দুনিয়াজুড়ে খেলাধুলা, রাজনীতি ও নির্বাচনে জয়-পরাজয় খুবই স্পষ্ট ব্যাপার। কিন্তু ‘প্যারাডক্সিস্তান’–এ জয়-পরাজয়ের ধারণাগুলো সারা বিশ্ব থেকে ভিন্ন। এখানে যে জিতেছে, সে বিশ্বাস করে না যে সে আসলেও জিতেছে। অন্যদিকে যে হেরেছে, সে মনে করে তাকে হারানো হয়েছে, আসলে সে জিতেছিল।
২৪ নভেম্বরের বিক্ষোভ নিয়ে ইমরান খান ও রাষ্ট্র উভয়ই নিজের বিজয় দাবি করবে। তাদের সমর্থকদের সন্তুষ্ট করার জন্য উভয়ের কাছেই শক্তিশালী যুক্তি থাকবে। রাষ্ট্র বলবে প্রতিবাদ ব্যর্থ হয়েছে। তেহরিক-ই-ইনসাফ বলবে রাস্তা অবরোধ করে ও বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার হেরেছে। ওরা জিতেছে।
আমার মতে, ২৪ নভেম্বর সরকারও জিতেছে এবং তেহরিক-ই-ইনসাফও জিতেছে। পরাজয় ঘটেছে জনগণের, যারা প্রতিদিন শুধু টিকে থাকার জন্য আপ্রাণ লড়ছে।
পাকিস্তানে আজ সামগ্রিক রাজনীতি হেরে যাচ্ছে আর জিতছে ক্ষমতার আসল মালিকেরা। রাজনৈতিক দলগুলো কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি। ফলে ক্ষমতার বলয়ে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিবর্তে নিজেরাই নিজেদের সিদ্ধান্তের কর্তৃত্ব গ্রহণ করেছে। শাহবাজ শরিফ পাকিস্তানের প্রধান নির্বাহী ও প্রধানমন্ত্রী।
তিনি কি ২৪ নভেম্বরের বিক্ষোভ নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের নেতৃত্ব দিয়েছেন? একটি তাড়াহুড়ার প্রেস ব্রিফিং ছাড়া অন্য কিছুতে তাঁর কোনো ভূমিকা আছে বলে মনে হয় না। বরং এ রকম মনে হয় না যেন সিদ্ধান্তগুলো অন্য কেউ নিচ্ছে?
কারাগারে বসে ক্যাপ্টেন ইমরান আর ক্ষমতায় বসে শাহবাজ শরিফ দুজনই ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। ইমরান খানের আমলে ক্ষমতা চলে গেছে এস্টাবলিশমেন্টের হাতে। এখনো তা–ই আছে। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ক্ষমতা বেড়েছে, সিভিল ক্ষমতা তত দুর্বল হয়েছে।
এখন ২৪ নভেম্বরের জয়-পরাজয় বিশ্লেষণ করা যাক। দিনটি ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ল। আরেক দিকে শেয়ারের দর চড়া হতে থাকল। ব্যবসায়ী শ্রেণির সব আশা এখন সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের ওপর। ব্যবসায়ীরা রাজনীতিবিদদের ওপর হতাশ। এর কারণ, রাজনীতিবিদদের ক্ষমতাহীনতা ও অসাবধানতা।
২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে তাঁরা ভরসা রাখতেন রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। পাঞ্জাবের ১০ জন বড় শিল্পপতি নির্বাচনের আগে নওয়াজ শরিফকে নির্বাচনের জন্য ১০০ কোটি রুপি দিয়েছিলেন। তাঁরা মনে করেছিলেন যে নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগ ক্ষমতায় এলে অর্থনীতির উন্নতি হবে। এখন তাঁরা চেয়ে আছেন সেনাপ্রধানের দিকে। তিনি করাচি আর লাহোরের ব্যবসায়ী শ্রেণির সঙ্গে একাধিকবার দেখা করেছেন। মোটকথা, প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর যা করার কথা, সেনাপ্রধান তা–ই করছেন।
রাজনীতিবিদেরা সেনাক্ষমতার কাছে ক্রমে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন। ২৪ নভেম্বরে যা–ই হোক, হেরেছেন রাজনীতিবিদেরা। আর ক্ষমতাবানেরা জিতেছে। সেনাদের ছত্রচ্ছায়ার ক্ষমতাধরেরা ঐক্যবদ্ধ। রাজনীতিবিদেরা একে অপরের জানের দুশমন। এ পরিস্থিতিতে নাগরিক আধিপত্য আর থাকবে কেমন করে? সরকার কীভাবে অর্থনীতি চালাবে? সরকার এখন সেনা আর স্পেশাল ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন কাউন্সিলের পরিকল্পনার শোভা হয়ে টিকে আছে।
২৪ নভেম্বর ইমরান খান কী পেলেন, কী হারালেন? তাঁর দলের দৃষ্টিতে তিনি জিতেছেন। হেরে গেলেও তাঁর নৈতিক বিজয় ঘটেছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বারবার আন্দোলনের ডাক দেওয়া, সিদ্ধান্তে অসংগতি ও অন্তর্দ্বন্দ্ব ইমরানের দর–কষাকষির জায়গা দুর্বল করে দিচ্ছে। তেহরিক-ই-ইনসাফের রাজপথের শক্তির ভয় ক্ষমতাবান ও সরকারকে আর বিরক্ত করছে না। বিচার বিভাগ থেকে কোনো আশা নেই। বিভেদ নেই সেনাবাহিনীর মধ্যে। গণবিপ্লব ও অর্থনৈতিক পতনের মতো সব স্বপ্ন ভেস্তে গেছে।
জনগণের কাছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা সত্ত্বেও তেহরিক-ই-ইনসাফের এমন অবস্থার কারণ কী? কারণ, তাদের মধ্যে প্রাজ্ঞ সিদ্ধান্তের গুরুতর অভাব রয়েছে।
২৪ নভেম্বরে জাতীয় পর্যায়ে যে ‘ফাইনাল কল’ দেওয়া হলো, তার প্রভাব কী? মহাসড়কগুলো বন্ধ ছিল। কোটি কোটি টাকার অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন রক্তপাত ঘটলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। রাজনীতিবিদেরা কি বুঝবেন যে তাঁদের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ ও শত্রুতার কারণে দেশ হেরে যাচ্ছে?
দুই বছরের ক্রমাগত লড়াইয়ের ফলাফল শূন্য। একমাত্র সমাধান হলো মধ্যপন্থা খুঁজে বের করা। পথ হলো সমঝোতা। রাজনীতিবিদেরা যত তাড়াতাড়ি আলোচনায় আসবেন, ততই দেশের জন্য মঙ্গল। স্থায়ী স্থিতিশীলতা আসবে রাজনৈতিক মীমাংসা হলেই।
সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। কিন্তু রাজনীতিতে তাদের সম্পৃক্ততা তাদের বিতর্কিত করেছে। শাসন করা রাজনীতিবিদদের অধিকার। তাঁরা ভালো বা খারাপ, দুর্নীতিবাজ বা সৎ, যা–ই হোন। আবার একজন সৈনিক সাহসী হোন বা কাপুরুষ, যুদ্ধ তিনিই করতে পারেন। কিন্তু পাকিস্তানের সবাই সব ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব নিজের হাতে চায়। ২৪ নভেম্বর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু রাজনীতিবিদেরা কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেননি। আমাদের সবচেয়ে বড় ও সমষ্টিগত ব্যর্থতা এটাই।
● সুহেইল ওরায়িচ সাংবাদিক
পাকিস্তানের দৈনিক জঙ্গ থেকে নেওয়া, উর্দু থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন