জাপার ইভিএম–যুদ্ধ ও ছাত্রলীগ নেতার ‘দুগ্ধস্নান’

সম্প্রতি জাতীয় পার্টিতে ‘ঝোড়ো হাওয়া’ লক্ষ করা যাচ্ছে। একদিকে দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরসহ দলের অধিকাংশ নেতা। অন্যদিকে দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ, সাবেক মহাসচিব মসিউর রহমান ও তাঁদের কয়েকজন অনুসারী।

নির্বাচন সামনে রেখে সব দলই সংগঠন গোছানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। যে যার মতো করে কেন্দ্রীয় কাউন্সিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সভাপতি ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘একজন কাউন্সিলর তাঁকে না চাইলে তিনি দলীয় প্রধান পদে থাকবেন না।’ তবে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে সে রকম কাউকে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

জাতীয় পার্টি নব্বইয়ের পর থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিবাদের সুযোগ নিয়ে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান শক্ত করেছে। গত তিন দশকে জাতীয় পার্টির জনসমর্থন যত কমই হোক, ক্ষমতার রাজনীতিতে নিজের গুরুত্ব প্রমাণ করেছে। ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ প্রথম ক্ষমতায় এসেছে এরশাদের হাত ধরে। মাঝখানে চারদলীয় জোট করে সেই হাত ছুটে গেলেও এখন পর্যন্ত তারা আওয়ামী লীগের মিত্র হিসেবেই আছে।

নব্বইয়ের পর জাতীয় পার্টি কয়েকবার ভাগ হয়েছে। প্রথম ভাগ হলো আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে, আবদুল মতিন ও নাজিউর রহমানের নেতৃত্বে দ্বিতীয় ভাগ। তৃতীয় ভাগ হলো কাজী জাফরের নেতৃত্বে। মূলধারার জাতীয় পার্টি নিয়ে এখন কাদের-রওশন টানাটানি চলছে। এটা কি নিছক নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব না আরও কিছু? ২০১৪ সালের আগে এরশাদ সাহেব বলেছিলেন, তাঁরা একতরফা নির্বাচনে যাবেন না। আওয়ামী লীগ বেকায়দায় পড়েছিল। রওশনই তাদের উদ্ধার করেন। এবারও রওশন ত্রাতা হবেন কি না, ভবিষ্যৎ বলে দেবে।

জি এম কাদের জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান। কিন্তু জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা রওশন। একই সঙ্গে দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। জাতীয় পার্টি শুরু থেকে নির্বাচনে ইভিএমের বিরোধিতা করে আসছে। জি এম কাদের বলছেন, কারচুপির নির্বাচন করতেই ইভিএম চালু করা হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশ ইভিএম থেকে সরে এসেছে। বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল ইভিএমের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্যাংককের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রওশন এরশাদ এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচন অবশ্যই করব। জাতীয় পার্টি কখনো নির্বাচন বর্জন করেনি। ইভিএম হলেও নির্বাচন করব। সারা বিশ্বে এখন ইভিএমে নির্বাচন চলছে। আমাদের দেশে ইভিএমে (নির্বাচন) হবে, এটা তো নতুন কথা নয়। অবশ্যই ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচন করব।’

আরও পড়ুন

জি এম কাদের আশঙ্কা করছেন, ২০২৩ সালেও একটি জবরদস্তির নির্বাচন হবে। রওশন বলছেন, ‘আমি জানি, ভালো নির্বাচন হবে।’ এর আগে তিনি ২৬ নভেম্বর দলের কাউন্সিল হবে বলেও ঘোষণা দেন। জি এম কাদেরের অনুসারীরা বলেছেন, প্রধান পৃষ্ঠপোষকের কোনো এখতিয়ার নেই দলের কাউন্সিল ডাকার।

শুক্রবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, দলের ঘোষিত অবস্থানের বাইরে গিয়ে রওশন এরশাদ এখন যে তৎপরতা চালাচ্ছেন, এর মধ্য দিয়ে তিনি এবং তাঁর অনুসারীরা সরকারের সহানুভূতি ও আনুকূল্য পাওয়ার চেষ্টা করছেন। পাশাপাশি জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের ওপর চাপ সৃষ্টি করে পদ–পদবি হারানো এবং বহিষ্কৃত কয়েকজন নেতাকে দলে ফেরানোও তাঁর (রওশন) লক্ষ্য।

গত বৃহস্পতিবার রওশনের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ আহূত সংবাদ সম্মেলনে জাপার সাবেক নেতা দেলোয়ার হোসেন খান, এস এম এম আলম, জিয়াউল হক মৃধা, এম এ গোফরান, জাফর ইকবাল সিদ্দিকী, নুরুল ইসলাম, ফখরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, ইকবাল হোসেন ও কাজী মামুনুর রশীদ উপস্থিত ছিলেন। এসব নেতার কেউই অনেক দিন ধরে জাপার কোনো পদে নেই।

দলের মহাসচিব মো. মুজিবুল হকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গাইবান্ধার উপনির্বাচনে (ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বীর মৃত্যুতে খালি হওয়া আসন) ইভিএমে ভোট গ্রহণের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে। এর অর্থ হলো ভোটযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে জাতীয় পার্টিতে ইভিএম নিয়ে যুদ্ধ চলছে।

২.

বিভিন্ন স্তরে ছাত্রলীগের সম্মেলন ও নেতৃত্ব নির্বাচন নিয়ে দেশের নানা জায়গায় হাঙ্গামা চলছে। কোনো কোনো স্থানে সম্মেলন হচ্ছে। অথচ কমিটি হচ্ছে না। আবার কোথাও কোথাও কমিটি হলেও তার বিরুদ্ধে নেতা–কর্মীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদও অনেক আগে শেষ হয়েছে। ফলে এ কমিটির মূল নেতা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকও তাঁদের পদ হারিয়েছেন বলা যায়। বর্তমান সভাপতি আল নাহিয়ান ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আছে। ইতিমধ্যে ছাত্রলীগের অনেক নেতার বয়স চলে গেছে। অনেকে আবার চাকরি-বিয়ে করেও ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসীন, যদিও এটা গঠনতন্ত্রের পরিপন্থী।

এরই মধ্যে প্রথম আলোর কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি ছাত্রলীগ সম্পর্কে একটি কৌতূহলোদ্দীপক খবর দিয়েছেন। প্রায় এক যুগ পর কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। কমিটিতে কাঙ্ক্ষিত পদ না পেয়ে দুধ দিয়ে গোসল করে রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়েছেন মো. আরমিন নামের ছাত্রলীগের এক নেতা। বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে দুধ দিয়ে গোসল করার একটি ভিডিও নিজের ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করেন আরমিন। পরে সেটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

এর আগে গত বুধবার জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. আনোয়ার হোসেন মোল্লা ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফয়েজ ওমান খানের স্বাক্ষরিত ১৯ সদস্যবিশিষ্ট পাকুন্দিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। কমিটিতে নাজমুল আলমকে সভাপতি ও মো. তোফায়েল আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। দুধ দিয়ে গোসল করা আরমিনকে কমিটিতে ১ নম্বর সহসভাপতি করা হয়েছিল।

পাকুন্দিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বুধবার কমিটি ঘোষণার পর থেকে ফেসবুকে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। পদবঞ্চিত একটি অংশ কমিটি বাতিল চেয়ে বুধবার বিকেলে পাকুন্দিয়া পৌর সদর বাজারে বিক্ষোভ মিছিল করে।

ছাত্রলীগ নেতা আরমিন আহমেদ তাঁর ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘১২ বছর ছাত্রলীগ থেকে আমার অর্জন ৭টি মামলার আসামি, ১ বছর ধরে পুলিশের হয়রানি। পঙ্গু, শূন্য পকেটে দুধ দিয়ে গোসল করে রাজনীতি থেকে বিদায় নিলাম।’ তাঁর অভিযোগ, ‘ছাত্রদল থেকে আগত, বিএনপি পরিবার থেকে আগত কারও কাছে আত্মসমর্পণের চেয়ে বিদায় নেওয়া ভালো সিদ্ধান্ত। রাজনীতিটা বুক দিয়ে নয়, আবেগ দিয়ে করেছি। আবেগে ভেজালের স্থান নেই। ঘোষিত কমিটিতে আমিই সবার সিনিয়র। সভাপতি করা হলে আমাকে করা হবে। আমি কোন পদের প্রার্থী, তা না জিজ্ঞেস করেই ফেসবুকে কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। তাই আমি দুঃখে দুধ দিয়ে গোসল করে ছাত্ররাজনীতির ইতি টানলাম।’

কিশোরগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. আনোয়ার হোসেন মোল্লা অবশ্য দাবি করেন, দীর্ঘদিন পর পাকুন্দিয়ায় একটি চমৎকার কমিটি দেওয়া হয়েছে। ছাত্রদলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে নতুন কমিটির সভাপতি বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। কমিটি ঘোষণার পর পদবঞ্চিতরাসহ একটি মহল তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। আবার অনেকেই সস্তা প্রচারণা চালিয়ে ভাইরাল হতে ফেসবুকের আশ্রয় নিচ্ছে। তবে ভিন্ন আরেকটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করে নিজ উপজেলার কমিটির সভাপতি হয়ে যাওয়া নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়। এতে স্থানীয় ত্যাগী নেতারা বঞ্চিত হওয়ারই কথা।

এখন দেখার বিষয়, দুগ্ধস্নানে পরিশুদ্ধ মো. আরমিন তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন, না তিনিও কাঙ্ক্ষিত পদ পেলে ঘরের ছেলে ঘরে ফেরার মতো দলে ফিরে আসবেন।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]