কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: সংবাদে, সংকটে, সম্ভাবনায়

টাইম ম্যাগাজিনের ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: সম্ভাবনার নুতন যুগ’ শীর্ষক বিশেষ সংখ্যায় সন্নিবেশিত লেখাগুলোর ওপর প্রধানত ভিত্তি করে প্রথম আলোর এই ধারাবাহিক আয়োজন। আজকের মূল লেখাটি লিখেছেন আমোস জিবার্গ। সারাংশ, ভাষান্তর ও প্রাসঙ্গিক তথ্য-ব্যাখ্যা যুক্ত করেছেন: ইশতিয়াক মান্নান। আগামী সপ্তাহের লেখা, ‘বুদ্ধিবৃত্তিক পেশায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’

বছর তিনেক আগে ১৩ বছরের এক কিশোর টিকটকে একটা অ্যাকাউন্ট খুলল এবং ইন্টারনেটে প্রাপ্তবয়স্কদের বিনোদনের একটি সাইট খুঁজে বের করল। প্রথমে সেই শিশুর অ্যাকাউন্টে ‘শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য’ এমন সব বিষয় আসতে শুরু করল এবং খুব দ্রুত অ্যাকাউন্টের ফিডের ৯০ শতাংশ হয়ে দাঁড়াল ঘনিষ্ঠতা, সম্পর্কের বন্ধন, যৌনতা ইত্যাদি বিষয়ক কনটেন্ট।

এর সঙ্গে সংবাদ বা সাংবাদিকতার কী সম্পর্ক? সম্পর্কটা হচ্ছে এই যে এই ১৩ বছরের কিশোরটি সত্যিকারের মানুষ নয়—ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল–এর ‘কম্পিউটেশনাল জার্নালিজম’ অনুসন্ধানী দলের তৈরি করা একটি চ্যাটবট বা কম্পিউটার প্রোগ্রামকৃত অ্যাকাউন্ট।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পরীক্ষা করে দেখছিল, ‘টিকটক’ অ্যালগরিদম অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উপযোগী নয়, এমন কনটেন্ট দেখা থেকে তাদের প্রতিরোধে যথেষ্ট সক্ষম কি না। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার এই রকম বিভিন্ন কাজে তাঁরা নানা ধরনের এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকেন।

ফরাসি সংবাদপত্র লে মন্ড এআই ব্যবহার করে নিজেদের কাজের ধারা সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছে। ২০২২–এ পত্রিকার ফরাসি ভাষায় লেখাগুলোর অনুবাদ নিয়ে ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হতে শুরু করে। এই কাজে চ্যালেঞ্জ হলো মূলত দুটো। এক. পেশাদার অনুবাদক ভাড়া করা, যার সমস্যা হচ্ছে অনেক খরচ এবং প্রচুর সময়ের প্রয়োজন, দুই. গুগল ট্রান্সলেটরের মতো সহজলভ্য অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করা, যার সমস্যা হচ্ছে, সস্তা ও দ্রুত হলেও সেই অনুবাদ কোনোভাবেই লে মন্ডের লেখার মানের কাছে যেতে পারবে না।

এ ক্ষেত্রে পত্রিকাটি একটা মধ্যপন্থা বেছে নিল। প্রথমে ফরাসি লেখাগুলো পাঠানো হলো ডিপএল নামের একটি এআই অ্যাপ্লিকেশনের কাছে। তারপর লেখাটি পার হলো দুই স্তরের আসল মানুষ সম্পাদকের পর্যালোচনা ও সম্পাদনার মধ্য দিয়ে, যাদের কাজ হচ্ছে লেখায় পত্রিকার নিজস্বতা, নীতিমালা, প্রকাশভঙ্গি বজায় থাকছে কি না, তা পূর্ণাঙ্গভাবে নিশ্চিত করা।

লে মন্ড–এর ইংরেজি সংস্করণের সম্পাদক এলভির কাম্য বলছেন যে এভাবে তাঁরা দিনে প্রায় ৪০টা লেখা তৈরি করতে পারছেন, যেখানে শুধু তাঁদের সাতজনের দলের ওপর নির্ভর করলে দিনে এক থেকে পাঁচটা লেখার বেশি শেষ করা যেত না।

অন্য সব ক্ষেত্রের মতো সংবাদের জগতেও এআই নিয়ে শঙ্কা এবং উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। সবাই একই রকমভাবে উল্লসিত হতে পারছেন না। মূল শঙ্কার জায়গাটা হচ্ছে এআই তার সহজাত দক্ষতা ও কর্মক্ষমতার কারণে ব্যাপকভাবে ‘সংবাদের মতো’ যে সংবাদ তৈরি করছে এবং করতে যাচ্ছে, তা সত্যিকারের মানব সাংবাদিকতার বাজার অনেকখানিই নষ্ট করবে। প্রকাশকেরা এখন জোটবদ্ধ হয়ে টেক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসতে চাচ্ছেন।

সাংবাদিকেরা ব্যক্তিগত পর্যায়েও, কখনো ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কিংবা আইডিয়া তৈরি করতে অথবা সংবাদ শিরোনাম ঠিক করতে এমন নানা কাজে ব্যাপকভাবে এআই ব্যবহার করছেন। নিউইয়র্ক টাইমসের একজন সাংবাদিক বলছেন যে চ্যাটজিপিটি তাকে যেন একটা অতিরিক্ত ক্ষমতা দিয়েছে, যেটা দিয়ে তিনি ঠিক শব্দটা খুঁজে বের করতে পারছেন, বড় লেখার সারাংশ তৈরি করতে পারছেন, কখনো বা রাইটার্স ব্লক কাটাতে সাহায্য নিচ্ছেন। পেশাগত কাজে এআই দ্রুতই তাঁদের নিত্য ব্যবহার্য প্রযুক্তিতে পরিণত হয়ে পড়ছে।

অন্য সব ক্ষেত্রের মতো সংবাদের জগতেও এআই নিয়ে শঙ্কা এবং উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। সবাই একই রকমভাবে উল্লসিত হতে পারছেন না। মূল শঙ্কার জায়গাটা হচ্ছে এআই তার সহজাত দক্ষতা ও কর্মক্ষমতার কারণে ব্যাপকভাবে ‘সংবাদের মতো’ যে সংবাদ তৈরি করছে এবং করতে যাচ্ছে, তা সত্যিকারের মানব সাংবাদিকতার বাজার অনেকখানিই নষ্ট করবে।

আরও পড়ুন

প্রকাশকেরা এখন জোটবদ্ধ হয়ে টেক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসতে চাচ্ছেন। তাঁদের কথা হচ্ছে লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলগুলো যখন প্রশিক্ষিত হয়, তখন তাদের বেশ কিছু কনটেন্ট আসে সংবাদের ওয়েবসাইটগুলো থেকে। তার মানে এআই যখন তার ব্যবহারকারীদের জন্য কনটেন্ট সরবরাহ করছে, তার মেধাস্বত্ব তো কনটেন্টের মূল নির্মাতাও দাবি করতে পারেন।

প্রকাশক জোটের উদ্যোক্তা মিডিয়া মোগল ও আইএসি–এর চেয়ারম্যান ব্যারি ডিলার বলছেন, ‘গত পনেরো বছরে অনলাইনে ফ্রি সংবাদ পরিবেশনের ফলে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। প্রকাশকদের যুক্তিসংগত আর্থিক মূল্য পাওয়ার একটা ব্যবস্থা দাঁড় না করানো গেলে এই ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।’

গুগল জেনেসিস নামে পরীক্ষামূলকভাবে একটা টুল তৈরি করেছে, যা প্রাথমিক তথ্য (যেমন সমসাময়িক ঘটনাবলি) থেকে সংবাদ তৈরি এবং পরিবেশন করতে পারে—ঠিক যে কাজটা সাংবাদিকেরা করেন। গুগল সংবাদপত্রগুলোর কাছে এর উপযোগিতা ব্যাখ্যা করে বলছে যে সংবাদকর্মীদের রুটিন কাজে সাহায্য করার জন্য এই টুল বেশ উপকারী হবে।

নিঃসন্দেহে বেশ কিছু মালিকপক্ষ এটাকে কর্মী ছাঁটাই করে খরচ কমানোর সহজ পন্থা হিসেবে বেছে নেবে। এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানির বেশ কয়েকটা পত্রিকা এআইভিত্তিক নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করে ১৫ থেকে ৩৩ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করেছে।

এআই ব্যবহারের প্রবণতা, আমাদের মানে পাঠকদের ফেলে দিচ্ছে সংখ্যা বনাম গুণগত মানের দোলাচলে। প্রশ্ন জেগেছে, প্রোগ্রাম দিয়ে তৈরি করা সংবাদকে কি সংবাদ বলব না আবর্জনা বলব। গ্রাহক ও কর্মীদের না জানিয়ে এআইএর তৈরি করা লেখা ছাপিয়ে ২০২২–এর শেষে সি-নেট তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিল (সেই লেখাগুলোর মধ্যে বেশ ভুলও ছিল)। সি-নেটের সম্পাদকীয় কর্মীরা জোটবদ্ধ হয়েছিলেন চাকরি হারানোর ঝুঁকি এবং সম্মান ক্ষুণ্ন হওয়ার প্রতিবাদ করতে।

সমস্যার একটা দিক হলো কিছু সংবাদপত্র তাড়াহুড়া করেই এআইএর তৈরি সংবাদ পরিবেশনে ঝুঁকে পড়েছে এবং উত্তেজনার প্রাথমিক ধাপে গ্রাহক পাঠকদের কিছুটা সাড়াও পাচ্ছে। যারা সময় নিয়ে এআই বোঝার এবং ব্যবহার করার নীতিতে চলতে চাচ্ছেন, তাঁরা পড়েছেন বাজারের চাপে।

সংবাদ তৈরি ও পরিবেশনে এআইএর যথেচ্ছ ব্যবহারে হাস্যকর সব ভুল চলে যাচ্ছে পাঠকের কাছে। ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে ভুল খবর পরিবেশন করা ওয়েবসাইটের সংখ্যা গত দুই মাসে প্রায় ১,০০০ গুণ বেড়ে ৪৯ থেকে ৬০০ তে দাঁড়িয়েছে। একটা সাইট ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু এবং তাঁর মনোরোগ চিকিৎসকের লিখে যাওয়া নোটের খবর পরিবেশন করেছে, যা ডাহা মিথ্যা ও বানোয়াট। এই খবর বেশ কয়েকটা দেশে এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারিত হয়েছে।

নিউইয়র্ক পাবলিক রেডিওতে কাজ করা একজন সংবাদ বিশেষজ্ঞ বিরক্ত হয়ে বলেছেন, মানহীন সংবাদের এই রকম নির্বিচার প্রকাশনা চলতে থাকলে পাঠক-গ্রাহকেরা নিজেরাই ইন্টারনেটের এসব আবর্জনা থেকে নিজেদের বের করে নেওয়ার উপায় খুঁজে নেবে।

এআইএর এই অবাক করা দ্রুতগতির বিকাশ ও ব্যবহার থেকে নানা রকম হতাশা ও আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে ঠিকই, উন্নয়ন ও সমাধানও কিন্তু তৈরি হচ্ছে এর মধ্য থেকেই। এআইএর বিকশিত হওয়ার ধরনটাই হচ্ছে যত সমস্যা তত সমাধান। যখনই কোনো ভুল ধরা পড়ছে, তখনই ডেভেলপার ও বিজ্ঞানীরা ফিরে যাচ্ছেন কোডিংয়ের মৌলিক ত্রুটিগুলো ঠিক করতে। এআইএর এই ক্রমাগত ভালো ও নিখুঁত হয়ে ওঠা শেষ বিচারে সাংবাদিকতাকেই সাহায্য করবে।

‘সোর্স স্কাউট’ রিপোর্টারদের সাহায্য করছে কোনো বিষয়ে সাক্ষাৎকার বা মতামত নেওয়ার জন্য উপযুক্ত ও নানামুখী দক্ষতার বিশেষজ্ঞ খুঁজে বের করতে, ‘ওটার এআই’ একদিকে রিপোর্টারকে সাহায্য করছে রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকারকে লেখ্য রূপ দিতে অন্যদিকে প্রকাশককে সাহায্য করছে, যেন পাঠকদের কাছে তাঁদের নিজস্ব চাহিদামাফিক খবর পৌঁছানো যায়।

স্প্যানিশ প্রকাশনা নিউট্রাল তাদের খবরগুলো স্ক্যান করিয়ে নিচ্ছে ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল ‘ক্লেইমহান্টার’ দিয়ে, যেটা কোনো খবরে ভুল থাকার সম্ভাবনা থাকলে তা চিহ্নিত করতে পারে। আসল সংবাদকর্মীরা তারপর এই চিহ্নিত খবরগুলোর সত্যাসত্য যাচাই করে নিতে পারেন।

বোঝাই যাচ্ছে সাংবাদিকেরা এবং প্রকাশকেরা এআইএর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং সম্ভাবনা ও শক্তির সদ্ব্যবহার করা এই দুটো বিপরীতমুখী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই যাচ্ছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তাঁদেরই এখন দেখাতে হবে যে তাঁরা কত বুদ্ধিমান হতে পারেন—এআইকেও দেখাতে হবে, সংবাদের পাঠক-গ্রাহকদেরও দেখাতে হবে।

  • ইশতিয়াক মান্নান আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত বিশেষজ্ঞ