে বেশি দেখতে চেয়েছেন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, আইনের প্রতি অনুগত বা নিরপেক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত পুলিশ। বর্তমানে পুলিশ বাহিনী পরিচালিত হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন। সে জন্য রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে পুলিশ কাজ করতে পারে না। তাই দীর্ঘদিন ধরেই এর বিকল্প হিসেবে একটা স্বাধীন কমিশন গঠন নিয়ে আলোচনা ছিল।
বর্তমান পুলিশি ব্যবস্থার মূল কাজ হলো ক্ষমতাসীন সরকারকে রক্ষা করা, যাকে বলা হয় ‘রেজিম পুলিশ’। কিন্তু জন–আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হলে প্রয়োজন ‘গণতান্ত্রিক পুলিশি’ ব্যবস্থা। তবে গণতান্ত্রিক পুলিশ গঠনে শুধু স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনই যথেষ্ট নয়। পাশাপাশি থানা পর্যায়ে আলাদা কমিটি গঠনের মতো কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
অতীতের সংস্কার উদ্যোগ
২০০৫ সালে একবার পুলিশ সংস্কার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। এরপর ২০০৮-১০ সালের কৌশলগত পরিকল্পনায় প্রথমবারের মতো পুলিশের দৃশ্যকল্প, মূল মিশন এবং অগ্রাধিকারগুলো তুলে ধরা হয়েছিল। এর আওতায় পাঁচটি মৌলিক সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল। যেমন পুলিশের সাংগঠনিক সংস্কার, পুলিশি কার্যক্রমে স্থানীয় মানুষের সম্পৃক্ততা (কমিউনিটি পুলিশিং), প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি, আলাদাভাবে নারী পুলিশ রাখা ও জেন্ডার সংবেদনশীলতা এবং কম্পিউটারভিত্তিক ব্যবস্থাপনা। এ ছাড়া পুলিশের সংশোধিত অধ্যাদেশে স্বাধীন পুলিশ কমিশন এবং প্রশাসন ক্যাডারভিত্তিক আমলাতন্ত্র থেকে পুলিশের বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হয়েছিল।
তবে সে সময় উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে এসব গবেষণাধর্মী সংস্কার তত বেশি গুরুত্ব পায়নি। তাঁদের আগ্রহের জায়গা ছিল সংস্কারের মাধ্যমে আমলাতন্ত্র থেকে পুলিশের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে পুলিশের ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত রাজনৈতিক প্রভাববলয় বজায় রাখা। তবে তখনো তাঁরা পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে একটা স্বাধীন কমিশনের দাবি জানিয়েছিলেন। সেটা বাস্তবায়িত হলে জনগণের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক আজ ভিন্ন হতে পারত। বিগত শাসনামলে জনগণের মুখোমুখি অবস্থান গ্রহণ করায় বর্তমানে পুলিশ নৈতিকভাবে আইন প্রয়োগ করতে পারছে না। এর ফলাফল হলো আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি।
আমরা দেখেছি, ২০০৫ সালের সেই সংস্কার কর্মসূচির মাধ্যমে সীমিত কিছু সংস্কার বাস্তবায়ন করা গিয়েছিল, যেমন মডেল থানা, ওপেন হাউস ডে এবং পুলিশের নেতৃত্বে কমিউনিটি পুলিশিং ফোরাম। তবে প্রশাসনিক ক্যাডারদের ব্যাপক বিরোধিতা এবং রাজনৈতিক এলিটদের পক্ষ থেকে সহায়তার অভাবে কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়নি। মানুষের মনেও ধারণা জন্মায় যে শুধু অধ্যাদেশ জারি করলেই পুলিশের প্রকৃত আচরণ পাল্টাবে না। এ ছাড়া স্থানীয় থানা-পুলিশের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের যোগসাজশের বিষয়টি তখন যথাযথভাবে অধ্যাদেশে তুলে ধরা হয়নি।
পুলিশ সংস্কারে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত থানা। স্থানীয় পর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে নানা শ্রেণি-পেশার যোগসাজশের মাধ্যমে যেসব দুর্নীতি হয়ে থাকে, সেগুলো দূর করার ব্যবস্থা থাকা বেশি জরুরি। পুলিশ সংস্কারের পুরোনো পদ্ধতি ব্যর্থ হওয়ায় এই বিষয়ক চিন্তায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। আর নতুন এ চিন্তার মূল জায়গা হতে হবে জনগণের সঙ্গে পুলিশের দূরত্ব কমিয়ে আনা। এ পদ্ধতিতে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক পুলিশি ব্যবস্থা বাস্তবায়ন হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। সাধারণ নাগরিকও পুলিশি ব্যবস্থার অংশ হয়ে উঠবে এবং বল প্রয়োগমূলক না হয়ে পুলিশ হবে সহযোগিতামূলক শক্তি।
‘গণতান্ত্রিক’ পুলিশ অপরিহার্য
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, মানুষ পুলিশকে সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে না দেখে বরং কর্তৃত্বপরায়ণ সংস্থা হিসেবে দেখে থাকে। তবে পুলিশের ওপর আস্থা না থাকলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের ভূমিকাই যে মূল, সে বিষয়ে সবাই একমত। পুলিশ বাহিনীর ১২৭ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে ১৭ মার্চ বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমরা পুলিশকে অবহেলা করে বা পাশ কাটিয়ে দেশ গড়তে পারব না। তারাই সম্মুখসারির মানুষ। তারা ক্ষেত্র প্রস্তুত করলে তখন বাকি জিনিসগুলোও হয়।’
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শাসনব্যবস্থা ও উন্নয়নবিষয়ক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বিআইজিডির গবেষণায় পুলিশের প্রতি মানুষের নানা আকাঙ্ক্ষার কথা উঠে এসেছে। মানুষ মনে করে, বিদ্যমান পুলিশি ব্যবস্থার বদল ঘটিয়ে নতুন ধরনের ব্যবস্থা কায়েম করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে কাঠামোগত পরিবর্তনের পাশাপাশি জনগণের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্কেও বদল আনতে হবে।
পুলিশের শৃঙ্খলাগত ও নীতিগত বিষয় সংস্কার করা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ থেকে পুলিশকে বের করে আনা এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে পারলে কাঠামোগত পরিবর্তন আসবে বলে মানুষ মনে করে। পুলিশি কার্যক্রমে জনগণের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি এবং পুলিশকে জবাবদিহির আওতায় আনাই নতুন ধরনের পুলিশি ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য।
গবেষণায় অংশ নেওয়া মানুষের কথার সারমর্ম হলো পুলিশকে দায়বদ্ধ রাখতে একটি সমাজভিত্তিক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। মানুষ সংস্কারের মাধ্যমে এমন এক পুলিশি ব্যবস্থা চায়, যেখানে জনগণের সঙ্গে পুলিশের ক্ষমতার ভারসাম্য থাকবে। যেহেতু গণতন্ত্রে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস, তাই পুলিশকে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ করার ব্যবস্থা থাকা দরকার।
বর্তমান ‘রেজিম পুলিশিং’ ব্যবস্থায় পুলিশের ধ্যানজ্ঞান হলো জনগণের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে ক্ষমতাসীন সরকারকে রক্ষা করা। এর বিপরীতে গণতান্ত্রিক পুলিশি ব্যবস্থায় পুলিশ ও জনগণের পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর জোর দেওয়া হয়। দুই পক্ষই একসঙ্গে কাজ করে এবং প্রয়োজনের সময় একে অপরকে রক্ষা করে।
এ ধরনের ব্যবস্থায় পুলিশ সহজেই জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারে। তাই সরকারের অনুগত না হয়েও তারা নিজেদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারে। প্রতিবারই সরকার পরিবর্তনের পর আমরা পুলিশ বাহিনীর অনেক কর্মকর্তাকে নানা রকম হেনস্তার শিকার হতে দেখি। এর কারণ, ক্ষমতাসীন সরকার নানা সময় পুলিশের আনুগত্য অর্জনের জন্য বাহিনীর উচ্চপদস্থ সদস্যদের বাড়তি সুবিধা দিয়ে থাকে। এর খেসারত দিতে হয় সুবিধা না নেওয়া ও নিচের সারির পুলিশ সদস্যদেরও।
গণতান্ত্রিক পুলিশি ব্যবস্থা থাকলে এ ধরনের পরিণতি হতো না। কারণ, তখন জনবান্ধব পুলিশের ওপর মানুষেরও আস্থা থাকত। গণতান্ত্রিক পুলিশি ব্যবস্থায় পুলিশ-নাগরিকের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক থাকে। তাই রাজনৈতিক নেতা বা ক্ষমতাসীন দলের মাধ্যমে পুলিশ কোনো ধরনের অন্যায়ের শিকার হলে মানুষ তাদের পাশে দাঁড়াবে, বিশেষ করে সরকার পরিবর্তনের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে।
এ ধরনের গণতান্ত্রিক পুলিশি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হলে মূল কাজ হলো জনগণের নেতৃত্বে থানা পর্যায়ে কমিটি তৈরি করা। এ কমিটি পুলিশের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি পুলিশ ও জনগণ উভয়ের অধিকার সুরক্ষায় এ কমিটি একটি সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করবে।
নাগরিকদের কমিটি কেমন হবে
বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে প্রতিনিধি নিয়ে থানা পর্যায়ে এ ধরনের কমিটি প্রতিষ্ঠা করা হবে। একটি থানার যেটুকু এখতিয়ার অঞ্চল রয়েছে, এসব কমিটির এখতিয়ারও ততটুকুই হবে। থানা পর্যায়ের এসব কমিটির প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি থাকবে। ফলে আলংকারিক হিসেবে না থেকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।
জাতীয় পর্যায়ে সাংবিধানিকভাবে গঠিত স্বাধীন পুলিশ কমিশনের আওতায় এসব কমিটি গঠিত হবে এবং তাদের স্বেচ্ছাচারিতা ঠেকাতে কমিটিগুলোকে কমিশনের কাছে দায়বদ্ধ করা হবে। এসব কমিটি স্থানীয় থানা প্রশাসনের জবাবদিহি নিশ্চিত করবে, বিশেষ করে মানবাধিকার বিষয়ে। থানার ওসির দ্বৈত জবাবদিহি থাকবে। অর্থাৎ পুলিশ প্রশাসনের কাছে এবং নাগরিক নেতৃত্বাধীন কমিটির কাছে।
যেহেতু সারা দেশে ৬৩৯টি থানায় সমপরিমাণ কমিটির দেখভাল করা জাতীয় পুলিশ কমিশনের পক্ষে কঠিন, তাই জেলা পর্যায়ে অনুরূপ একটি করে কমিটি থাকবে। জেলা কমিটি থানা কমিটিগুলো তদারক করবে এবং জেলার পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে এসব কমিটির একটা আন্তক্রিয়ামূলক সম্পর্ক থাকবে।
থানা ও জেলা উভয় কমিটির সদস্য সংখ্যা হতে পারে সর্বোচ্চ ১০-১৫ জন। কিন্তু হতে হবে যত বেশি সম্ভব অন্তর্ভুক্তিমূলক। সমাজের সব অংশের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। যেমন ধনী-গরিব, সংখ্যালঘু, নারী, বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষ, শিক্ষার্থী ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে আনুপাতিক হারে সদস্যসংখ্যা নির্ধারণ করা যেতে পারে।
দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য বা সরকারি কর্মকর্তা কিংবা জনপ্রতিনিধিরা এ কমিটির চেয়ারম্যান হতে পারবে না। এর বাইরে সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে কেউ কমিটির চেয়ারম্যান হবেন। শিক্ষক, সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি, শিক্ষার্থী, এনজিও কর্মী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা (জেলা কমিটিতে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা) কমিটির সাধারণ সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবেন।
এ কমিটি পুলিশের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করবে। তাই পুলিশের অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হবেন এ কমিটির সদস্যসচিব। তিনিই নির্দিষ্ট বিরতিতে কমিটির বৈঠক আহ্বান ও আয়োজন করবেন (প্রতি তিন মাসে একবার হতে পারে)। থানার প্রাঙ্গণেই বৈঠক হতে পারে। সংশ্লিষ্ট উপজেলার সব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান চক্রাকারে কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। ফলে কমিটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রতিনিধিত্বমূলক হবে। মনে রাখতে হবে, কমিটির সদস্য সঠিকভাবে নির্বাচন করা না গেলে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হবে না।
বিআইজিডির জরিপে অংশ নেওয়া বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন, উন্মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে কমিটির সদস্য বাছাই করাই সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি। প্রথাগত নির্বাচনপদ্ধতির ব্যাপারে মানুষের আপত্তি আছে। কারণ, এর ফলে অন্তর্ভুক্তিমূলক বাছাই যেমন নিশ্চিত করা যায় না, তেমনি অযোগ্য ব্যক্তিদেরও নির্বাচিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই একাধিক উন্মুক্ত আলোচনার দরকার পড়লেও এ পদ্ধতিই অনুসরণ করা উচিত।
এ কমিটির মেয়াদ হবে ক্ষমতাসীন কেন্দ্রীয় সরকারের অর্ধেক, অর্থাৎ আড়াই বছর। তাহলে সরকারের অনুগত কমিটিতে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি কমে আসবে।
পূর্বশর্ত ও চ্যালেঞ্জ
শুধু কমিটি করে দিলেই তা ঠিকভাবে কাজ করবে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। প্রথমত দরকার কমিটির আইনি ভিত্তি। এটা ছাড়া জনগণের আস্থা অর্জন সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, প্রশাসনিক স্বীকৃতির পাশাপাশি সামাজিক স্বীকৃতিও গুরুত্বপূর্ণ। তৃতীয়ত, কমিটির নির্দিষ্ট মাত্রার সিদ্ধান্ত প্রণয়নের ক্ষমতা এবং সেগুলো বলবৎ করার ক্ষমতা থাকা অপরিহার্য। এ ছাড়া কমিটির স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পদ্ধতি থাকাও জরুরি, যা জেলা কমিটির মাধ্যমে নিশ্চিত হবে।
এ ধরনের কমিটি বেশ কিছু রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। কমিটি কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তা রাজনৈতিক নেতাদের বিরোধিতা ও হস্তক্ষেপের মুখে পড়তে পারে। তাই সব রাজনৈতিক দলকে অন্তর্ভুক্ত করা অপরিহার্য। এ ছাড়া কমিটির সদস্যরা যেহেতু সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দা, তাই কারও বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে গেলে স্বজনপ্রীতির সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এ ধরনের ব্যবস্থা সাংস্কৃতিকভাবে মেনে নিতে সময় লাগবে। পুলিশ সাধারণ জনগণের কাছে দায়বদ্ধ হবে, এমন ধারণা মানুষের কাছে একদমই নতুন। পুলিশের জন্যও এটা মেনে নেওয়া কঠিন। যে জনগণকে দীর্ঘ সময় ধরে তারা নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে, তাদের কাছে জবাবদিহি করার অভ্যাস গড়ে ওঠা সময়সাপেক্ষ। নতুন প্রজন্মের কাছে বিষয়টি আশাব্যঞ্জক হলেও প্রবীণেরা এ ধরনের ব্যবস্থার স্থায়িত্ব নিয়ে সন্দীহান থাকবেন।
তাই এ ব্যবস্থা শুরুতে নানা রকম প্রতিবন্ধকতার শিকার হবে। কিন্তু প্রক্রিয়াটা শুরু হলে মানুষ এতে অভ্যস্ত হবে এবং ধীরে ধীরে এর সুফল আসতে শুরু করবে। তরি ডুবে যাওয়ার ভয়ে নদীর কূলে অলস বসে থাকার সুযোগ নেই।
ড. মির্জা হাসান ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জ্যেষ্ঠ গবেষক
খলিলউল্লাহ্ প্রথম আলোর জলবায়ু প্রকল্প ব্যবস্থাপক