শিক্ষা কমিশন ছাড়াই উচ্চশিক্ষায় যেসব পরিবর্তন সম্ভব

  • বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্নাতকোত্তর ডিগ্রি, অর্থাৎ মাস্টার্সকে শিক্ষক নিয়োগের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করায় উচ্চতর ডিগ্রি হওয়া সত্ত্বেও পিএইচডি ‘অবজ্ঞার’ শিকার হচ্ছে।

  • বিগত সরকার দেশের বিভিন্ন জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, এসব বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষার মান কতটা বজায় রাখতে পারছে?

  • বাণিজ্যনির্ভর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে খেয়ালখুশিমতো। অনেক ক্ষেত্রে পদন্নোতির বিষয়গুলো থাকছে উপেক্ষিত।

আমি যখন জাপানে পিএইচডি করতে গিয়েছিলাম, সেখানে কিছু অভিজ্ঞতা আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল। আমি সেখানে বিভিন্ন কনফারেন্সে গিয়ে দেখেছি, স্কুলের বাচ্চারা আমাদের পাশেই পোস্টার প্রেজেন্টেশন দিচ্ছে। তাদের জন্য আলাদা সেশন রাখা হয়েছে, যেখানে তারা গবেষণা উপস্থাপন করতে পারে এবং অগ্রসরমাণ বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে।

এর মাধ্যমে দুটি বিষয়ের সমন্বয় ঘটে—একদিকে তারা বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীর সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে, অন্যদিকে তাদের সুপ্ত গবেষণার আকাঙ্ক্ষার বিকাশ ঘটছে। পাশাপাশি তারা ছোট বয়সেই আন্তর্জাতিক কিংবা স্থানীয় প্ল্যাটফর্মে জায়গা করে নিচ্ছে। ফলে তারা পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞানের পাশাপাশি গবেষণার ক্ষেত্রেও সমৃদ্ধ হচ্ছে।

স্কুল-কলেজের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেতুবন্ধ’

আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সনদ প্রদান ছাড়াও শিক্ষার্থীদের গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার বিষয়টি গুরুত্ব পাওয়া উচিত। আমার স্পষ্ট মনে আছে, এইচএসসি পাস করার আগে আমি জানতামই না বিশ্ববিদ্যালয়ে কী কী বিষয় রয়েছে এবং কোন বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। বাবা–মায়েরা সন্তানদের শুধু চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হওয়ার গল্প শোনান, যা শিক্ষার সঠিক দিকনির্দেশনা নয়।

উন্নত বিশ্বের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষাকাঠামোই সাজানো হয় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তির আগেই সেখানে ওপেন সেশনের আয়োজন করে। বিভাগগুলো ছোট ছোট স্টল করে রাখে, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা এসে তথ্য জানতে পারে, বিভাগগুলোর গবেষণার বিষয়গুলো জানতে পারে, আকৃষ্ট হওয়ার বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে পারে এবং সেটা স্কুল বা কলেজ পার হওয়ার আগেই। এর ফলে কোন বিষয়গুলোয় তাদের আগ্রহ তৈরি হচ্ছে, তা নিয়ে একটি স্বচ্ছ ধারাণা তৈরি হয়।

স্কুল-কলেজের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ‘সেতুবন্ধ’ তৈরি করতে হলে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোয় সফরের ব্যবস্থা করতে হবে। সেটা একাডেমিক সিলেবাসেই অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে এসব সফর হতে পারে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষকের বছরে তিন থেকে চার মাস ক্লাস স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ করা উচিত।

সিলেবাসের ধারাবাহিকতায় এসব হতে পারে অথবা শিক্ষকদের গবেষণা বা বিশেষায়িত বিষয়গুলোর মধ্য থেকে হতে পারে। কারণ, আমাদের দেশের স্নাতক প্রথম বর্ষের অনেক কিছুই একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে সংক্ষিপ্তাকারে থাকে। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে স্থানীয় কলেজ বা স্কুলগুলোর সঙ্গে একধরনের সম্পর্ক তৈরি হবে, তেমনি স্কুল বা কলেজের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠবিষয়ক সম্যক ধারণা পাবে; শিক্ষকদের শিক্ষা ও গবেষণার বিষয়ে ধারণা পাবে। এতে শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার প্রতি আগ্রহী হবে এবং শিক্ষকদের গবেষণা বা বিশেষায়িত বিষয়ে ধারণা পাবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগপদ্ধতি

বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিন্ন শিক্ষক নিয়োগপদ্ধতির পরিবর্তন নিয়ে বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় লেখা হয়েছে। বর্তমান নিয়োগপদ্ধতির নেতিবাচক ধারাগুলোর পরিবর্তন না হলে দেশে উচ্চশিক্ষার উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। ২০১৮ সালে ২২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের নিয়োগ ও পদোন্নতি অভিন্ন নীতিমালা করেছিল, সেখানে প্রার্থীদের এইচএসসি ও এসএসসিতে জিপিএ–৫ স্কেলে ৪.৫ থাকতে হবে বলা হয়েছিল।

ধারাটি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের জন্য মানানসই নয়। যেখানে একজন শিক্ষার্থী এসএসসি ও এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষার নির্দিষ্ট জিপিএ পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা অংশ নেন এবং উত্তীর্ণ হয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন, সেখানে আগের ফলাফলকে টেনে আনা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। এর ফলে কোনো শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সিজিপিএ ৪ স্কেলে ৩.৯ পেয়েও শিক্ষক হতে পারবেন না কেবল এইচএসসি ও এসএসসিতে কম জিপিএ থাকার কারণে। অগ্রসরমাণ পৃথিবীতে এ ধরনের নিয়োগ–যোগ্যতা বাস্তবসম্মত নয়। এ পদ্ধতির পরিবর্তন হওয়া খুবই জরুরি।

অন্যদিকে সারা বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক হওয়ার নূ্যনতম যোগ্যতা হিসেবে যেখানে পিএইচডি ডিগ্রি থাকাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, সেখানে আমাদের দেশে এই ডিগ্রিকে কেবল ‘অতিরিক্ত যোগ্যতা’ হিসেবে কাউন্ট করে আসছে দশকের পর দশক। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, একাডেমিকভাবে পিএইচডি, ভালো গবেষণা, পেটেন্ট থাকলেও সরাসরি সহকারী, সহযোগী কিংবা অধ্যাপক পদে নিয়োগ পাওয়া যায় না। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয়ভাবে শিক্ষকতার পূর্বাভিজ্ঞতা না থাকলে এসব পদে নিয়োগ দেওয়া হয় না। এটাও খুবই অযৌক্তিক ও অবাস্তব সিদ্ধান্ত।

বিষয়টি এমন যে দুই সহপাঠী একই বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে একজন পিএইচডি করতে গিয়ে চার থেকে পাঁচ বছর পার করলেন, আর অপর বন্ধু স্নাতকোত্তর পাস করেই প্রভাষক পদে নিয়োগ পেলেন। পাঁচ বছর পর প্রথমজন সহকারী অধ্যাপক হলেও পিএইচডি ডিগ্রিধারী দ্বিতীয়জন নিয়োগ পাবেন প্রভাষক হিসেবে; তিনি সহকারী অধ্যাপক হওয়ার দৌড়ে পিছিয়ে গেলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্নাতকোত্তর ডিগ্রি, অর্থাৎ মাস্টার্সকে শিক্ষক নিয়োগের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করায় উচ্চতর ডিগ্রি হওয়া সত্ত্বেও পিএইচডি ‘অবজ্ঞার’ শিকার হচ্ছে। এটা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। শিক্ষায় যদি প্রকৃত উন্নয়ন করতে চাই, তাহলে অবশ্যই শিক্ষক নিয়োগ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের হওয়া উচিত। মাস্টার্স পাস শিক্ষক নিয়োগ অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিত। এ জন্য মানসম্মত একটি নিয়োগবিধি তৈরি করা উচ্চশিক্ষার সংস্কারের জন্য একটি বড় দাবি।

পাবলিক ও প্রাইভেটের মধ্যে সমন্বয়

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপদ্ধতি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাপদ্ধতির মধ্যে বেশ ফারাক দেখা যায়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সিলেবাস ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিষয়ের সিলেবাসে তফাত যেমন থাকে, তেমনি ক্রেডিট–ব্যবস্থাতেও কোনো মিল নেই। এ কারণে দুই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। চাকরিক্ষেত্রে সনদ–যোগ্যতায় একই নিয়ম থাকলেও জ্ঞান অর্জনের তফাত থাকছে।

হাতে গোনা কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনে স্বেচ্ছাচারিতা লক্ষ করা গেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগপদ্ধতির সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের কোনো মিল নেই। ফলে বাণিজ্যনির্ভর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে খেয়ালখুশিমতো। অনেক ক্ষেত্রে পদোন্নতির বিষয়গুলোও থাকছে উপেক্ষিত।

অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যখন নিজেদের ক্যাম্পাস তৈরি করতে বেগ পেতে হচ্ছে, সেখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুসরণ করে নিয়োগপদ্ধতি প্রণয়ন প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। তবে মানসম্মত শিক্ষা পেতে হলে কারা, কীভাবে শিক্ষক হবেন, তার একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকা উচিত।

অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যদিবসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ক্লাস নেন। এটা কেবল দৃষ্টিকটু নয়, স্ববিরোধী আচরণও বটে; যদিও হাতে গোনা কিছু শিক্ষক এসব সুযোগ পাচ্ছেন। এটা বন্ধ করতে হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে পরিবর্তন আনা উচিত। যেহেতু একজন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সনদের মান সমান, সেহেতু শিক্ষক নিয়োগপদ্ধতি ও মান একই কাঠামোর মধ্যে থাকা উচিত।

গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানোর কৌশল

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণার অবস্থা একবারে নিম্নাগামী। প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সরকার যে বরাদ্দ দিচ্ছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে, ৫৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চলতি বছরে বাজেট ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে গবেষণায় ছিল মাত্র ২০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে চার কোটি টাকার কম, যা দিয়ে কখনোই মানসম্মত গবেষণা করা সম্ভব নয়। আর এ জন্য সরকারের উচিত হবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাদ্দের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ অর্থ গবেষণার জন্য বরাদ্দ দেওয়া।

এর পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে গবেষণার সুযোগ তৈরি করতে হবে। দেশের বড় বড় কোম্পানি, বিশেষ করে ফার্মাসিউটিক্যালস, কেমিক্যাল, ব্যাংক বা গ্যার্মেন্টস কোম্পানিগুলো যাতে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সরাসরি গবেষণা খাতে অর্থ বরাদ্ধ দিতে পারে—এমন ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকার নিয়ম করতে পারে, যেসব কোম্পানি গবেষণায় বরাদ্দ দেবে, তারা আয়কর দেওয়ার ক্ষেত্রে ছাড় পেতে পারে।

ধরা যাক, একটি কোম্পানি আয়করের ১০ শতাংশ এক বা একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে বরাদ্দ দিয়েছে, সে ক্ষেত্রে সরকার সেই কোম্পানির আয়কর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কম নেবে। এ রকম হলে কোম্পানিগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব গবেষণার সুযোগ তৈরি করবে এবং তারা গবেষণার ফলাফল বা প্রাপ্ত তথ্য–উপাত্তের অংশীদার হতে পারবে। এ ব্যবস্থা চালু করতে পারলে ভবিষ্যতে আমাদের দেশে গবেষণার একটি নতুন ধারা তৈরি হবে; উচ্চশিক্ষায় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়বদ্ধতা তৈরি হবে।

জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় নয়

বিগত শেখ হাসিনা সরকার দেশের বিভিন্ন জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, এসব বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষার মান কতটা বজায় রাখতে পারছে? বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে প্রতিষ্ঠিত হলেও অনেক ক্ষেত্রে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষার অভাব দেখা যাচ্ছে। তিন থেকে চার বছর আগে অনুমোদিত অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এখনো জমি অধিগ্রহণ, অবকাঠামো নির্মাণ বা শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি।

এসব বিশ্ববিদ্যালয় শুধু সংখ্যা বাড়িয়েছে, কিন্তু মান অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। অনেক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যেনতেনভাবে সনদ প্রদানের অভিযোগ উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত, যেসব বিশ্ববিদ্যালয় এখনো কার্যক্রম শুরু করেনি, অবিলম্বে সেগুলো বন্ধ করা এবং চালু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মানসম্মত শিক্ষার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা।

নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন হলে চালু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আশপাশে ‘সেকেন্ডারি’ শাখা খোলা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর কিংবা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেকেন্ডারি’ শাখা খোলা যেতে পারে। এর ফলে ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের যে মান বা ধারা আছে, তা আর দশটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে অনেক ভালো হবে। বিশ্বের অনেক নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের শাখা রয়েছে।

বিভাগ সংকোচন ও নতুনত্বে তাল

পাকিস্তানের করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রতিবছর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলিয়ে ৪০ জন শিক্ষার্থীর আসন রয়েছে। ভাষা আন্দোলনের পরপরই প্রতিষ্ঠিত হলেও বর্তমানে শিক্ষার্থী কমে পাঁচ থেকে ছয়জনে নেমেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯২১ সালে ফারসি ও উর্দু বিভাগ চালু হলেও ২০০৭ সালে এসে বিভাগটি পৃথক হয়ে উর্দু ও ফারসি বিভাগে বিভক্ত হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা বিভাগের অধীন আরবি, উর্দু, ফারসি ও সংস্কৃত বিষয়গুলো সাবসিডারি কোর্স হিসেবে চালু হয়েছিল, যা পরবর্তী সময়ে পৃথক বিভাগে রূপান্তরিত হয়। ঢাকা ও রাজশাহীর মতো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ভাষা বিভাগগুলো থাকলেও শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কম।

এসব বিভাগের শিক্ষার্থীরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করার পরও অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জন করতে পারেন না। শিক্ষক নিয়োগে সমস্যার কারণে অনেক সময় বিভাগ চালু রাখার উদ্দেশ্য শুধু সনদ প্রদানই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। একইভাবে ইসলামের ইতিহাস, পালি ও সংস্কৃতের মতো বিভাগগুলো নিয়ে পুনর্বিবেচনা করা উচিত। উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আধুনিক করতে হলে গ্লোবাল স্টাডিজ, নিউরোসায়েন্স, সেলুলার ও মলিকুলার মেডিসিন, জলবায়ুবিজ্ঞান, স্পেস সায়েন্স, মেশিন লার্নিং বা বায়োইনফরমেটিকসের মতো বিষয়গুলোর প্রতি জোর দেওয়া উচিত। বিশ্বব্যাপী এখন এসব বিষয়েরই চাহিদা।

শিক্ষা কমিশন ছাড়াও সরকারের পক্ষে উচ্চশিক্ষায় অনেক ধরনের সংস্কার করা সম্ভব। তবে উচ্চশিক্ষায় উন্নয়ন করতে হলে আমাদের শিক্ষাকাঠামোয় মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। সরকারের উচিত বিষয়গুলো নিয়ে গুরুত্বসহকারে ভাবা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা।

ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়

ই–মেইল: nadim.ru@gmail.com