ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ইউরোপে অনেকগুলো সংঘাত যে আসন্ন, তারই সূচনা। আগামী দিনগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের মতো ইউরোপেও কি একই ধরনের সংঘাত দেখতে যাচ্ছি? গত সপ্তাহে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চীনের একজন পণ্ডিত আমাকে এই প্রশ্নটি করেন। তাঁর এই যুক্তি থেকে এটা স্পষ্ট যে ইউরোপের ভূরাজনীতিকে বদলে দিতে যাওয়া ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পর্কে অ–পশ্চিমা বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গিটা পশ্চিমাদের তুলনায় অনেকটাই ভিন্ন।
চীনের বুদ্ধিজীবী ও পণ্ডিতদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বিশ্ব সম্পর্কে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিটা আমি বুঝতে পেরেছি। পশ্চিমারা যেভাবে ভাবেন, তার চেয়ে একেবারে মৌলিকভাবে ভিন্ন অবস্থান চীনাদের। ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য ক্রেমলিনের চেয়ে ন্যাটোর সম্প্রসারণ প্রচেষ্টাকে দোষ দেন তাঁরা। চীনাদের মৌলিক কৌশলগত ধারণাগুলোও আমাদের বিপরীত।
ইউরোপীয় ও আমেরিকানরা যখন ইউক্রেন যুদ্ধকে বিশ্ব ইতিহাসের একটি বাঁকবদল বলে মনে করছেন, তখন এ যুদ্ধকে চীনারা কেবল আরেকটি হস্তক্ষেপমূলক যুদ্ধ বলে মনে করেন। ৭৫ বছর ধরে কোরিয়া, ভিয়েতনাম, ইরাক ও আফগানিস্তানে পশ্চিমারা যেসব যুদ্ধ পরিচালনা করেছে, তার চেয়েও ইউক্রেন যুদ্ধ কম তাৎপর্যের একটি যুদ্ধ। তাঁদের কাছে ইউক্রেন যুদ্ধের একমাত্র বস্তুগত পার্থক্য হচ্ছে, এবারের হস্তক্ষেপটা পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে হয়নি।
ইউরোপীয় তাত্ত্বিকেরা ভাবছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমেরিকা আবার বিশ্ব আধিপত্য ফিরে পাবে। কিন্তু চীনের বুদ্ধিজীবীরা মনে করছেন, আমেরিকা-পরবর্তী যে বিশ্বব্যবস্থা আসতে যাচ্ছে, এ যুদ্ধ তারই প্রমাণ। তাঁদের দৃষ্টিতে, বিশ্বে মার্কিন আধিপত্যের পরিসমাপ্তিতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে, সেটা এখন পূরণ করতে চলেছে রাশিয়া।
এরপরও চীনের পর্যবেক্ষকদের ভিন্নভাবে পশ্চিমকে দেখার এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জানানো উচিত। বাকি বিশ্ব পশ্চিমাদের সম্পর্কে কেন এ রকম ধারণা পোষণ করে, তা নিয়ে আমাদের আরও কঠোর ভাবনা ভাবার প্রয়োজন। চীনা পণ্ডিতদের যুক্তিকে কেউ কথার কথা, বৈরিতার প্রকাশ কিংবা অগণতান্ত্রিক শাসন বলে উড়িয়ে দিতে পারেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নমনীয় হওয়া প্রয়োজন।
পশ্চিমারা ইউক্রেন যুদ্ধকে আন্তর্জাতিক উদারনৈতিক ব্যবস্থার ওপর আক্রমণ বলে মনে করেন। অন্য দিকে চীনের বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন, এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বহু মেরুভিত্তিক বিশ্বের জন্ম হবে, যেখানে অনেক আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক কেন্দ্র থাকবে। তাঁদের যুক্তি হলো, আন্তর্জাতিক উদারনৈতিক ব্যবস্থার বৈধতার ঘাটতি সব সময়ই ছিল। পশ্চিমারাই এই ব্যবস্থা তৈরি করেছে। কসোভো কিংবা ইরাকে পশ্চিমারা তাঁদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যা করেছে, তার জন্য কখনোই অনুশোচনা করেনি।
মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে ইউরোপের তুলনার ক্ষেত্রে এই যুক্তিগুলোই তুলে ধরেছেন চীনের পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবীরা। আমার সঙ্গে যাঁদের আলাপ হয়েছে, তাঁদের কেউই ইউক্রেনে হামলাকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের ওপর আগ্রাসন বলে মনে করেননি। বরং এটিকে পশ্চিমা আধিপত্যের সমাপ্তির পর রাষ্ট্রীয় সীমান্তের পুনর্বিন্যাস বলে মনে করেছেন তাঁরা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে পশ্চিমারা মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সীমান্ত ভাগ করে দিয়েছিল। ওই রাষ্ট্রগুলো পরবর্তী সময়ে সেই সীমান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। ইউরোপের প্রেক্ষাপটকে সেই ঘটনার সঙ্গে তুলনা করেছেন চীনারা।
সবচেয়ে লক্ষণীয় বৈপরীত্য হচ্ছে, তাঁরা ইউক্রেন যুদ্ধকে প্রক্সি যুদ্ধ বলে বিবেচনা করেন। তাঁরা মনে করেন সিরিয়া, ইয়েমেন এবং লেবাননে বড় শক্তিগুলো যেভাবে ইন্ধন যুগিয়েছে ও যুদ্ধ উসকে দিয়েছে, ইউক্রেনের ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটছে। তাহলে এই যুদ্ধে প্রধানভাবে লাভবান হচ্ছে কে? আমার চীনা বন্ধুরা মনে করেন, এ যুদ্ধে রাশিয়া, ইউক্রেন কিংবা ইউরোপ লাভবান হয়নি। চূড়ান্তভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে। এ ছাড়া দুই পক্ষই তাদের বৃহত্তর প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিপ্রেক্ষিতে এটিকে প্রক্সি যুদ্ধ হিসেবে দেখছে।
ইউরোপীয়, জাপানি ও কোরীয়দের যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি নতুন জোটে আটকে দেওয়ার মাধ্যমে আমেরিকানরা লাভবান হয়েছে। এ ছাড়া তারা রাশিয়াকে একঘরে করে দিতে পেরেছে এবং চীনকে সীমানাগত অখণ্ডতার মতো বিষয়ে স্পষ্ট একটা অবস্থান নিতে বাধ্য করতে পেরেছে। একইভাবে রাশিয়ার এখন যে অধীনস্ত অবস্থান, সেটাকে ব্যবহার করে এবং দক্ষিণ-বিশ্বের আরও বেশিসংখ্যক দেশকে নিরপেক্ষ জোটে টেনে এনে লাভবান হয়েছে চীন।
ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে যখন ইউরোপীয় নেতারা নিজেদের একুশ শতকের চার্চিলের ভূমিকায় নিজেদের দেখতে চাইছেন, তখন চীনারা তাঁদের বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক দাবা খেলায় বোড়ের বাইরে কিছু ভাবছেন না। চীনের যেসব পণ্ডিত ব্যক্তির সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, তাঁদের সবার ভাবনায় একটা ঐক্যমত্য দেখেছি। স্বল্পমেয়াদি কোভিড-১৯ মহামারির ধাক্কা আর বৈশ্বিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রামের তুলনায় ইউক্রেন যুদ্ধ তাঁদের কাছে গুরুত্বহীন বিষয়।
চীনা বুদ্ধিজীবী ও পণ্ডিতদের এই যুক্তিগুলোর বিপরীতে কেউ যুক্তি দেখাতেই পারেন। ইউরোপে সীমান্ত নিয়ে সংঘাতের বিষয়ে চীনের পণ্ডিত যা বোঝাতে চেয়েছেন, ইউরোপীয়দের কাছে অবশ্যই ভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমা বিশ্ব যে শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে, তাতে করে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সীমান্ত সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ কম (১৯৯০-এর দশকে যুগোশ্লাভিয়ায় যে রকম সংঘাত ছড়িয়ে পড়েছিল)।
এরপরও চীনের পর্যবেক্ষকদের ভিন্নভাবে পশ্চিমকে দেখার এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জানানো উচিত। বাকি বিশ্ব পশ্চিমাদের সম্পর্কে কেন এ রকম ধারণা পোষণ করে, তা নিয়ে আমাদের আরও কঠোর ভাবনা ভাবার প্রয়োজন। চীনা পণ্ডিতদের যুক্তিকে কেউ কথার কথা, বৈরিতার প্রকাশ কিংবা অগণতান্ত্রিক শাসন বলে উড়িয়ে দিতে পারেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নমনীয় হওয়া প্রয়োজন।
চীনা পর্যবেক্ষকদের এই বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি পশ্চিমাদের ব্যাখ্যা করতে সহায়তা করবে– কেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা বাকি বিশ্বের কাছে সমর্থন পায় না। একই সঙ্গে ‘পর্দার পেছনের’ রাজনীতি যখন নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠছে, তখন অন্য দেশগুলোও এখন ইউক্রেনের গুরুত্বকে অস্বীকার করা শুরু করতে পারে। পশ্চিমারা উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থা রক্ষায় বীরত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষায় নেমেছে; অথচ অন্যরা ভাবছে এটাই পশ্চিমা আধিপত্যের ক্ষেত্রে শেষ নিশ্বাস এবং বহু মেরুর নতুন একটা বিশ্বব্যবস্থা জন্ম হলো বলে।
স্বত্ব প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে
• মার্ক লিওনার্ড মার্ক লিওনার্ড ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের পরিচালক