কাউন্সেলিং বা মানসিক স্বাস্থ্যসেবা যেকোনো পেশাজীবীকেই জীবন ও কাজের ভারসাম্য বজায় রেখে স্বাচ্ছন্দ্য জীবনযাপনে সহযোগিতা করে। এমআরডিআইয়ের উদ্যোগে সংবাদকর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি এই পেশাজীবীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কতটা গুরুত্বপূর্ণ! কী পরিমাণ মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন তাঁরা!
আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খবর সংগ্রহ ও পরিবেশনের দায়িত্বটি পালন করেন সংবাদকর্মীরা। এসব খবরের মধ্যে যুদ্ধ, সংঘাত, অসংগতি, প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ, সহিংসতা, নির্যাতন, নানা ধরনের অপরাধ অন্যতম। উত্তেজনা, অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা, জরুরি অবস্থা তাই সাংবাদিকতা পেশার অংশ। মানসিক স্বাস্থ্যের পর্যাপ্ত যত্ন নিশ্চিত না করে পেশাগত কাজ চালিয়ে যাওয়ায় সংবাদকর্মীদের মধ্যে মানসিক চাপ, কাজে অনীহা, উদ্বেগ, বিষণ্নতা, ঘুমের সমস্যা, খাদ্যাভ্যাসে বৈকল্য (ইটিং ডিজঅর্ডার), ট্রমাসহ বিভিন্ন ধরনের মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা দেখা দিচ্ছে। যাঁদের অতীতের ট্রমা (মানসিক আঘাত) আছে এবং পর্যাপ্ত পারিবারিক সহযোগিতা পাচ্ছেন না, তাঁরা বেশি মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা ও ঝুঁকিতে রয়েছেন।
শুরুর কথা
একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ (আমি) ও পাঁচজন নারী সাংবাদিক নিয়ে ছয়জনের একটি দল। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে এমআরডিআইয়ের উদ্যোগে এই পাঁচজন জ্যেষ্ঠ নারী সাংবাদিককে প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ওপরে প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় আমাদের পথচলা। অর্থাৎ শুরুটা ছিল নারী সাংবাদিকদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে। চার দিনের আবাসিক এই প্রশিক্ষণে পাঁচজন নারী সাংবাদিক নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যেমন নিবিড়ভাবে কাজ করেছেন, তেমনি অন্যদের মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি নির্ণয় ও প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানেও দক্ষতা অর্জন করেছেন। প্রশিক্ষণ শেষে ঢাকায় ফিরেই শুরু হয় আমাদের মাঠপর্যায়ের কাজ।
কাউন্সেলিং ও সাইকোথেরাপি সেবা
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাংবাদিকেরা যখনই বুঝতে পারেন কোনো সহকর্মী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, মমতার হাত বাড়িয়ে দেন তাঁর প্রতি। মনোযোগ দিয়ে শোনেন সহকর্মীর মনোবেদনা। প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার পাশাপাশি ঝুঁকি নির্ণয় করেন এবং প্রয়োজন মনে হলে সাইকোথেরাপির জন্য পাঠিয়ে দেন আমার কাছে। প্রথম দিকে সংবাদকর্মীদের মধ্যে ব্যক্তিগত সাইকোথেরাপি সেবা নেওয়ার প্রবণতা কম থাকলেও ধীরে ধীরে এটি বেশ গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শুরুতে শুধু এই পাঁচজন প্রশিক্ষিত সাংবাদিকই সহকর্মীদের পাঠাতেন সাইকোথেরাপি সেবা নেওয়ার জন্য। কিন্তু এখন যাঁরা এই সেবা নিচ্ছেন ও উপকৃত হচ্ছেন, তাঁরাও অন্য কোনো সহকর্মীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত দেখলেই সাইকোথেরাপির জন্য উৎসাহ দিচ্ছেন। এভাবেই সংবাদকর্মীরা নিজের, পরিবারের ও সহকর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নের ব্যাপারে সচেতন ভূমিকা পালন করছেন।
মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক কর্মশালা
আমরা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সাড়া পেয়েছি মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক কর্মশালায়। প্রতি মাসে একটি করে কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ২০ থেকে ৩০ জন সাংবাদিক অংশ নেন। কর্মশালায় পরিচয় পর্ব শেষ করে শুরু হয় ধ্যান এবং তারপর থাকে মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব ও সংবাদকর্মীদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে অংশগ্রহণমূলক আলোচনা। এরপর একে একে তাঁরা হাতে–কলমে শিখতে থাকেন কষ্টকর আবেগ সামলানোর বিভিন্ন কলাকৌশল, সমস্যার সমাধান, আন্তরিক যোগাযোগ, সম্পর্কে সীমারেখা নির্ধারণ এবং জীবন ও কাজের ভারসাম্য বজায় রাখা।
যেভাবে যুক্ত হলেন পুরুষ সাংবাদিকেরাও
নারী সাংবাদিকদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার মাধ্যমে শুরু করার পরপরই আমরা খেয়াল করি, পুরুষ সাংবাদিকেরাও এ সেবা চাইছেন। কীভাবে এ সেবা পুরুষদের কাছে পৌঁছানো যায়, সে পরিকল্পনা চলছিল। এরই মধ্যে শুরু হয় জুলাই মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতা। মাঠে ও ডেস্কে দায়িত্বরত সাংবাদিকদের মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি অনুমান করতে পেরে এমআরডিআই দেশের নারী-পুরুষ সব সাংবাদিকের কাছে মুঠোফোনের মাধ্যমে বার্তা পাঠায় যে তাঁদের জন্য কাউন্সেলিং ও সাইকোথেরাপি সেবা নিয়ে বিশেষজ্ঞ দল প্রস্তুত। সাড়াও মিলেছে যথেষ্ট। কারফিউ চলাকালে যখন ইন্টারনেট সেবা বাধাগ্রস্ত ছিল, তখনো মুঠোফোনের মাধ্যমে কাউন্সেলিং সেবা নেন আতঙ্কে থাকা ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত সংবাদকর্মীরা। তাঁদের প্রায় প্রত্যেকের ভেতর সংকটকালীন ও সংকটপরবর্তী মানসিক চাপ (ট্রমাটিক স্ট্রেস) দেখা গিয়েছিল। আশার বিষয় হলো, যাঁরা মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়েছেন, প্রত্যেকেই বলেছেন, তাঁরা উপকৃত হয়েছেন, নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি সচেতন ও যত্নবান হয়েছেন এবং এর ফলে দীর্ঘমেয়াদি মানসিক রোগকে প্রতিরোধ করেছেন। জুলাইয়ের সংকটকালে একজন মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে সাংবাদিকদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তাঁদের প্রতি মমতা ও শ্রদ্ধা বহুগুণ বেড়েছে। তাঁদের সেই সময়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার কাজটি বেশ কঠিনও ছিল। সহিংসতায় চারজন সাংবাদিক নিহত হন, আহত হন অসংখ্য সাংবাদিক।
মানসিকভাবে বিপর্যস্ত সাংবাদিকেরা একদিকে যেমন কাজে ফিরতে আতঙ্ক বোধ করছিলেন, অন্যদিকে কাজে না ফিরলে কর্মসংস্থান হারানোর আশঙ্কাতেও ভুগছিলেন। এই দোটানা পরিস্থিতিতে নিজেদের নিরাপদ রেখে পেশাগত দায়িত্ব চালিয়ে যাওয়ার মতো দুরূহ কাজটিই তাঁরা করেছিলেন। সংকটকালে পুরুষ সাংবাদিকদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা শুরু হলেও সংকট শেষে এই সেবা বন্ধ হয়েছে, তেমনটি নয়। এমআরডিআইয়ের উদ্যোগে এই মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এখন সারা দেশের নারী–পুরুষ সব সাংবাদিকের জন্য। আর তাঁরা এ সেবা পাচ্ছেন সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে।
কিছু বাধা
সাংবাদিকদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে গিয়ে মনে হয়েছে, যাঁরা এ ধরনের সেবা নিচ্ছেন, তাঁরা নিজেরা ইতিবাচক মনোভাব ধারণ করলেও তাঁদের নিয়ে অন্যরা কী ভাবছেন, সে ব্যাপারে আশঙ্কায় থাকেন। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের দেশে অনেক বিভ্রান্তিকর ধারণা আছে, যেমন যাঁরা মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নেন, তাঁরা ‘পাগল’, কাউন্সেলিং ভীতু ও দুর্বলদের জন্য, একবার কাউন্সেলিং নিলে সারা জীবনই নিতে হবে ইত্যাদি। প্রচলিত এসব ধারণার কারণে প্রয়োজন থাকলেও অনেক সাংবাদিক কাউন্সেলিং সেবা নেওয়ার ব্যাপারে সংশয়ে থাকেন বা পিছপা হন। অথচ শুধু রোগ নিরাময় নয়, একটি প্রশান্তিপূর্ণ ও কর্মদীপ্ত জীবনের জন্য যে কেউই মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারে।
বর্তমানে পৃথিবীতে প্রতিবছর সাত লাখের অধিক মানুষ আত্মহত্যা করে। বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। সাংবাদিকদের মধ্যেও এই হার কম নয়। কিছুদিন আগেও একজন সাংবাদিক আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু প্রতিরোধে, কষ্টের মুহূর্তে নিজের ও সহকর্মীর পাশে থাকতে প্রয়োজন মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা। সংবাদকর্মীদের জীবন ও কাজকে সহজ–সুন্দর করার জন্য এমআরডিআইয়ের উদ্যোগে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন কর্মসূচিতে এই কমিউনিটির সবার সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
রাউফুন নাহার সহকারী অধ্যাপক, এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়