হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের ডিন মাঝেমধ্যে নাশতা বা দুপুরের খাবারের সময় ছাত্রছাত্রীদের সময় দেন। সাধারণত সাত–আটজন শিক্ষার্থীর একটা দল ডিনের অফিসে গিয়ে আলোচনায় অংশ নিতে পারে। কয়েক মাস আগে দুপুরের খাবার খেতে খেতে ডিনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হলো।
এ ধরনের আলোচনায় কোনো নির্দিষ্ট অ্যাজেন্ডা থাকে না। ছাত্রছাত্রীরা তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, এমন যেকোনো বিষয় নিয়ে ডিনকে নিজস্ব মতামত জানাতে পারেন। ডিন মনোযোগ দিয়ে প্রত্যেকের কথা শুনলেন, নোট নিলেন, কিছু বিষয়ের ব্যাখ্যা দিলেন এবং কয়েকটি বিষয় সহকর্মীদের সঙ্গে উত্থাপন করবেন বলে জানালেন।
স্কুলে সবাই অকপটে রাজনৈতিক এবং সামাজিক নানা বিষয়ে মতামত প্রকাশ করতে পারে কি না, সেই বিষয়টিও কথা প্রসঙ্গে এল। ডিনের মন্তব্য, ‘মনে করা হয়, কেনেডি স্কুলের বেশির ভাগ শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রী ডেমোক্র্যাট দলের সমর্থক।
এ জন্য এখানে রিপাবলিকান দলের সমর্থকেরা নিজস্ব মতপ্রকাশে সাধারণত কুণ্ঠিত থাকে।’ এরপর যোগ করলেন, ‘এতে ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান উভয় দলের ক্ষতি হচ্ছে।’ ডিনের ইচ্ছা, স্কুলে রিপাবলিকান পার্টির সমর্থক শিক্ষার্থী বেশি করে আসুক, তাহলে নানা বিষয়ে আলোচনা বা বিতর্ক আরও অর্থপূর্ণ হবে।
নেতৃত্ব বিষয়ে পড়ান, এমন একজন অধ্যাপক আমাদের বলেছিলেন, ‘যাদের সঙ্গে তোমাদের মতের অমিল, তাদের সঙ্গেই বেশি কথা বলো। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করো।’ তাঁর একটা সহজ পরামর্শ ছিল। কেউ যদি এমন কিছু বলে যা একজনের চিন্তাভাবনার সম্পূর্ণ বিপরীত, তাহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বরং আগ্রহ প্রকাশ করে বলতে হবে, ‘এ বিষয়ে আমাকে আরও বলুন।’
অন্যের কথা শোনা মানেই যে তার সঙ্গে একমত হওয়া, সেটা নয়, কিন্তু ভিন্নমতের অস্তিত্ব আছে তা স্বীকার করা এবং তাকে বুঝতে চাওয়াটা খুব জরুরি। আসলে কি তা হচ্ছে? যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য স্থানের মতো হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলেও ‘ক্যানসেল কালচার’ আছে। কেউ যদি এমন কথা বলেন বা কাজ করেন, যাকে অন্যরা ‘অগ্রহণযোগ্য’ মনে করছে, তাহলে তাকে বর্জন করা বা একঘরে করার প্রবণতাকেই ‘ক্যানসেল’ করা বলা হয়।
অসংখ্য মানুষ প্রতিনিয়ত নানা বিষয়ে মতামত প্রকাশ করছেন—আড্ডায় অথবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কিন্তু সত্যিকারের চিন্তার আদান-প্রদান হচ্ছে কি? অন্যের সঙ্গে মতের বিনিময়ে আমরা কি বিষয়টাকে কিছুটা হলেও অন্যভাবে দেখছি, নিজস্ব অবস্থানকে নতুনভাবে বিচার করছি? নাকি আমরা নিজেদের মত প্রকাশ করে এবং অন্যদের মতামত অবজ্ঞা করেই তৃপ্তি পাচ্ছি?
কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, ক্যানসেল কালচার সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সদস্যদের মতামত প্রকাশের একটা সুযোগ দিয়েছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, এর ফলে বাক্স্বাধীনতা সংকুচিত হয় এবং মুক্ত বিতর্ক অসম্ভব হয়ে পড়ে। তবে এ বিষয়ে প্রায় সবাই একমত যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রসারে ক্যানসেল কালচার বহুগুণ বেড়ে গেছে। এর ফলে অনেকে নিজের মতামত, বিশেষ করে তা যদি সংখ্যাগুরুর মতের সঙ্গে না মেলে, তা প্রকাশে ভয় পাচ্ছে।
ক্যানসেল কালচার এবং অন্যান্য কী কারণে হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলে সবাই মন খুলে কথা বলতে পারে না, তা বিশ্লেষণ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে—জরিপ এবং আলোচনার মাধ্যমে স্কুলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মতামত জানতে চাওয়া হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য সমস্যাটার সমাধান করে স্কুলে সব বিষয়ে অকপটে আলোচনা ও বিতর্কের সংস্কৃতি তৈরি করা।
ডিনের সঙ্গে আলোচনা করতে করতে আমি বাংলাদেশের সমাজের কথা ভাবছিলাম। আমরা কি বিভিন্ন বিষয়ে সবার দৃষ্টিভঙ্গি জানার এবং বোঝার ব্যাপারে আগ্রহী? নাকি নিজের মতটাই ‘একমাত্র সত্য’ বলে মনে করছি? অন্যের নিন্দা না করেও যে নিজের মতামত প্রকাশ করা যায়, সে বিষয়টা কি আমরা জানি? রাজনীতি, খেলা, বিনোদন, সমাজে নারীর অবস্থানসহ যেকোনো বিষয়ে কি আমরা গঠনমূলক বিতর্ক করতে পারি, নাকি কিছুক্ষণের মধ্যেই তা কথা-কাটাকাটিতে পরিণত হয়?
সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে ভাবনা এবং জীবনাচরণে আমাদের থেকে কেউ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু তার মানেই সে ‘ভুল’, তা কিন্তু নয়। ইন্টারনেট কি আমাদের মানসিকভাবে উদার করেছে, নাকি আমরা নিজেদের মতো যারা ভাবে শুধু তাদের সঙ্গেই যোগাযোগ রেখে একটা বুদ্বুদের মধ্যে বাস করছি?
অসংখ্য মানুষ প্রতিনিয়ত নানা বিষয়ে মতামত প্রকাশ করছেন—আড্ডায় অথবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কিন্তু সত্যিকারের চিন্তার আদান-প্রদান হচ্ছে কি? অন্যের সঙ্গে মতের বিনিময়ে আমরা কি বিষয়টাকে কিছুটা হলেও অন্যভাবে দেখছি, নিজস্ব অবস্থানকে নতুনভাবে বিচার করছি? নাকি আমরা নিজেদের মত প্রকাশ করে এবং অন্যদের মতামত অবজ্ঞা করেই তৃপ্তি পাচ্ছি?
কিছুদিন আগে প্রাচীন আগোরায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। এথেন্সের জনজীবনের কেন্দ্রে ছিল এই স্থান; জিনিসপত্র কেনাবেচা থেকে শুরু করে আইন প্রণয়ন—সবই হতো এখানে। একজন রাজনৈতিক দর্শনের অধ্যাপক প্রাচীন এথেন্স, সেখানে গণতন্ত্র নিয়ে নিরীক্ষা ইত্যাদি বিষয় ব্যাখ্যা করলেন। তিনি মনে করিয়ে দিলেন, এথেন্সে প্রশ্ন করা এবং বিতর্ককে উৎসাহিত করা হতো, বিদেশিদের এবং তাদের চিন্তাভাবনাকে স্বাগত জানানো ছিল স্বাভাবিক। এথেন্সের বিখ্যাত দার্শনিকদের অনেকেই এসেছিলেন অন্য নগর থেকে; তাঁরা এথেন্সকে সমৃদ্ধ করেছেন। কিন্তু স্পার্টা ছিল এর বিপরীত। সেখানে বিদেশিদের স্থান ছিল না, ভিন্নমত সহ্য করা হতো না। পৃথিবীর অনেক দেশ কি স্পার্টা হয়ে যাচ্ছে? তাহলে কি তা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি নয়?
আমরা যদি নিজেদের মতো আঁকড়ে থাকার মনোভাব নিয়ে কোনো আলোচনা শুরু করি, তাহলে তা খুব বেশি দূর এগোয় না। কীভাবে খোলা মনে অর্থপূর্ণ কথোপকথন করা যায়, সে বিষয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জুলিয়া মিনসনের কিছু পরামর্শ আছে।
তিনি চারটি বিষয় মনে রাখতে বলেছেন, নিজের মতামতটা চাপিয়ে না দেওয়া বা খুব প্রকটভাবে ব্যক্ত না করা; যে দুজনের আলোচনা তাদের মাঝের ঐক্যের বিষয়গুলোতে জোর দেওয়া; অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি স্বীকার করা এবং ইতিবাচকভাবে বিষয়টাকে উপস্থাপন করা।
মোদ্দাকথা হলো, অন্যের মতকে শ্রদ্ধা করতে হবে। একটি গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ায় পরমতসহিষ্ণুতা, বিশেষ করে বিরোধী মতকে স্থান দেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। কবীর সুমন গেয়েছেন, ‘যুক্তিকে বাঁচতে দাও, যুক্তিকে বাঁচতে দাও/ যুক্তির স্বচ্ছ আলোয় শাণিয়ে নিচ্ছি আমার চোখ/ বিরোধীর যুক্তিটাও বন্ধুরা আমল দাও/ বিরোধীর স্বাধীনতাটাই স্বাধীনতা সাব্যস্ত হোক।’
আসুন, যুক্তিকে বাঁচিয়ে রাখি।
লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী