আমরা মৃত্যু উৎপাদন করি
কথায়, ইচ্ছায়, আর সাধনায়, আর কারখানায়
আমরা মৃত্যু উৎপাদন করি
গতকাল সকালে বেইলি রোডে পুড়ে যাওয়া কঙ্কালসার বহুতল ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। অসংখ্য মানুষের ভিড়। বেশির ভাগই নির্বাক, স্তব্ধ। কথা বললেও ক্ষীণ আওয়াজ, যা আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল আইনশৃঙ্খলা কর্মী আর সংবাদকর্মীদের কণ্ঠের। সেখানে ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে, ভবনের নিচে পড়ে থাকা ভাঙা কাচের গুঁড়ির ওপর হাঁটতে হাঁটতে নাকি মর্গে গিয়ে মানুষের লাশ আর স্বজনের আহাজারি দেখতে গিয়ে কখন এই গানটির কথা স্মরণে আসল, জানি না।
সারা দিনই সোনার বাংলা সার্কাস ব্যান্ডের জনপ্রিয় এই গানই খালি মাথার ভেতরে বাজছিল। আর একের পর এক দৃশ্য ভেসে আসছিল ফ্ল্যাশব্যাকের মতো—সিদ্দিকবাজার, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, মগবাজার, রূপগঞ্জ, বিএম কনটেইনার, চুড়িহাট্টা, রানা প্লাজা। কোনটা মার্কেট, কোনটা কারখানা, কোনটা আবাসন ভবন—সেটি নিশ্চয়ই স্পষ্ট করে বলার দরকার নেই।
তবুও ব্যস্ত সকাল
কী ভয়াবহ এক সকাল অপেক্ষা করছে, তা জানা ছিল না। ঘুম থেকে উঠেই দেখি, বেইলি রোডে বহুতল ভবনে আগুন লেগে অনেক মানুষের প্রাণহানি। বাসার কাছেই বেইলি রোড। ফলে অফিসে না গিয়ে আগে সেখানেই ছুটে গেলাম।
সকাল নয়টার পরই হাজির হলাম বেইলি রোডে। রাস্তা আটকে দেওয়ায় দুই রিকশা ঘুরে যেতে হলো। আশপাশে অনেক স্কুল-কলেজ, ফলে কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট ব্যাচ পড়ানো শিক্ষকদের বাসাও। ফলে ছুটির দিনে অলিগলিতে মানুষের ব্যস্ততা চোখে পড়ল, বেশির ভাগই শিক্ষার্থী-অভিভাবক। তাঁদের সবাই হয়তো জানেন কয়েক গলি পরই ঘটে গেছে সেই ঘটনা। কিন্তু এই জাদুর শহর ঢাকার বাসিন্দারা খুব ভালো করেই জানেন, এখানে কোনো শোক বেশিক্ষণ স্থায়ী থাকে না। থাকার সুযোগও নেই।
হাঁটা দূরত্বে কিছু রেস্তোরাঁ পুড়ে ছাই হলেও এ গলি ও গলি সব রেস্তোরাঁতে মানুষে ভরপুর। কারণ, সকালের নাশতা মুখে দিয়েই ছুটতে হবে।
আগুন লাগার শুরুর মুহূর্তে
বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ নামের আটতলা ওই ভবনটিতে গতকাল বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে আগুন লাগে। পরদিন সকাল ১০টায় তখন আমি সেই ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী থেকে আগের রাতের বর্ণনা শুনলাম। যুবকের নাম আবদুল্লাহ আল হারুন রাসেল। পেশায় আইনজীবী। পরিবার নিয়ে তিনিও ওই ভবনে খেতে এসেছিলেন। কয়েকটি দোকান ছাড়া পুরো ভবনেই রেস্তোরাঁ। ভবনে ঢুকতে গিয়েই রাসেল দেখেন নিচতলায় আগুন, দেখেই পিছিয়ে আসেন।
তিনি বলেন, তখন মাত্র শুরু। অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র দিয়ে কেউ কেউ নিচতলার সেই আগুন নেভানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু আগুন আরও বেড়ে যাচ্ছিল। তখন ওপর তলায় রেস্তোরাঁ থাকায় অনেকে বুঝতে পেরে কাচের জানালার কাছে চলে এসেছেন। আগুন দেখে সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।
তখন রাসেলসহ নিচে থাকা অনেকে চিৎকার করে তাঁদের ভয় না পেতে বলেন। ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেওয়া হয়েছে, এখনই চলে আসবে। এর মধ্যে একটি বাঁশ বা কাঠের মই জোগাড় করে দ্বিতীয় তলার রেস্তোরাঁর জানালা খুলে মানুষকে নামিয়ে আনছিলেন তাঁরা। সাত-আটটি শিশু ও আরও কয়েকজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে নামিয়ে আনার পরপরই ঘটল বিস্ফোরণ।
রাসেল জানালেন, নিচে সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগুন তখন মুহূর্তের মধ্যে গোটা ভবনে ছড়িয়ে গেল। আগুন লাগার খবর পেয়ে দ্রুত এসেছে ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু তারা প্রস্তুতি নিতে না নিতেই আগুনটা ছড়িয়ে গেল। ফায়ার সার্ভিস আর কয়েকটা সেকেন্ড সময় পেলেই আগুন অতটা ছড়িয়ে পড়ত না হয়তো।
ওপর থেকে নিচ, নিচ থেকে ওপরে
ছুটির আগের রাত। ফলে পরিবার-পরিজন ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে অনেকেই খেতে এসেছিলেন। ছিল লিপ ইয়ারও। চার বছর পরপর আসা বিশেষ দিন সুন্দর স্মৃতিতে ধরে রাখতেও অনেকে এসেছিলেন। কারও ছিল জন্মদিন। কেউ চলে যাবেন দেশের বাইরে পড়তে। সব মিলিয়ে একটা উদ্যাপনমুখর রাত ছিল। রেস্তোরাঁগুলোতেও তো অনেক মানুষ কাজ করতেন। ছিলেন নিরাপত্তাকর্মীসহ নানা পেশার মানুষ।
ভবনটির সিঁড়ি থাকলেও সেটি ছিল সরু এবং সেটি দিয়ে চলাচল না থাকায় জিনিসপত্র রাখা হতো। মূলত লিফটেই ওঠানামা। আগুন লাগা ও বিস্ফোরণের ফলে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় সেই লিফটও বন্ধ হয়ে যায়।
অনেকে আগুন নিচে লেগেছে বলে দৌড়ে ওপরে উঠেছেন, আবার অনেকে আগুন ওপরে ছড়িয়ে গেছে বলে নিচের দিকে ছুটেছেন। ছোট সিঁড়ি দিয়ে এই ছোটাছুটি করতে গিয়ে অনেকে মারা গেছেন। বেশির ভাগ মানুষ মারা গেছেন শ্বাসনালিতে ধোঁয়া ঢুকে।
সবাই যেন ভান করছেন, কেউ কিছু জানতেন না
গা ঘেঁষে দাঁড়ানো পাশের বহুতল ভবনজুড়েও রেস্তোরাঁ। সেটির দিকে তাকিয়ে রাসেল বলছেন, গত মাসে সেখানকার একটি রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিলেন কয়েকজন মিলে তাঁরা। কোনো কারণে লিফটে নামতে না পারায় সিঁড়ি ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে তাঁদের নামতে দেওয়া হলো না। কারণ, সেই সিঁড়ি ব্যবহারের উপযোগী নয়।
তিনি আরও জানালেন, সেই ভবনের সিঁড়িও অনেক সরু। একসঙ্গে দুজন নামার সুযোগ নেই। তখন তিনি রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষকে বলেছিলেন, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে মানুষ কীভাবে নামবে?
প্রতিটি অগ্নি দুর্ঘটনা ও বিস্ফোরণের পরই এক্সিট সিঁড়ির বিষয়টি বারবার আলোচনায় আসে। এক্সিট সিঁড়ি মানে মূল সিঁড়ির বাইরে আলাদা সিঁড়ি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আলাদা সিঁড়ি তো দূরের কথা, মূল সিঁড়িই নেই এসব ভবনের। মূলত রেস্তোরাঁ ব্যবসার কাজে ব্যবহার করা হয় এসব ভবনের সিঁড়িগুলোকে।
আমরা এ–ও জানতে পারছি, রাজউক বলছে ভবনের অফিস বা বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমতি ছিল কিন্তু সেখানে রেস্তোরাঁ খোলার অনুমোদন ছিল না। রেস্তোরাঁ মানে গ্যাসের লাইন বা গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার। আলাদা তদারকি। আলাদা নিয়মকানুন। আলাদা ব্যবস্থাপনা।
ফায়ার সার্ভিস নাকি ভবন কর্তৃপক্ষকে তিনবার চিঠিও দিয়েছে। ভবনটিতে নিরাপত্তার অভাব আছে বলে যথাযথ কর্তৃপক্ষকেও জানিয়েছিল। এরপরও কীভাবে অনুমোদনহীনভাবে এই রেস্তোরাঁ চলে? কারা চালাতে দেয় বা দেন? তাঁদের কাছে কখনো জবাবদিহি চাওয়া হবে না, সেটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। সেটি করা গেলে তো একের পর এক এমন ঘটনাই ঘটত না।
সবাই এখন বিশাল দায়িত্ববান হয়ে মুখ ভার করে কড়া কড়া কথা বলছেন। এমন সিরিয়াস ভান করছেন, যেন কেউ কিছুই জানতেন না! বেইলি রোডে এমন কিছু দায়িত্ববানকে কথা বলার সময় তাঁদের গম্ভীর গম্ভীর মুখ দেখে কেন জানি হাসিই পেল।
গ্যাস সিলিন্ডারভর্তি অনুমোদনহীন এতগুলো রেস্তোরাঁয় কী সহজে ‘মৃত্যু উৎপাদন’ করে গেলেন তাঁরা সবাই।
রেস্তোরাঁ থেকে মর্গে
বেইলি রোড থেকে ঢাকা মেডিকেলের মর্গের দিকে যাচ্ছিলাম। রমনা এলাকা থেকে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, কার্জন হলের কোনায় কানায় লাল পলাশ ফুটে আছে। কোকিলের ডাকও শোনা যাচ্ছে। কিন্তু মাথার ভেতরে বাজছিল গানটা—আমরা মৃত্যু উৎপাদন করি।
ঢাকা মেডিকেলের মর্গে ঢুকতেই এক পরিবারকে পেলাম। সবাই পুরুষ। কান্নারত এক বয়স্ক ভদ্রলোককে ঘিরে আছেন বাকিরা। ধীরে ধীরে কথা বলে জেনে নিলাম। তাঁদের এক সন্তান মর্গের ভেতরে আছেন। এখনো শনাক্ত হননি।
গত বছর পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণের পর মর্গে আর আসা হয়নি। কখনো আসতে না হোক, সেটিই তো আমরা চাই। সেদিনও ছিল শবে বরাতের রাত। সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণে ক্ষত লাশের রক্তে মর্গের মেঝে ভিজে গিয়েছিল। এবার শবে বরাতের কদিন পরই বেইলি রোডের আগুন।
মর্গের সামনেই ট্রলিতে একটি মৃতদেহ। সাদা কাপড়ে ঢাকা। পরিচয়হীন মানে অজ্ঞাত। কিছুক্ষণ পর সিআইডির দায়িত্বপ্রাপ্তরা মরদেহটির ডিএনএ স্যাম্পল ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট। অন্য সংবাদকর্মীদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দেখলাম সে দৃশ্য।
সিআইডি কর্মকর্তা মৃতদেহের হাত বের করতেই বুঝলাম, একজন নারী। এক আঙুলে মেয়েদের একটি আংটি। হাতে বাঁধা চিকন সুতুলি। কার মেয়ে, স্বামী-সন্তান আছে কি, বাড়ি কোথায়, কী করতেন—কত প্রশ্নই ঘুরছিল মাথায় তখন।
পুতুল নাকি শিশুটি, কে শুয়ে আছে নিথর
মর্গের ভেতরে তখন কয়েকটি মৃতদেহ। এক মেয়েশিশু, তিনজন নারী ও একজন পুরুষ। নিখোঁজদের খুঁজতে আসা স্বজনদের মর্গে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে মৃতদেহগুলো শনাক্ত করতে। দরজা খুলতেই দেখা যাচ্ছে ভেতরটা। এক পাশের দরজা খুলতেই দেখা গেল পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া এক মৃতদেহ।
কিছুক্ষণ পর আরেক পাশের দরজা খুলতেই যে দৃশ্য দেখলাম তা আজীবন হয়তো ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। এক নারীর মৃতদেহের পাশে ছোট্ট একটা শরীর। যেন পুতুল একটা। দুজনের বুকেই কাগজ সাঁটানো, লেখা—অজ্ঞাতনামা।
শিশুটির মাথার মাঝখানে বাঁধা ঝুঁটিটি তখনো অক্ষত। হাতে, মুখে ও জামাকাপড়ে ছাই লেগে আছে। পায়ে জুতা নেই, তবে দুই পায়ে দুটো মোজা। গোলাপি রঙের মোজা। মা কিংবা বাবা হয়তো শখ করে পরিয়ে দিয়েছিলেন। কোনো উপলক্ষে সবাই মিলে রেস্তোরাঁয় খেতে এসেছিলেন। হায়, এখন কোথায় তাঁরা, কোথায় তাঁদের মানিকের ধন আদরের পুঁটলিটা!
একটু পর কয়েকজন তরুণ এসে একজনকে শনাক্ত করলেন। হাতঘড়ি আর পেটে আগের অস্ত্রোপচারের কাটা দাগ দেখে চিনতে পারলেন, এ তাঁদের বন্ধু। নাম এ কে এম মিনহাজউদ্দিন খান। রেস্তোরাঁয় যাওয়ার আগেও দেখা হয়েছিল তাঁদের। পরে জানতে পারলাম, শুরুতে সাক্ষাৎ হওয়া কান্নারত বয়স্ক ভদ্রলোকেরই সন্তান শনাক্ত হওয়া এই যুবক। মর্গ থেকে বের হওয়ার সময় দেখলাম, তখনো তাঁরা কাঁদছেন।
মর্গের বাইরে এসে পেলাম আরেক তরুণকে। তাঁর এক বন্ধুর লাশ অ্যাম্বুলেন্সে তুলছেন। একটি সিলিন্ডারের দোকানে কাজ করতেন নিহত ওই তরুণ। বয়স ২১। ওই ভবনে রেস্তোরাঁতে সিলিন্ডার সরবরাহ করতেন। সেটির বিল বা বকেয়া টাকা নিতে গিয়েছিলেন। জীবনের খাতায় আজীবনের জন্য তিনি নিজেই বকেয়া হয়ে গেলেন।
নোয়াখালীর সেনবাগের বাসিন্দা ওই তরুণের মা-বাবা মারা গেছেন। দুই ভাই প্রতিবন্ধী। এক ভাই অনেক ঋণ করে মাত্র কয়েক মাস আগে বিদেশে গেছেন। এখনো ঋণ শোধ হয়নি। এই ছোট ভাই-ই প্রতিবন্ধী বড় ভাইদের দেখাশোনা করতেন। এক প্রতিবন্ধী ভাইকে পেলাম, ঠিকঠাক কথা বলতে পারেন না। এখনো হয়তো বুঝতেই পারছেন না, কী হারিয়েছেন, কাকে হারিয়েছেন।
আরেক মর্গে যে দৃশ্য অপেক্ষা করছিল
ঢাকা মেডিকেলের মর্গ থেকে বের হয়ে গেলাম পাশেই বিশাল বার্ন ইনস্টিটিউটে। সেখানকার মর্গ ভবনের বেজমেন্ট। নিচে নামতেই মর্গের একজন দায়িত্বরত ব্যক্তিকে পেলাম। সেখানে আর কেউ ছিল না। মর্গটি থেকে ইতিমধ্যে নয়টি মৃতদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
দায়িত্বরত ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ফ্রিজারে তোলার অপেক্ষায় থাকা একটি মৃতদেহ চোখে পড়ল। জিজ্ঞাসা করলাম, এটি কিসের মৃতদেহ? তিনি জবাব দিলেন, বেইলি রোডেরই। মাত্র ঢাকা মেডিকেলের মর্গ থেকে এসেছে। এখনো পরিচয় জানা যায়নি।
তাঁর কথা শেষ হতে না হতেই দুই সাংবাদিক দৌড়ে ঢুকলেন। একজন তরুণী ও একজন তরুণ। ঢামেকের মর্গের সামনেই তাঁদের দেখেছিলাম অজ্ঞাতনামা লাশের ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহের সময়।
তরুণী ফ্রিজারের সামনে দৌড়ে গেলেন। চেহারা দেখতে চাইলেন। আগুনের আঁচ লেগে চেহারা কালো হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে মুষড়ে পড়লেন তরুণী। বলে উঠলেন, ‘এটি তো আমাদের অভিশ্রুতি। ওই মর্গে দেখে কেন জানি সন্দেহ হচ্ছিল।’
লাশটি ফ্রিজারে ঢোকানোর পর মর্গের সহকারী মোবাইল থেকে ছবি বের করে দেখালেন। আবার দেখলেন সাংবাদিক দুজন। এরপর নিশ্চিত হলেন এটিই তাঁদের অভিশ্রুতি।
তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, সাংবাদিক অভিশ্রুতি শাস্ত্রী। কিছুদিন আগেও একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে কাজ করতেন। আর আজকে মানে ১ মার্চে আরেকটি সংবাদমাধ্যমে নতুন চাকরিতে যোগদান করার কথা ছিল তাঁর। এরপর একের পর এক জানা গেল, অভিশ্রুতির আরেক বন্ধুও মারা গিয়েছেন। তাঁর লাশ আগেই শনাক্ত হয়েছে। তিনিও সংবাদমাধ্যমে কাজ করতেন। দুজনই বন্ধু ছিলেন। নতুন চাকরিতে যোগদান উপলক্ষে বন্ধুকে নিয়ে রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিলেন অভিশ্রুতি। এখন তাঁরা দুজন দুই মর্গে শুয়ে আছেন।
আহা, জীবনের এসব বেদনাদায়ক গল্পই বোধ হয় করুণ সিনেমা হয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়।
গোলাপের রংটিও লাল
বার্ন ইনস্টিটিউট থেকে বের হয়ে অফিসের দিকে রওনা দিলাম। ছুটির দিন হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা চলছে। মানুষ ও যানবাহনের ভিড়-ব্যস্ততা। শাহবাগের দিকে আসতেই ফুলের দোকানের বিপরীতে নামলাম। নিকট-দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে, লাল টকটকে গোলাপ ফুল। তখনো মনে পড়ে গেল সোনার বাংলা সার্কাসের গানটি :
প্রতিটি মৃত্যুর সঙ্গে, প্রতিটি লাশের সঙ্গে
বিনা মূল্যে দিয়েছি একটি করে গোলাপ
পরিহাসের বিষয় হলো সেই গোলাপের রংটিও লাল
তোমার শিশুর হাসির মতো লাল
তোমার প্রেমিকার কপালের টিপের মতো লাল
তোমার শরীরে বয়ে চলা রক্তের মতো লাল
আমরা মৃত্যু উৎপাদন করি
একটি বেদনাদায়ক স্বস্তি
সন্ধ্যার দিকে ফেসবুকে অভিশ্রুতির বন্ধুবান্ধবের শোকগাথা দেখলাম। তাঁকে নিয়ে আলাদাভাবে প্রতিবেদনও চোখে পড়ল সংবাদমাধ্যমগুলোতে। তাঁর ফেসবুক আইডিতে ঢুকতেই ধাক্কা খেলাম। তাঁর ছবিটা কোথায় যেন দেখেছি।
তিনি ফেসবুকে আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলেন মানে ফেসবুকে আমার বন্ধু হতে চেয়েছিলেন। কয়েক সপ্তাহ আগের কথা। কিন্তু তাঁর সেই আহ্বানে আমি সাড়া দিইনি। কেন দিইনি, তা–ও জানি না। এমন তো কতই হয়।
কিছুটা অপরাধবোধ হলেও অন্তত এতটুকু স্বস্তি যে মর্গে ‘চেনা’ অভিশ্রুতির মৃতদেহ দেখার সেই কঠিন মুহূর্তের সাক্ষী আমাকে হতে হয়নি।
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় বিভাগের সম্পাদকীয় সহকারী। ই–মেইল: [email protected]