২০২১ সালের ১৫ আগস্ট ইসলামি আমিরাত পুনরায় আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর দেড় বছর পার হয়েছে। সেখানকার পরিস্থিতি এখন প্রবল আশাবাদী অবস্থায় রয়েছে। কাবুলের নতুন সরকারের সমালোচকেরা আফগানিস্তানে কিয়ামত নেমে আসবে বলে বিভিন্ন সময় ভবিষ্যদ্বাণী করলেও সেখানকার নিরাপত্তা পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে এবং গত দেড় বছরে সহিংসতার মাত্রা অনেক কমে গেছে।
দোহায় সমঝোতা বৈঠকের সময় অনেক কূটনীতিক বলেছিলেন, তাঁদের মতমতো কাবুলে সরকার প্রতিষ্ঠিত না হলে আফগানিস্তানে আরেক দফা গৃহযুদ্ধ লাগবে। কিন্তু তাঁদের সে আশঙ্কা মিথ্যা প্রমাণ করে ইসলামি আমিরাত পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।
গোটা দেশে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করামাত্রই আমরা নতুন করে লড়াই শুরু হওয়ার সব সম্ভাব্যতাকে দুর্বল করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি। এর অংশ হিসেবে ইসলামের মানবতার দিকগুলোর ওপর জোর দিয়ে আমরা ভ্রাতৃত্ব ও সাধারণ ক্ষমার কথা বলেছি।
এখন যুদ্ধ শুধু থামেইনি, বরং দেশটি একটি শক্তিশালী ও দায়িত্বশীল সরকার দ্বারা শাসিত হচ্ছে। গত চার দশকের মধ্যে এ ধরনের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সেখানে এই প্রথম দেখা যাচ্ছে। বিদেশি সহায়তার ওপর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো নির্ভরতা থেকে দেশকে বের করে আনতে সরকার নানা ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে।
আমরা আমাদের পণ্য উৎপাদনের সব খাতেই ‘আফগানীকরণ’ করে ক্ষান্ত হচ্ছি না, সেই খাতগুলোর দেশীয়করণকে দেশের সাধারণ জনগণের কাছে অধিকতর জবাবদিহিমূলক করার চেষ্টা করছি। এটি আমাদের নিজস্ব ভূখণ্ডের পণ্যকে আরও বেশি নিজের মনে করার চেতনাকে পোক্ত করছে।
একই সঙ্গে আমরা বুঝি, আধুনিক সম্পর্কের বৈশ্বিক প্রকৃতি হলো সবাই পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করবে। সেই সম্পর্কের ভিত্তিভূমি হলো সাম্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহযোগিতার চেতনা। এই চিন্তা মাথায় রেখে আফগানিস্তানের বর্তমান সরকার বিশ্বের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে আরও একবার সবার প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সভায় দাঁড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় দায়িত্বশীলতার শর্ত আফগানিস্তানের বর্তমান সরকার সুন্দরভাবে পূরণ করেছে। এখন বিশ্ব সম্প্রদায়ের দায়িত্ব আফগানিস্তানকে স্বাধীন দেশ হিসেবে মেনে নেওয়া এবং দেশটিকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সহায়তা করা।
মনে করে দেখুন গত দুই দশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে আফগানিস্তানে লাখ লাখ সেনা পাঠিয়েও তারা তাদের উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারেনি। আজকের দিনে এসেও তারা নতুন দিনের উদ্গত অঙ্কুরকে স্বাগত না জানিয়ে অতীতেই পড়ে আছে। বর্তমান সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপগুলোর দিকে দৃষ্টি না দিয়ে শুধু অভিযোগ করা আর চাপ দেওয়ার নীতিই তারা আঁকড়ে আছে। কিন্তু তাদের এ বাস্তবতা মানতে হবে যে এক হাতে তালি বাজবে না।
আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে এড়িয়ে একটি জোট নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকাই হবে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি। সাম্য ও পরস্পরের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে অংশীদার সব পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষণে আমরা সচেষ্ট হব।
আমাদের অভ্যন্তরীণ অনেক বিষয় নিয়ে এখনো আন্তর্জাতিক মহলে অনেক ভুল-বোঝাবুঝি রয়ে গেছে। ভুল তথ্য দূর করে আফগানিস্তানের প্রকৃত মূল্যবোধ ও চিত্র তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা রয়ে গেছে। বিশেষ করে আমাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতাকে সামনে আনার ক্ষেত্রে আমাদের অধিকতর সতর্কতা দরকার। বিগত যে সরকারগুলোই এই সংবেদনশীলতার ভারসাম্য ঠিকমতো রক্ষা করতে পারেনি, সেই সরকারই বিপদে পড়েছে। সাম্প্রতিক ইতিহাস আমাদের বারবার এই শিক্ষা দিয়েছে।
আমরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপমুক্ত পরিমণ্ডলে সংলাপ ও মতবিনিময়ে বিশ্বাসী এবং যাবতীয় ভুল-বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে ব্যবহারিক সমাধানের পথ অন্বেষণে সচেষ্ট। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, মানুষের ভোগান্তিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করাটা কোনো সুফল বয়ে আনে না। আফগানিস্তানে চলমান মানবিক সংকট দূর করা আমাদের যৌথ নৈতিক দায়িত্ব। মানুষের কষ্ট ও ভোগান্তিকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা কোনো সভ্য চিন্তা সমর্থন করে, না নৈতিকভাবে তা ন্যায্যতা পায়।
আফগানিস্তানে চলমান অর্থনৈতিক সংকটের প্রাথমিক কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত অবরোধ ও ব্যাংকিং নিষেধাজ্ঞা। এই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে মানবিক সংকট মোকাবিলায় যথাযথভাবে সাড়া দেওয়া সম্ভব হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র যখন আফগান জনগণের ওপর থেকে সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে, তখনই আফগান জনগণের মানবিক মর্যাদার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শ্রদ্ধা প্রমাণিত হবে। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, আফগানিস্তানের যে অর্থ যুক্তরাষ্ট্র জব্দ করেছে, তা মুক্ত করা এবং দোহা চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কাবুলের ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ তুলে নেওয়া উচিত।
আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে বারবার বলেছি, অবরোধ ও চাপ দিয়ে পারস্পরিক মতভিন্নতার সমাধান হয় না। আমরা সমঝোতা করে সমাধানে পৌঁছাতে পারি। আমরা ওয়াশিংটনকে বলেছি, আফগানিস্তানের ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার এবং সরকার ভেঙে পড়ার ইতিহাস আছে। বিশ্বের কোনো পরাশক্তির পক্ষে সে অবস্থা থেকে আফগানিস্তানকে রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
এখন কথা হলো, আফগান সরকারকে দুর্বল করলে তার পরিণতি কী হবে? নিশ্চিতভাবে আফগান নাগরিকেরা খাদ্য ও চিকিৎসা সংকটের মতো মানবিক সংকটের মুখে পড়বে। এ সংকট আফগানিস্তানের সীমানায় আটকে থাকবে না। এতে আবার দেশটিতে অস্থিরতা দেখা দেবে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোতে শরণার্থীর স্রোত যেতে পারে। তাতে প্রতিবেশীরাও সংকটের মুখে পড়বে।
সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, গত দুই দশকে আফগান অর্থনীতির পুরোটাই বৈদেশিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল করে ফেলা হয়েছে। আচমকা সেই সহায়তা একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আফগান জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে।
মনে করে দেখুন গত দুই দশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে আফগানিস্তানে লাখ লাখ সেনা পাঠিয়েও তারা তাদের উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারেনি। আজকের দিনে এসেও তারা নতুন দিনের উদ্গত অঙ্কুরকে স্বাগত না জানিয়ে অতীতেই পড়ে আছে। বর্তমান সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপগুলোর দিকে দৃষ্টি না দিয়ে শুধু অভিযোগ করা আর চাপ দেওয়ার নীতিই তারা আঁকড়ে আছে। কিন্তু তাদের এ বাস্তবতা মানতে হবে যে এক হাতে তালি বাজবে না।
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
মৌলভি আমির খান মুত্তাকি আফগানিস্তানের অন্তর্বর্তীকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী